নিজস্ব প্রতিনিধি, আগরতলা, ২৮ জানুয়ারি৷৷ মুক্তি যোদ্ধাদের পরমমিত্র ডা. রথীন দত্তের প্রয়াণে শোক প্রকাশ করেছে আগরতলাস্থিত বাংলাদেশ সহকারী হাইকমিশন৷ তেমনি, প্রথিতযশা চিকিৎসককে চিকিৎসাজগত ছাড়াও ক্রীড়া ব্যক্তিত্ব হিসেবে জনপ্রিয়তার তথ্য তুলে ধরেছেন জনৈক ক্রীড়া ব্যক্তিত্ব বিমল রায় চৌধুরী৷ তাছাড়া তাঁর কর্মজীবনে সংঘটিত একের পর এক কঠিন পরিস্থিতির তথ্য তুলে ধরেছেন বিশিষ্ট শল্য চিকিৎসক ডা. সুরজিৎ দাস৷ ডা. দাস দীর্ঘ ১৪ বছর প্রয়াত ডা. রথীন দত্তের সঙ্গে কাজ করেছেন৷
মঙ্গলবার আগরতলায় অবস্থিত বাংলাদেশ সহকারী হাইকমিশন প্রথিতযশা শল্য চিকিৎসক ডা. রথীন দত্তের প্রয়াণে শোক প্রকাশ করেছে৷ বাংলাদেশ সহকারী হাইকমিশনের প্রথম সচিব তথা দূতালয়-প্রধান মহম্মদ জাকির হুসেন ভুঞা এক শোকবার্তায় বলেছেন, ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় ডা. রথীন দত্ত আগরতলার জিবি হাসপাতালে কর্মরত ছিলেন৷ সে সময় শত শত আহত মুক্তিযোদ্ধার চিকিৎসা পরিষেবা দিয়ে বাঁচিয়ে তুলেছিলেন তিনি৷ মুক্তিযোদ্ধাদের পাশাপাশি তিনি বহু সাধারণ মানুষেরও প্রাণ তিনি বাঁচিয়েছেন৷ জাকির হুসেন বলেন, ওই সময় প্রয়াত ডা. দত্ত দিনরাত অক্লান্ত পরিশ্রম করে চিকিৎসা পরিষেবা অব্যাহত রেখেছিলেন৷ তাঁর ওই অসামান্য স্বীকৃতিস্বরূপ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার ২০১২ সালে তাঁকে মুক্তিযুদ্ধের মৈত্রী সম্মাননা প্রদান করেছে৷ তিনি আরও বলেন, প্রয়াত ডা. দত্তের বিশাল অবদানের কথা বহু মুক্তিযোদ্ধার স্মৃতিকথায় উল্লেখ রয়েছে৷
এদিন আগরতলাস্থিত বাংলাদেশ হাইকমিশনের সহকারী হাইকমিশনার কিরীটী চাকমা, প্রথম সচিব ও দূতালয় প্রধান মহম্মদ জাকির হুসেন ভুঞা, প্রথম সচিব স্থানীয় এস এম আসাদুজ্জামান এবং এই মিশনের সকল কর্মকর্তা ও কর্মচারী ডা. রথীন দত্তের প্রয়াণে গভীর শোক প্রকাশ করে তাঁর বিদেহি আত্মার সদগতি কামনা করেছেন৷ পাশাপাশি তাঁর শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর আন্তরিক সমবেদনাও জ্ঞাপন করেছেন তাঁরা৷
আগরতলার জনৈক ক্রীড়া ব্যক্তিত্ব বিমল রায়চৌধুরী প্রয়াত ডা. রথীন দত্তকে চিকিৎসকের তুলনায় ক্রীড়া ব্যক্তিত্ব হিসেবে অধিক জনপ্রিয় ছিলেন বলে দাবি করেছেন৷ তিনি বলেন, প্রয়াত ডা. দত্ত ভীষণ ক্রীড়াপ্রেমী ছিলেন৷ ১৯৬৬ সালে বিশ্বকাপ ফুটবল ম্যাচ দেখার জন্য তিনি গাড়ি বিক্রি করে টিকিট কিনেছিলেন৷ ত্রিপুরায় থাকাকালীন তিনি ক্রীড়াজগতের সাথে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে পড়েছিলেন৷ বিমলবাবু জানান, প্রয়াত ডা. দত্ত ত্রিপুরা স্পোর্টস মেডিসিনের সদস্য ছিলেন৷ এছাড়াও বিভিন্ন ক্রীড়া সংগঠনের সাথে তাঁর আত্মার সম্পর্ক ছিল৷ ক্রীড়া ব্যক্তিত্বরাও তাঁকে ভীষণ আপন করে নিয়েছিলেন৷ তাই তাঁর প্রয়াণে ক্রীড়াজগত এক উজ্জ্বল নক্ষত্রকে হারিয়েছে বলে মনে করেন তিনি৷
