কলকাতায় ভয়াবহ রাতভর বৃষ্টিতে মৃত্যু অন্তত ৯ জনের, জলমগ্ন শহরকে ঘিরে বিজেপি-তৃণমূল রাজনৈতিক তীব্রতা চরমে

কলকাতা, ২৩ সেপ্টেম্বর : কলকাতায় সোমবার গভীর রাতে শুরু হওয়া অতি ভারী বৃষ্টিপাত শহরের স্বাভাবিক জীবনযাত্রাকে সম্পূর্ণরূপে স্তব্ধ করে দিয়েছে। মাত্র তিন ঘণ্টায় রেকর্ড ১৮৫ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়, যা সাম্প্রতিক ইতিহাসে অন্যতম ভয়াবহ বলে জানিয়েছে আলিপুর আবহাওয়া দফতর। এই হঠাৎ এবং বিপুল পরিমাণ বৃষ্টিতে শহরের রাস্তাঘাট, গলিপথ, বাসস্টপ, পুজোর প্যান্ডেল, এমনকি হাসপাতাল ও বিমানবন্দর পর্যন্ত জলমগ্ন হয়ে পড়ে। বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে পাঁচজন সহ অন্তত নয়জনের মৃত্যু হয় বলে প্রশাসন নিশ্চিত করেছে। শহরের মেট্রো পরিষেবা ব্যাহত হয়—ময়দান থেকে শহিদ খুদিরাম স্টেশনের মধ্যবর্তী অংশে মেট্রো চলাচল সাময়িকভাবে বন্ধ হয়ে যায়, যখন রেললাইনে জল উঠে যায়। বিমানবন্দরেও পরিষেবা বিপর্যস্ত হয়—৩০টির বেশি বিমান বাতিল এবং ৫০টিরও বেশি বিমানের সময়সূচি বিঘ্নিত হয়। একাধিক জায়গায় পুজোর প্যান্ডেল জলমগ্ন হয়ে পড়ে, পুজোর ঠিক আগেই এমন পরিস্থিতিতে শহরের উৎসবমুখর পরিবেশে তীব্র প্রভাব পড়ে।

এই ভয়াবহ পরিস্থিতিকে কেন্দ্র করে রাজ্য রাজনীতিতে তীব্র উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছে। বিজেপি অভিযোগ করেছে, এই বিপর্যয় প্রকৃত অর্থে ‘মানবসৃষ্ট’, এবং তৃণমূল পরিচালিত কলকাতা পুরসভার দুর্নীতি ও প্রশাসনিক ব্যর্থতার ফলেই শহর ডুবে গেছে। বিজেপির আইটি সেলের প্রধান অমিত মালব্য একাধিক টুইটে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও কলকাতার মেয়র ফিরহাদ হাকিমকে সরাসরি আক্রমণ করে লেখেন, “এটা প্রাকৃতিক দুর্যোগ নয়, এটা একটি ‘টিএমসি-র তৈরি বিপর্যয়’। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও ফিরহাদ হাকিমের অপরাধমূলক অবহেলা ও দুর্নীতির ফলেই এই বিপর্যয়।” তিনি দাবি করেন, আলিপুর আবহাওয়া দফতর এক মাস আগেই সতর্ক করেছিল যে দুর্গাপুজোর সময় প্রবল বর্ষণ হতে পারে, কিন্তু রাজ্য সরকার কোনো প্রস্তুতি নেয়নি। তাঁর অভিযোগ, “শহরের নিকাশি ব্যবস্থা বছরের পর বছর সংস্কার হয়নি, বরং দুর্নীতির মাধ্যমে অর্থ আত্মসাৎ হয়েছে। অবৈধ নির্মাণ, পুকুর ভরাট, সবুজ জমি ধ্বংস এবং বেআইনি কলোনি তৈরির ফলে শহর তার প্রাকৃতিক জলধারণ ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে।” তিনি আরও বলেন, “জল বেরোনোর পথ বন্ধ হয়ে গেছে, আর তৃণমূলের ‘কাটমানি নির্ভর উন্নয়ন’ এই বিপর্যয়ের মূল কারণ।”

