উত্তর-পূর্ব ভারতের আদিবাসী সম্প্রদায়ের মধ্যে ম্যালেরিয়া যেন মহামারী, গবেষণা বাঙালি বিজ্ঞানীর

কলকাতা, ৮ নভেম্বর (হি. স.) :  গোটা দেশের থেকে সে অংশটা একেবারে অন্যরকম। রহস্যে মোড়া, অন্ধকারে ভরপুর, অন্যরকম সংস্কার, আদিবাসী অধ্যুষিত– সব মিলিয়ে দেশের উত্তর-পূর্ব প্রান্ত যেন আমাদের জানা-বোঝার বাইরের কোনও এক কুহকের মতো হয়ে রয়ে গিয়েছে। গবেষণা বলছে, দেশে যত মানুষ ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হন, তার একটা বড় অংশ এই উত্তর-পূর্বেরই আদিবাসী সম্প্রদায়ভুক্ত।
কিন্তু এর কারণ কী, কেনই বা ম্যালেরিয়া এই এলাকার আদিবাসীদের মধ্যে এমন জাঁকিয়ে বসেছে, তারই উত্তর খুঁজতে সুদীর্ঘ এক গবেষণায় সামিল হয়েছেন বাঙালি বিজ্ঞানী ডক্টর ঈপ্সিতা পালভৌমিক। ডিব্রুগড়ের রিজিওনাল মেডিক্যাল রিসার্চ সেন্টারের (আরএমআরসি) সঙ্গে যুক্ত এই গবেষক উপস্থিত হয়েছিলেন আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান উৎসবের মঞ্চে। উৎসবের চতুর্থ দিনে হেল্থ কনক্লেভের আসরে জানালেন উত্তর-পূর্বের ম্যালেরিয়া রোগের আশঙ্কাজনক অবস্থার কথা।

কেন্দ্রীয় সরকার জানিয়েছে, ২০৩০ সালের মধ্যে দেশ থেকে ম্যালেরিয়া দূরীকরণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। সেই উপলক্ষে জেলাভিত্তিক একাধিক পরিকল্পনাও তৈরি হয়েছে। কিন্তু ঈপ্সিতা বলছেন, “ম্যালেরিয়া একটি লোকাল এবং ফোকাল অসুখ। জায়গা বিশেষে এই অসুখের বিস্তার এবং তীব্রতা দুই-ই আলাদা। তাই একই ভাবে জেলাভিত্তিক চিকিৎসার চেয়েও বেশি জরুরি, নির্দিষ্ট এলাকায় ম্যালেরিয়া কেন হয় তার কারণ খোঁজা, ধরন বোঝা। তা হলে এই লড়াই আরও সহজ হবে।” তথ্য বলছে, সারা দেশে ম্যালেরিয়ায় ভুগে যত জন মারা যান, তার মধ্যে ২৫ শতাংশই উত্তর-পূর্ব ভারতের মানুষ। এবং গত ৩০ বছরের পরিসংখ্যান থেকে ঈপ্সিতা জানালেন, ৩০ বছর ধরে সামগ্রিক ভাবে এই রোগের প্রকোপ বেড়েই চলেছে উত্তর-পূর্বে। কিন্তু অদ্ভুত ভাবে, এই বৃদ্ধি কেবল আদিবাসী মানুষগুলির মধ্যেই সীমাবদ্ধ। যাঁরা আদিবাসী নন, তাঁদের সম্প্রদায়ে কিন্তু ম্যালেরিয়ার প্রকোপ কমেছে। শেষ দু’বছরের পরিসংখ্যানে এই বিভেদ আরও বেশি স্পষ্ট হয়। আক্রান্তদের মধ্যে ৯৯ শতাংশই আদিবাসী সম্প্রদায়ভুক্ত।

শুধু তাই নয়। ঈপ্সিতার তিন বছরের গবেষণা বলছে, এই এলাকায় ম্যালেরিয়া রোগের কারণ সুপরিচিত অ্যানোফিলিস মশা নয়। বাইমাই ও মিনিমাস নামের দুই অন্য প্রজাতির মশার আধিক্যই উত্তর-পূর্বের ম্যালেরিয়ার মূল কারণ। বাইমাই মশার বিশেষত্ব হল, এই মশা ঘুমোনোর আগে এবং ঘুম থেকে ওঠার পরে কামড়ায়। আধো অন্ধকারে। ফলে মশারি ব্যবহার করার দাওয়াই দিয়ে এই মশা আটকানো যায় না। আবার মিনিমাস মশার সমস্ত আচরণই অ্যানোফিলিসের থেকে আলাদা। মশা মারার সাধারণ স্প্রে বা ধূপ তাদের ক্ষেত্রে এতটুকু কার্যকর হয় না। উত্তর-পূর্বের সাধারণ আদিবাসী মানুষগুলির জীবনযাপনের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে কৃষিকাজ। এই কৃষির অন্যতম একটি ধরন হল, ঝুমচাষ। পাহাড়ের অনেকটা ওপরে কোনও প্রত্যন্ত বনাঞ্চলে গিয়ে, বনভূমি পুড়িয়ে সেখানে চাষ করা হয় বছরের কিছু নির্দিষ্ট সময়ে। ঈপ্সিতার গবেষণা বলছে, এই ঝুমচাষিদের মধ্যে ম্যালেরিয়ার প্রকোপ অত্যন্ত বেশি। কারণ, সপ্তাহের নির্দিষ্ট দিনে তাঁরা প্রত্যন্ত এলাকা থেকে পায়ে হেঁটে গ্রামে বা লোকালয়ে নেমে আসেন হাট-বাজার করতে। সেই দিনগুলোতে ভোরের আলো ফোটার আগেই বেরোন তাঁরা, আবার ফিরে যান সন্ধের মুখে। বেশির ভাগ সময়েই তাঁদের যাত্রাপথ ঘন জঙ্গলের ভিতর দিয়ে। আর সেই সময়েই বাইমাই মশার কামড় খান তাঁরা। অবধারিত ভাবে আক্রান্ত হন ম্যালেরিয়ায়।

বিভিন্ন এলাকায় এই ঝুমচাষিদের গতিবিধি বুঝে, তাঁদের হাটে আসার দিনক্ষণ মেপে মেডিক্যাল ক্যাম্পের আয়োজন করে আরএমআরসি। বিলি করা হয় মশা নিরোধক ক্রিম। কোন এলাকায় বেশি মানুষ ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছেন, তার একটা স্যাটেলাইট ম্যাপিংও করেছেব ঈপ্সিতা। সেই ম্যাপিং থেকেই স্পষ্ট, জঙ্গল এলাকায় যেখানে মানুষের বসতি, সেখানে ম্যালেরিয়ার প্রকোপ বেশি। আবার যে সব বসতি জঙ্গল থেকে দূরে, সেখানে ম্যালেরিয়ার প্রকোপও কম। ঈপ্সিতা জানালেন, সচেতনতার অভাবে অনেক সময়েই সঠিক চিকিৎসা হয় না প্রত্যন্ত এলাকার মানুষের। এ কারণে তাঁরা একটি অ্যাপ তৈরি করেছেন। স্থানীয় ভাষায়, ছবির মাধ্যমে সেখানে আপলোড করা যাবে নিজের অসুস্থতা সম্পর্কিত তথ্য। তা সরাসরি এসে পৌঁছবে আরএমআরসি-তে। এর ফলে কোথায় কত মানুষ কী ধরনের ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত, তার সম্যক ধারণা মিলছে আরও বিস্তারিত ভাবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *