শিশু সুরক্ষায় আইন আছে, হইচই আছে, কাজ হচ্ছে কতটাv

কলকাতা, ১১ এপ্রিল (হি. স.) : পকসো-র মামলার তদন্তকে নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের দুটি স্থানে কেন্দ্রীয় শিশু সুরক্ষা কমিশন এবং রাজ্য শিশু সুরক্ষা কমিশনের দুই শীর্ষব্যক্তির মধ্যে সম্প্রতি প্রকাশ্য বাদানুবাদ হল। তার জের গড়িয়েছে দিল্লি পর্যন্ত। কিন্তু কতটা আশার আলো দেখাতে পারছে পশ্চিমবঙ্গের শিশু সুরক্ষা কমিশনের কাজকর্ম। অন্যান্য রাজ্যের ছবিটাই বা কিরকম?

যৌন অপরাধ থেকে শিশুদের কঠোর সুরক্ষার জন্য ২০১২ সালে প্রণীত হয় ‘দি প্রোটেকশন অফ চিলড্রেন ফ্রম সেক্সুয়াল অফেন্সার্স অ্যাক্ট’ (পকসো)। ভারতে সর্বোচ্চ বিচারাধীন মামলার তালিকায় তৃতীয় স্থানে রয়েছে পশ্চিমবঙ্গ। শিশুদের বিরুদ্ধে জঘন্য অপরাধের সাজার হারের নিরিখে পশ্চিমবঙ্গের অবস্থান ২০-তম স্থানে। ভারতের রাজ্যভিত্তিক গড়ের চেয়েও কম।

যৌন নিপীড়িত একটি শিশুকে আদালতের কার্যক্রমের আরও হয়রানি থেকে রক্ষা করার জন্য রচিত হয়েছে পকসো আইন। সংশোধনীতে বলা হয়, সারা দেশে এই উদ্দেশ্যে বিশেষভাবে স্থাপিত বিশেষ ফাস্ট-ট্র্যাক আদালতে (এফটিসি) নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে সমস্ত বিচার সম্পন্ন করার চেষ্টা হবে। প্রতিটি জেলায় অন্তত একটি বিশেষ আদালত থাকা আবশ্যিক। এক বছরের মধ্যে বিচার সম্পন্ন করতে হবে।

২০১৬ সাল থেকে পকসো মামলা বকেয়া থাকা ১৭০% বেড়েছে। ২০১৬-র ডিসেম্বর পর্যন্ত ছিল ৯০,২০৫টি মামলা। ২০২৩-র জানুয়ারীতে

vবেড়ে ২,৪৩,২৩৭টি মামলা হয়েছে। দেশের সবচেয়ে জনবহুল রাজ্য উত্তরপ্রদেশে ৬৭,২০০টি পকসো-র বিচারাধীন মামলা রয়েছে। এটি সমস্ত রাজ্যের মধ্যে সর্বোচ্চ। এখানে রয়েছে পকসো আইনের অধীনে দায়ের করা সমস্ত মুলতুবি মামলার প্রায় ২৮%।
এই অবস্থায় নারী ও শিশুদের বিরুদ্ধে যৌন অপরাধ সংক্রান্ত মামলার দ্রুত নিষ্পত্তি নিশ্চিত করার জন্য, ১৭৩ (১ক) এবং ৩০৯ ধারার ধারার গুরুত্ব আরোপের কথা বলা হয়েছে। সম্প্রতি সমাপ্ত বাজেট অধিবেশনে একটি প্রশ্নের জবাবে আইনমন্ত্রী কিরেন রিজিজু সংসদকে জানিয়েছেন ২০১৮-র ফৌজদারি (সংশোধন) আইনের মাধ্যমে প্রতিটি তদন্ত ও বিচারের জন্য দুই মাসের সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে।
উত্তরপ্রদেশের পরেই মহারাষ্ট্রে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পকসো ৩৩,০০০টি বিচারাধীন মামলা রয়েছে। এর পরে পশ্চিমবঙ্গে রয়েছে ২২,১০০টি; বিহার ১৬,০০০; ওড়িশায় ১২,০০০ এবং তেলেঙ্গানা এবং মধ্যপ্রদেশে ১০,০০০ টি মামলা রয়েছে। শীর্ষ ১৩টি রাজ্যের মধ্যে যেখানে মামলার সংখ্যা বেশি, রয়েছে দিল্লি (৯,১০৮টি বিচারাধীন মামলা সহ), রাজস্থান (৮,৯২১), আসাম (৬,৮৭৫), হরিয়ানা (৪,৬৮৮) এবং ঝাড়খণ্ড (৪,৪০৮)।
পকসো এবং ধর্ষণের মামলা মোকাবিলা করার জন্য কেন্দ্রীয় অর্থায়নে গোটা দেশে ৭৬৪টি বিশেষ এফটিসি রয়েছে, যার মধ্যে ৪১১টি বিশেষ এফটিসি বিশেষভাবে পকসো আইনের মামলাগুলির জন্য নিবেদিত। এসব আদালত বছরে ১.৪ লাখ মামলা নিষ্পত্তি করছে।
শিশু সুরক্ষা নিয়ে দীর্ঘকাল ধরে সক্রিয় সত্যগোপাল দে। তিনি জানান, যতটা জানি পশ্চিমবঙ্গে ২০১৪ সালে ২ য় অতিরিক্ত জেলা বিচারকের আদালতকে পকসো আদালত হিসেবে চিহ্ণিত করা হয়। এ রাজ্যে প্রত্যেক জেলায় ১ টি করে এ রকম আদালত আছে।
২০২০-র ৬ মার্চ লোকসভায় ২৬২৭ নম্বর প্রশ্নের দাখিল করা রাজ্যওয়ারি তালিকায় পকসো-র মামলায় সাজার হারের নিরিখে পশ্চিমবঙ্গের অবস্থান ২০-তম স্থানে। যেখানে ভারতের রাজ্যভিত্তিক গড় ