গুরু পূর্ণিমা উপলক্ষে দেশজুড়ে শ্রদ্ধার আবেশ, নেতৃবৃন্দের শুভেচ্ছা বার্তা, দিল্লিতে ট্রাফিক নির্দেশিকা জারি

নয়াদিল্লি, ১০ জুলাই : আজ সারা দেশজুড়ে অত্যন্ত শ্রদ্ধা, ভক্তি ও আধ্যাত্মিক আবহে পালিত হচ্ছে গুরু পূর্ণিমা—একটি ঐতিহ্যবাহী উৎসব, যা গুরুদের প্রতি কৃতজ্ঞতা ও শ্রদ্ধা নিবেদনের একটি বিশেষ দিন। আধ্যাত্মিক কিংবা একাডেমিক, জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে যারা জ্ঞান, দীক্ষা ও মূল্যবোধের আলোয় পথ দেখিয়েছেন, তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে আজকের এই দিনটি পালিত হচ্ছে। গুরু পূর্ণিমা হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈন এবং শিখ—সব সম্প্রদায়ের কাছেই এক গুরুত্বপূর্ণ দিন হিসেবে গণ্য হয়।

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এই বিশেষ দিনে দেশবাসীর উদ্দেশে তাঁর শুভেচ্ছা বার্তা প্রদান করেছেন। তিনি ‘এক্স’-এ লেখেন, “রু পূর্ণিমার বিশেষ উপলক্ষে সবাইকে শুভেচ্ছা।” এই ছোট বার্তার মধ্যেই তিনি গুরুদের প্রতি তাঁর আন্তরিক শ্রদ্ধা এবং গুরু-শিষ্য পরম্পরার গুরুত্ব তুলে ধরেন।

কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ গুরু পূর্ণিমার তাৎপর্য নিয়ে বিস্তারিত লেখেন। তিনি বলেন, “ভারতীয় সংস্কৃতিতে গুরু-শিষ্য সম্পর্ক কেবলমাত্র শিক্ষার মাধ্যম নয়, বরং এটি একটি জীবনব্যাপী দিকনির্দেশনা। ইতিহাস সাক্ষী যে আমাদের গুরুগণ নৈতিকতা, জ্ঞান, আচরণ, সংস্কৃতি এবং দেশপ্রেমের বীজ শিষ্যদের মধ্যে রোপণ করেছেন।” তিনি আরও বলেন, “এই দিনে আমি দেশ গঠনে অবদান রাখা সমস্ত শিক্ষককে শ্রদ্ধা জানাই।”

উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ গুরু পূর্ণিমার আধ্যাত্মিক দিক তুলে ধরেন তাঁর বার্তায়। তিনি বলেন, “গুরুর কৃপায় শিষ্য অজ্ঞতা থেকে আত্মজ্ঞান, অন্ধকার থেকে আলোর দিকে এগিয়ে যায়।” তিনি আরও লেখেন, “এই পবিত্র দিনে আমরা সেই সকল মহান গুরুদের স্মরণ করি, যাঁরা শিষ্যের জীবনে সেবা, সত্য ও মূল্যবোধের সঙ্গে জীবন গঠনের দীক্ষা দিয়ে থাকেন।”

তিনি আজ তাঁর গুরু মহন্ত অবৈদ্যনাথ ও মহন্ত দিগ্বিজয়নাথের সমাধিতে গিয়ে শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণ করেন, যা উত্তর ভারতের গুরু-শিষ্য সম্পর্কের ধারাকে আরও একবার সামনে নিয়ে আসে।

গুরু পূর্ণিমা মূলত হিন্দু ধর্মে ব্যাস পূর্ণিমা নামেও পরিচিত। এটি মহর্ষি বেদব্যাসের জন্মতিথি, যিনি ‘মহাভারত’ রচনা করেন এবং বেদের সংকলন করেন। তাঁকে হিন্দুধর্মে অন্যতম শ্রেষ্ঠ আধ্যাত্মিক গুরু হিসেবে পূজিত করা হয়। হিন্দুধর্মে বিশ্বাস করা হয়, গুরু শিষ্যকে অন্ধকার থেকে আলোয় নিয়ে যান—তাঁদের জীবনকে মোক্ষ বা পরম জ্ঞানের পথে পরিচালিত করেন।