বিজেপির রাজ্য সভাপতি ও বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীও এই ঘটনাকে ‘শহরের প্রতি অপরাধ’ বলে চিহ্নিত করেছেন। তিনি এক ভিডিও শেয়ার করে দাবি করেন, “জলমগ্ন রাস্তায় দেহ ভেসে বেড়াচ্ছে। এই ছবি দেখলেই বোঝা যায় প্রশাসন কতটা ব্যর্থ।” তিনি বলেন, “আজকের দিনে প্রযুক্তির সাহায্যে বৃষ্টির পূর্বাভাস পাওয়া যায়, তবু কেন বারবার একই ছবি দেখা যায়? প্রশাসন কিছুই শেখেনি।” বিজেপির আরও অভিযোগ, শহরের গুরুত্বপূর্ণ অংশ যেমন মানিকতলা ও সায়েন্স সিটি এলাকার মতো ‘অ্যাক্লেমড’ এলাকাও জলমগ্ন—এই অবস্থায় কেউ কি শহরকে বিনিয়োগের উপযুক্ত বলে ভাবতে পারে? দলের দাবি, “এটা শুধুই পরিকাঠামোর ব্যর্থতা নয়, এটা নাগরিক অধিকার হরণ, এবং প্রশাসনিক দুর্নীতির জ্বলন্ত প্রমাণ।”

অন্যদিকে, তৃণমূল কংগ্রেস বিজেপির এই অভিযোগকে সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন বলে দাবি করেছে। রাজ্যের মন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য এক টুইটে লেখেন, “গতকাল কলকাতায় প্রায় ৩০০ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে—এটা একটি বিরল ক্লাউডবার্স্ট। এমন পরিস্থিতি হলে বিশ্বের যে কোনও শহরই বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। মুম্বই ২০০৫, চেন্নাই ২০১৫ কিংবা দিল্লি ২০২৩—কোনও শহরই এই ধরণের অপ্রত্যাশিত দুর্যোগ থেকে রক্ষা পায় না।” তিনি অভিযোগ করেন, “বিজেপি জলবায়ু পরিবর্তনের বাস্তবতা ও বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণকে অস্বীকার করে শুধুমাত্র মানুষের যন্ত্রণাকে রাজনৈতিক হাতিয়ার করছে। এটা দুঃখজনক।” তিনি আরও বলেন, “মানুষ বোঝে প্রকৃত বিপর্যয় কী এবং রাজনৈতিক প্রপাগান্ডা কী।”

এর মধ্যেই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাদের সব পরীক্ষা স্থগিত করেছে এবং ২৩-২৪ সেপ্টেম্বর সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখার ঘোষণা করা হয়েছে। ইন্ডিগো-সহ একাধিক বিমান সংস্থা যাত্রীদের সতর্ক করে বলেছে, অতিরিক্ত সময় হাতে নিয়ে বেরোতে, এবং বিমানবন্দরের পরিস্থিতি সম্পর্কে ওয়েবসাইট বা অ্যাপ থেকে তথ্য সংগ্রহ করতে। আলিপুর আবহাওয়া দফতর জানিয়েছে, বঙ্গোপসাগরের ওপর একটি নিম্নচাপ তৈরি হয়েছে, এবং ২৫ সেপ্টেম্বরের মধ্যে আরও একটি নিম্নচাপ সৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে, যার ফলে দক্ষিণবঙ্গের একাধিক জেলায় আরও বৃষ্টি হতে পারে।

এই পরিস্থিতিতে শহরের সাধারণ মানুষ একদিকে যেমন জলমগ্ন জীবনে বিপর্যস্ত, অন্যদিকে রাজনৈতিক দোষারোপের খেলায় বিভ্রান্তও বটে। প্রশ্ন উঠছে—একটা মেট্রোপলিটন শহর মাত্র এক রাতের বৃষ্টিতেই এতটাই ভেঙে পড়তে পারে কীভাবে? দায় প্রকৃতির, নাকি প্রশাসনের? আর তার চেয়েও বড় প্রশ্ন—এই পরিস্থিতির কি কোনও দীর্ঘমেয়াদি সমাধান আদৌ আছে, নাকি বর্ষাকালে জলাবদ্ধতা কলকাতার স্থায়ী নিয়তি হয়ে উঠবে?