ট্রাম্প ১৪টি দেশের উপর ২৫-৪০% ট্যারিফ আরোপের হুঁশিয়ারি দিলেন: বাণিজ্যিক উত্তেজনা বাড়ানোর আশঙ্কা

ওয়াশিংটন, ৭ জুলাই – যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সোমবার এক নতুন বাণিজ্যিক পদক্ষেপের ঘোষণা দিয়েছেন, যার ফলে ১৪টি দেশের উপর বড় আকারে নতুন শুল্ক (টারিফ) আরোপ করা হবে। এই পদক্ষেপের মাধ্যমে তিনি তার বাণিজ্যিক চাপ আরও বৃদ্ধি করছেন এবং বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন দেশকে যুক্তরাষ্ট্রের পণ্যের চাহিদা বৃদ্ধি ও উৎপাদন বাড়ানোর দিকে বাধ্য করার চেষ্টা করছেন।

এতে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত হতে পারে এশীয় দেশগুলো, যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অনেক দেশ এখনও চাপ অনুভব করছে। ১ আগস্ট থেকে ২৫% থেকে ৪০% পর্যন্ত এই ট্যারিফের হার নির্ধারণ করা হয়েছে, এবং ট্রাম্প প্রশাসন এই সিদ্ধান্তের প্রতি দৃঢ়তা দেখাচ্ছে। যদি এই দেশগুলো মার্কিন পণ্যের জন্য বাজার খুলে না দেয় কিংবা যুক্তরাষ্ট্রে আরও বেশি পণ্য উৎপাদনের সুযোগ সৃষ্টি না করে, তবে এই ট্যারিফের হার আরও বাড়ানো হতে পারে।

ট্রাম্পের ঘোষণায় অন্তর্ভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক শক্তি যেমন – জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, মালয়েশিয়া, কাজাখস্তান, তিউনিসিয়া, কম্বোডিয়া, থাইল্যান্ড, সার্বিয়া, বাংলাদেশ, দক্ষিণ আফ্রিকা, বসনিয়া-হার্জেগোভিনা, ইন্দোনেশিয়া, লাওস এবং মিয়ানমার।

এই দেশগুলোর মধ্যে বেশিরভাগই এখন পর্যন্ত ১০% ট্যারিফের আওতায় ছিল, যা ট্রাম্পের নতুন ঘোষণা অনুযায়ী ২৫%-৪০% এ বৃদ্ধি পাবে। বিশেষত লাওস এবং মিয়ানমার দুটি দেশই ৪০% শুল্কের আওতায় পড়বে, যা এসব দেশের জন্য মারাত্মক আর্থিক চাপ সৃষ্টি করতে পারে।

ট্রাম্প এসব দেশগুলোর শীর্ষ নেতাদের কাছে একাধিক চিঠি পাঠিয়েছেন, যেখানে তিনি উল্লেখ করেছেন যে, যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্যিক সম্পর্কের উন্নতির জন্য প্রস্তুত, তবে “এটি কেবলমাত্র আরো সুষম এবং ন্যায্য বাণিজ্য” ভিত্তিতে হবে। ট্রাম্প তার চিঠিতে স্পষ্টভাবে জানিয়েছেন, “যদি আপনার দেশ মার্কিন পণ্যের বাজার খুলে দেয়, আপনার শুল্ক ও বাণিজ্যিক বাধা অপসারণ করে, তাহলে আমরা ট্যারিফ হ্রাসের ব্যাপারে পুনঃবিবেচনা করতে পারি।”

তবে, তিনি সতর্ক করে দিয়েছেন যে, যদি এই দেশগুলো পাল্টা শুল্ক আরোপ করে বা কোনো বাণিজ্যিক শর্ত ভঙ্গ করে, তাহলে আরও কঠোর ট্যারিফ আরোপ করা হবে। “যতদিন পর্যন্ত এই দেশগুলো তাদের বাণিজ্য নীতি পরিবর্তন না করবে, ততদিন আমাদের সম্পর্কের প্রতি এই ট্যারিফগুলির প্রভাব অব্যাহত থাকবে,” ট্রাম্প চিঠিতে উল্লেখ করেছেন।

এ ঘোষণা শেয়ারবাজারে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। মার্কিন স্টক মার্কেটের প্রধান সূচক এসএন্ডপি ৫০০ ০.৮% কমে গেছে এবং নাসডাক সূচক ০.৯% পতিত হয়েছে। তবে এশিয়ার বাজারগুলো, বিশেষত হংকং, দক্ষিণ কোরিয়া এবং জাপানের শেয়ারবাজার, এই ট্যারিফ সংকটকে কিছুটা উপেক্ষা করেছে এবং সূচকগুলো সামান্য ইতিবাচক প্রবৃদ্ধি দেখিয়েছে।

এশীয় বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন যে, এই বাণিজ্য যুদ্ধের ফলে অনেক ছোট দেশের জন্য অর্থনৈতিক চাপ আরও বাড়বে। বিশেষত, ছোট বাজারসম্পন্ন দেশগুলো, যাদের কাছে বাণিজ্যিক সমঝোতার শক্তি কম, তারা এই পদক্ষেপের বিরুদ্ধে পাল্টা ব্যবস্থা নিতে পারবে না। তাই তারা বাধ্য হয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সমঝোতা করতে চলেছে।

জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিগেরু ইশিবা এই সিদ্ধান্তকে “অত্যন্ত দুঃখজনক” বলে অভিহিত করেছেন এবং জানিয়েছেন যে, তার দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আরও আলোচনা চালিয়ে যাবে যাতে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্ক সুসম্পন্ন করা যায়। দক্ষিণ কোরিয়া এবং মালয়েশিয়া তাদের সরকারের তরফ থেকে একই ধরনের বক্তব্য দিয়েছে। দক্ষিণ কোরিয়া জানিয়েছে, তারা ১ আগস্টের আগেই একটি উপকারী সমঝোতায় পৌঁছানোর জন্য তৎপর থাকবে।

মালয়েশিয়ার বাণিজ্য মন্ত্রণালয় জানায়, তারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একটি “ব্যালান্সড, পারস্পরিক উপকারী এবং সামগ্রিক বাণিজ্য চুক্তি” করতে আগ্রহী।

এদিকে, অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, এই পদক্ষেপের পরবর্তীকালে বিশ্ব বাণিজ্য ব্যবস্থায় এক দীর্ঘস্থায়ী অস্থিরতা আসতে পারে। সিংগাপুরের জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি ও বাণিজ্য বিভাগের পরিচালক লরেন্স লো বলেন, “এশীয় দেশগুলো, বিশেষত অল্প শক্তিশালী দেশগুলো, এককভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সমঝোতা করতে বাধ্য হবে। তাদের সম্মিলিত প্রতিরোধ সম্ভব নয়।”

এছাড়া, কুয়ালালামপুরে অবস্থিত আন্তর্জাতিক কৌশল ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ইনস্টিটিউটের অর্থনীতি ও বাণিজ্য বিষয়ক পরিচালক ক্যালভিন চেং বলেন, “আমার মতে, এই ট্যারিফগুলো এখন আর সিঙ্গেল ডিজিটে হ্রাস পাবে না। এসব ট্যারিফ বহাল থাকবে এবং ভবিষ্যতে আরও কঠোর হতে পারে।”

এখন পর্যন্ত, চীন, ভিয়েতনাম এবং যুক্তরাজ্য ছাড়া অন্য কোনো দেশ ট্রাম্পের সঙ্গে বাণিজ্যিক উত্তেজনা কমানোর জন্য চুক্তি করেনি। তবে, মার্কিন অর্থমন্ত্রী স্কট বেসেন্ট আশ্বস্ত করেছেন যে, আগামী ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে আরও কয়েকটি দেশের সঙ্গে সমঝোতার ঘোষণা আসতে পারে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই ট্যারিফের দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব আরও তীব্র হতে পারে এবং এতে বিশ্বব্যাপী বাণিজ্য ও অর্থনীতির উপর ব্যাপক প্রভাব পড়বে। তবে, যেকোনো ধরনের শান্তিপূর্ণ সমঝোতা ছাড়া, এই বাণিজ্যিক উত্তেজনা কমবে না।