বিশিষ্ট নাট্যকার ও থিয়েটার ব্যক্তিত্ব রতন থিয়াম প্রয়াত

ইম্ফল, ২৩ জুলাই : ভারতের প্রখ্যাত নাট্যকার, নাট্য নির্দেশক এবং থিয়েটার জগতের অন্যতম পথিকৃত রতন থিয়াম আজ বুধবার ভোররাতে মণিপুরের ইম্ফলে অবস্থিত রিজিওনাল ইনস্টিটিউট অফ মেডিক্যাল সায়েন্সেস -এ শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৭ বছর। দীর্ঘদিন ধরে তিনি অসুস্থ ছিলেন বলে হাসপাতাল সূত্রে জানানো হয়েছে।

রতন থিয়ামের মৃত্যুতে শোকস্তব্ধ মণিপুরসহ সমগ্র ভারতবর্ষের শিল্প-সংস্কৃতি মহল। মণিপুর সরকার ২০২৫ সালে তাঁকে রাজ্যের সর্বোচ্চ সংস্কৃতি সম্মান লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্ট অ্যাওয়ার্ড প্রদান করে সম্মানিত করেছিল। এই সম্মানের অন্তর্ভুক্ত ছিল একটি মানপত্র, একটি উত্তরীয় এবং ₹১০ লক্ষ টাকার চেক।

১৯৪৮ সালের ২০ জানুয়ারি পশ্চিমবঙ্গের নদিয়া জেলার নবদ্বীপে জন্মগ্রহণ করেন রতন থিয়াম। পরে পরিবারসহ তিনি ইম্ফলের হাওবাম দেওয়ান লেন-এ বসবাস শুরু করেন। তাঁর পিতা গুরু থিয়াম তরুণকুমার ছিলেন মণিপুরি শাস্ত্রীয় নৃত্যের এক বিশিষ্ট গুরু এবং মাতা বিলাসিনী দেবী নিজেও ছিলেন নামকরা নৃত্যশিল্পী।

ছেলেবেলা থেকেই শিল্প-সংস্কৃতির পরিবেশে বড় হওয়া রতন থিয়াম ন্যাশনাল স্কুল অফ ড্রামা থেকে নাট্যকলায় স্নাতক হন এবং পরবর্তীতে ভারতের থিয়েটার আন্দোলনের অন্যতম প্রধান ব্যক্তিত্ব হয়ে ওঠেন। তাঁর কাজ ছিল বহুমাত্রিক—নাট্যরচনা, নির্দেশনা, সঙ্গীত সৃষ্টির পাশাপাশি তিনি ছিলেন আলো ও পোশাক পরিকল্পনায় পারদর্শী, স্থপতি, কবি ও চিত্রশিল্পীও।

১৯৭০-এর দশকে শুরু হওয়া ভারতের “থিয়েটার অব রুটস” আন্দোলনের অন্যতম অগ্রদূত ছিলেন রতন থিয়াম। এই আন্দোলনের মাধ্যমে তিনি প্রাচীন ভারতীয় নাট্যরীতিকে আধুনিক প্রসঙ্গের সঙ্গে মেলাতে শুরু করেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য নাটক চক্রব্যূহ ও ঋতুসংহারম প্রাচীন ও সমকালীন ভাবনার এক অপূর্ব মেলবন্ধন তুলে ধরে বিশ্বমঞ্চে প্রশংসিত হয়।

তিনি ১৯৮৭ সালে সংগীত নাটক আকাদেমি পুরস্কার এবং ১৯৮৯ সালে পদ্মশ্রী সম্মানে ভূষিত হন। পরবর্তীতে তিনি ন্যাশনাল স্কুল অফ ড্রামা-র পরিচালক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন এবং সংগীত নাটক আকাদেমি-র উপ-সভাপতির পদ অলঙ্কৃত করেন।

মণিপুরের রাজ্যপাল অজয় কুমার ভল্লা এবং প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী এন. বীরেন সিং-সহ বহু সামাজিক ও রাজনৈতিক নেতা রতন থিয়ামের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। মুখ্যমন্ত্রী বীরেন সিং বলেন, “রতন থিয়াম শুধু একজন নাট্যকার ছিলেন না, তিনি মণিপুরের আত্মার প্রতিধ্বনি ছিলেন। তাঁর কাজ আমাদের সংস্কৃতিকে বিশ্বমঞ্চে পরিচিত করেছে।”

মণিপুর বিজেপি-র রাজ্য সভাপতি অধিকারিময়ুম শারদা দেবী বলেন, “তিনি ছিলেন এমন এক কিংবদন্তি যিনি এনএসডি-এর পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করা উত্তর-পূর্ব ভারতের একমাত্র শিল্পী।” তিনি আরও জানান, থিয়ামের অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।

নাগাল্যান্ড বিজেপি নেতা এমমোনলুমো কিকন রতন থিয়ামকে ভারতের “ইউজিন ইয়োনেস্কো” বলে অভিহিত করে বলেন, “তাঁর রেখে যাওয়া থিয়েটারের ঐতিহ্য পূরণ করা প্রায় অসম্ভব।”

শিল্পী, সাহিত্যিক, থিয়েটার কর্মী থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষও এই মহীরুহের প্রয়াণে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। থিয়ামের মৃত্যুতে শুধু মণিপুর নয়, গোটা দেশ হারাল এক অমূল্য সাংস্কৃতিক সম্পদকে।

রতন থিয়াম-এর জীবন ও কর্ম ভারতের নাট্যচর্চাকে যেভাবে সমৃদ্ধ করেছে, তা চিরকাল দেশ ও বিশ্বের মঞ্চে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করা হবে।