এই উৎসব শুধুমাত্র হিন্দু ধর্মেই সীমাবদ্ধ নয়। বৌদ্ধ ধর্মে, এই দিনে গৌতম বুদ্ধ বোধিপ্রাপ্তির পর তাঁর প্রথম ধর্মচক্র প্রবর্তন করেন সারণাথে। জৈন ধর্মে, গুরু পূর্ণিমা পালিত হয় ভগবান মহাবীর ও তাঁর প্রধান শিষ্য গৌতম স্বামী-কে শ্রদ্ধা জানানোর মধ্য দিয়ে। শিখ ধর্মেও গুরুদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন বিশেষ গুরুত্ব পায়।

আজকের দিনে সারা দেশে মন্দির, আশ্রম, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং আধ্যাত্মিক কেন্দ্রগুলিতে নানা আচার-অনুষ্ঠান পালিত হচ্ছে। গুরু পূজা, প্রার্থনা, উপবাস, ধর্মীয় আলোচনা, সত্সঙ্গ এবং আধ্যাত্মিক বক্তৃতার মাধ্যমে শিষ্যরা তাঁদের গুরুদের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করছেন। কোথাও কোথাও মিষ্টি বিতরণ, পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ ও সমাজসেবা মূলক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমেও গুরু পূর্ণিমার উদযাপন করা হচ্ছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতেও শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীদের সম্মান জানানো হচ্ছে এই দিনে।

এদিকে, দিল্লির ভাটি মাইনস, মেহরৌলি এলাকায় অবস্থিত ‘গুরুজি কা আশ্রম’-এ আজ এক বিশাল ধর্মীয় সমাবেশের আয়োজন করা হয়েছে। দিল্লি ট্রাফিক পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, প্রায় ১ লক্ষ ভক্ত, যার মধ্যে বহু গণ্যমান্য ব্যক্তি ও ভিআইপি উপস্থিত থাকবেন, এই আশ্রমে আসবেন বলে অনুমান করা হয়েছে। এই সমাবেশ উপলক্ষে বিশেষ ট্রাফিক নির্দেশিকা জারি করা হয়েছে।

সকাল ৭টা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত দক্ষিণ দিল্লির বিভিন্ন রাস্তায় যানবাহন চলাচলে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয়েছে। নিয়ন্ত্রিত এলাকাগুলোর মধ্যে রয়েছে এসএসএন মার্গ, ভাটি মাইনস রোড, মান্ডি রোড, এমজি রোড, অনুব্রত মার্গ।

জরুরি পরিষেবার যানবাহন যেমন অ্যাম্বুলেন্স, পুলিশ ও দমকল বিভাগকে রাস্তায় চলাচলের অনুমতি দেওয়া হয়েছে, তবে এসএসএন মার্গ ও ১০০ ফুটা রোড এড়িয়ে চলার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।

যাঁরা মেহরৌলি, সাকেত বা এইমস থেকে গুরগাঁও অভিমুখে যাত্রা করছেন, তাঁদের ঔরবিন্দো মার্গ – আউটার রিং রোড – NH-48 হয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।

দিল্লি ট্রাফিক পুলিশ নাগরিকদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে—রেলস্টেশন, বিমানবন্দর ও হাসপাতালমুখী যাত্রা আগেভাগে পরিকল্পনা করতে; যানজটপূর্ণ এলাকা এড়িয়ে চলতে; গণপরিবহন ব্যবহারে উৎসাহিত হতে; ট্রাফিক পুলিশের নির্দেশিকা অনুসরণ করতে; তাঁদের সোশ্যাল মিডিয়া চ্যানেল থেকে নিয়মিত আপডেট নিতে।

গুরু পূর্ণিমা শুধুমাত্র একটি ধর্মীয় বা আচারিক উৎসব নয়—এটি হল কৃতজ্ঞতা, জ্ঞান, নৈতিকতা ও দীক্ষার প্রতি সমাজের সম্মান প্রদর্শনের প্রতীক। গুরু মানেই পথপ্রদর্শক—যিনি আমাদের অজ্ঞতা থেকে মুক্তি দিয়ে সত্য, ধর্ম ও আত্মজ্ঞান-র পথ দেখান। এই দিনে রাষ্ট্রনেতা থেকে শুরু করে সাধারণ নাগরিক—সবাই তাঁদের জীবনের গুরুদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে জীবনের উচ্চতর আদর্শের প্রতি নিজেদের প্রতিশ্রুতি পুনর্নবীকরণ করেন। এভাবেই গুরু পূর্ণিমা আমাদের সংস্কৃতির, ঐতিহ্যের এবং জীবনের আলোয় ভরা এক স্মারক দিন হয়ে ওঠে।