রাজীব কুমারকে গ্রেফতার করতে গেলে প্রমাণ দিতে হবে : সুপ্রিম কোর্ট

কলকাতা, ৩০ এপ্রিল (হি.স): রাজীব কুমারকে গ্রেফতার করতে গেলে সিবিআইকে যথোপযুক্ত প্রমাণ দিতে হবে বলে মঙ্গলবার সাফ জানিয়ে দিল সুপ্রিম কোর্ট । আর সেই প্রমাণ আগামীকাল বুধবারই দিতে হবে বলে জানিয়ে দেয় প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈ, বিচারপতি দীপক গুপ্ত এবং বিচারপতি সঞ্জীব খন্নার ডিভিশন বেঞ্চ । সারদা কাণ্ডে তদন্তের জন্য কলকাতার প্রাক্তন পুলিশ কমিশনার রাজীব কুমারকে হেফাজতে নিয়ে জেরা করার জন্য মঙ্গলবার সকালে আবেদন জানায় সিবিআই । সেই আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে সুপ্রিম কোর্ট জানিয়ে দেয়, কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার পেশ করা প্রমাণে আদালত সন্তুষ্ট হলে তবেই কলকাতার প্রাক্তন পুলিশ কমিশনারকে গ্রেফতারের নির্দেশ নিয়ে ভাববে আদালত । বুধবার এই মামলার পরবর্তী শুনানি ।

মঙ্গলবার কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার পক্ষে সলিসিটর জেনারেল তুষার মেহতা আদালতে জানান, হেফাজতে নিয়ে রাজীব কুমারকে তাঁরা জেরা করতে চায় সিবিআই । তাঁর বিরুদ্ধে প্রমাণ লোপাট এবং জেরায় অসহযোগিতার অভিযোগ তোলেন সলিসিটর জেনারেল তুষার মেহেতা । আদালত এই দাবির স্বপক্ষে প্রমাণ দাখিলের নির্দেশ দেয় । সিবিআইয়ের তরফে বলা হয় বুধবার সমস্ত প্রমাণ তাঁরা দেবেন । বিচারপতি জানিয়েছেন, আগামীকাল, বুধবার সিবিআই সেই প্রমাণ দিলে ফের শুনানি হবে এই মামলার।

এদিনের শুনানিতে সিবিআইয়ের তরফে সলিসিটর জেনারেল তুষার মেহেতা আদালতে জানান, জেরায় দেবযানী মুখোপাধ্যায় জানিয়েছিলেন, সারদা সংস্থায় একটা ক্যাশবুকে হিসাব রাখা হত । তা ছাড়া একটা ডায়েরিও ছিল । কাকে কত টাকা দেওয়া হয়েছে তা সেটিতে লেখা ছিল । হয় সেই ক্যাশবুক বা ডায়েরি রাজ্য পুলিশের স্পেশাল ইনভেস্টিগেটিভ টিম বা এসআইটি বাজেয়াপ্ত করেনি । বা সেটি বাজেয়াপ্ত করলেও সিবিআইয়ের হাতে তুলে দেয়নি ।

বিচারপতিরা এদিন জানতে চান, বিধাননগরের প্রাক্তন গোয়েন্দা প্রধান অর্ণব ঘোষ কি কখনও বলেছেন যে রাজীব কুমারের নির্দেশেই তিনি যাবতীয় পদক্ষেপ করেছিলেন । অথবা কোনও তদন্তকারী অফিসার কি সে রকম কোনও জবানবন্দি দিয়েছেন । যা থেকে প্রমাণ করা যায় যে তথ্য প্রমাণ লোপাটের নেপথ্যে রাজীব কুমারের ডায়রেক্ট লিঙ্ক ছিল ।

এদিন শুনানির সময় প্রধান বিচারপতি বারবার বলেন, রাজীব কুমারকে হেফাজতে নেওয়ার অনুমতি আদালত দিতেই পারে । এটা কোনও বড় ব্যাপার নয়। কিন্তু রাজীবের বিরুদ্ধে অভিযোগ নিয়ে আদালতকে সন্তুষ্ট করতে হবে সিবিআইকে । তখন তুষার মেহতা বলেন, আজই এ ব্যাপারে সমস্ত তথ্য প্রমাণ আনার ব্যবস্থা করছি । কাল বুধবার আদালতে পেশ করা হবে । সার্চ ওয়ারেন্ট ছাড়াই কেন তৎকালীন কলকাতার নগরপাল রাজীব কুমারের বাড়িতে হানা দিয়েছিল সিবিআই, সে নিয়ে এদিন প্রশ্ন তোলে সুপ্রিম কোর্ট ।

আইনজীবীরা মনে করছেন, কাল তথ্য প্রমাণ নিয়ে ফের আর এক প্রস্ত সওয়াল করবে সিবিআই । তার পর বৃহস্পতিবার রাজ্য সরকার তথা রাজীব কুমারের আইনজীবীদের সওয়াল করার কথা । ফলে রায় ঘোষনার ডেট পরবে আরেক দিন ।

সারদা মামলায় রাজ্য সরকার যে স্পেশাল ইনভেস্টিগেশন টিম গঠন করেছিল, তার প্রধান ছিলেন তৎকালীন বিধাননগরের পুলিশ কমিশনার রাজীব কুমার । সিবিআইয়ের অভিযোগ, বহু নথি লোপাট হয়ে গেছে । ফোনের কল রেকর্ড বিকৃত করে দেওয়া হয়েছে সিবিআইয়ের হাতে । তাদের দাবি, এই জাল অনেক দূর পর্যন্ত বিস্তৃত । তা ছাড়া সুনির্দিষ্ট ভাবে রাজীব কুমারের বিরুদ্ধে সিবিআইয়ের অভিযোগ, শিলংয়ে জিজ্ঞাসাবাদের সময় অধিকাংশ প্রশ্নেরই জবাবই রাজীব কুমার এড়িয়ে গিয়েছেন । তিনি সহযোগিতা করেননি ।