এদিকে ডা. রথীন দত্তের প্রয়াণে আক্ষরিক অর্থে একজন অভিভাবক হারালেন বলে শোক ব্যক্ত করেছেন প্রয়াতের অন্যতম সহযোদ্ধা ডা. সুরজিৎ দাস৷ আজ তিনি কর্মজীবনে প্রয়াত প্রথিতযশা চিকিৎসকের সঙ্গে কাজ করার নানা অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিয়েছেন ডা. দাস৷ তিনি বলেন, কঠিন পরিস্থিতি খুব সহজে মোকাবিলা করার ক্ষমতা রাখতেন ডা. দত্ত৷ সে-কথা অকপটে স্বীকার করে ডা. সুরজিৎ বলেন, সময়ানুবর্তিতা ডা. দত্তের জীবনে প্রাধান্য ছিল৷ কারণ, তিনি বিশ্বাস করতেন রোগীর চিকিৎসায় একমিনিট দেরি করা মোটেও উচিত নয়৷ তাই তিনি সময়ের আগেই হাসপাতালে পৌঁছে যেতেন৷ শুধু তা-ই নয়, নিজের চোখে দেখেছেন, রাত জেগে দিনের পর দিন জটিল রোগীর চিকিৎসা করেছেন প্রয়াত স্যার৷ ডা. দাস বলেন, সেবামূলক মানসিকতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হচ্ছেন ডা. রথীন দত্ত৷
ডা. দাসের কথায়, তৎকালীন সময়ে উন্নত চিকিৎসা পরিকাঠামো ছাড়া বহু জটিল রোগের চিকিৎসা করে খ্যাতির দৃষ্টান্ত রয়েছে ডা. রথীন দত্তের৷ ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় একটানা ৭২ ঘণ্টা হাসপাতালে অবস্থান করে রোগীর চিকিৎসা করেছেন তিনি৷ শত শত রোগী তাঁর চিকিৎসায় সুস্থ হয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে গেছেন৷ তেমনি এক দৃষ্টান্ত তুলে ধরে ডা. দাস জানিয়েছেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় জনৈক বাংলাদেশি মহিলার চিকিৎসা করেছিলেন প্রয়াত ডা. দত্ত৷ তাঁর গোপনাঙ্গে মারাত্মক আঘাত লেগেছিল৷ ডা. দত্তের চিকিৎসায় ওই মহিলা সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে গেছেন৷
২০১২ সালে বাংলাদেশ সরকারের সম্মাননা গ্রহণ করতে গেলে ওই মহিলা সশরীরে অনুষ্ঠানস্থলে গিয়ে সশ্রদ্ধ প্রণাম জানিয়েছেন৷ মহিলাটি তাঁকে মনে করিয়ে দিয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধের সময় তাঁর চিকিৎসায় তিনি সুস্থ হয়েছিলেন৷ আজ স্বামী-সন্তান নিয়ে সুখের সংসার করতে পারছেন তাঁর দৌলতে৷ ডা. সুরজিৎ বলেন, এ-তো নেহাত কম, এ ধরনের হাজারো ঘটনার কাণ্ডারি ছিলেন ডা. রথীন দত্ত৷ ত্রিপুরার চিকিৎসাক্ষেত্রে তাঁর নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে, বিশ্বাস করেন প্রয়াতের সহকর্মী ডা. দাস৷