তাই, গত ৬ এপ্রিল কলকাতার প্রাক্তন পুলিশ কমিশনারকে হেফাজতে চেয়ে সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করে সিবিআই । কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার অভিযোগ, তদন্তে সহযোগিতা করেননি রাজীব কুমার । এরপরই ৮ এপ্রিল নোটিশ পাঠিয়ে এই বিষয়ে রাজীব কুমারের জবাব তলব করে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির বেঞ্চ । সিবিআইয়ের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে গত ১৩ এপ্রিল আদালতে হলফনামা জমা দেন রাজীব কুমার । সিবিআই হলফনামা দিয়ে রাজীব কুমারকে গ্রেফতারের উপরে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করার আর্জি জানিয়েছিল সুপ্রিম কোর্টে । সেই আবেদনের প্রেক্ষিতে সুপ্রিম কোর্ট রাজ্য সরকারের তরফে প্রত্যুত্তর দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিল এক সপ্তাহের মধ্যে । প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈ এই নির্দেশ দিয়ে মন্তব্য করেছিলেন, ‘প্রয়োজনে গ্রেফতারির উপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হবে’।

গত ৩ ফেব্রুয়ারি সারদাকাণ্ডের তদন্তে রাজীব কুমারের বাসভবনে সিবিআই হানা ঘিরে তোলপাড় হয়েছিল রাজ্য রাজনীতি । রাজীব কুমারের লাউডন স্ট্রিটের বাংলোয় তাঁকে জেরা করতে গেলে সিবিআই আধিকারিকদের আটকে দেয় কলকাতা পুলিশ । তারপর সিবিআই অফিসারদের টেনে হিঁচড়ে শেক্সপিয়র সরণি থানায় নিয়ে যাওয়া হয় । মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজে পৌঁছে যান রাজীবকুমারের বাড়িতে । এরপর ধর্মতলায় ধরনায় বসেন রাজ্যের মুখমন্ত্রী । যে ঘটনার পরই মামলা গড়ায় সুপ্রিম কোর্টে । দেশের সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশে শিলংয়ে সিবিআইয়ের কাছে হাজিরা দেন কলকাতার তৎকালীন পুলিশ কমিশনার । টানা ৫ দিন ধরে রাজীবকুমারকে শিলংয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেছিল কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা ।

রাজ্য সরকারের এফিডেভিটে সারদা মামলার দিনপঞ্জি এবং ঘটনাপ্রবাহ বিস্তারিত উল্লেখ করে দাবি করা হয়েছে, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে রাজীব কুমারকে যথেষ্ট কার্যকারণ ছাড়াই ফাঁসাতে চাইছে সিবিআই। রাজীব কুমারের দাবি, সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ মেনে শিলংয়ে গিয়ে তিনি পাঁচদিন ৪০ ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে সিবিআইয়ের জেরার মুখোমুখি হয়েছেন । পুরো জিজ্ঞাসাবাদ পর্বের ভিডিও রেকর্ডিংও করা হয়েছে । তা দেখলেই বোঝা যাবে তদন্তকারীদের সঙ্গে সবরকমভাবে সহযোগিতা করেছেন তিনি । পাশাপাশি তিনি যখন বিধাননগরের পুলিশ কমিশনার তখন সারদা কাণ্ডের বৈদ্যুতিন তথ্যপ্রমাণের ফরেনসিক অডিটের জন্য বিধাননগর থানাই সেবিকে অনুরোধ জানিয়েছিল । সুপ্রিম কোর্টে জমা দেওয়া হলফনামায় রাজীব আরও প্রশ্ন তুলেছেন, কোনও কিছু গোপন করার ইচ্ছে থাকলে, সেবিকে কি অডিটের অনুরোধ করা হত ? সারদাকাণ্ডের বিভিন্ন তথ্যপ্রমাণ থানায় জমা ছিল । একজন আইপিএস অফিসারের পক্ষে কি সেখান থেকে তথ্য বিকৃত করা সম্ভব ? তদন্তকারী অফিসারদের কথা শুনলেই তো সিবিআই সব জানতে পারবে । তথ্যপ্রমাণ নষ্ট করা হয়েছে বলে মনে করলে সিবিআই কেন আগেই নিম্ন আদালতে যায়নি ? তাঁর অভিযোগ, সিবিআইয়ের হলফনামার বয়ান বারবার পালটে যাওয়ার ঘটনাই প্রমাণ করছে উদ্দেশ্য প্রণোদিত ভাবে কাজ করছে সিবিআই । এই অভিযোগের সমর্থনে নাকি মুকুল রায় ও কৈলাশ বিজয়বর্গীয়র কথোপকথনের রেকর্ডিং ফাঁস হওয়ার কথাও হলফনামায় বলেছেন রাজীব কুমার । শিলংয়ে তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করার ভিডিও পেশ করুক সিবিআই, এই আবেদনও সর্বোচ্চ আদালতে জানান রাজীব কুমার । পাশাপাশি, সিবিআই শিলংয়ে তাঁর যে বয়ান নথিবদ্ধ করেছে, তাও তাঁর হাতে তুলে দেওয়ার আর্জি জানান রাজীব কুমার ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *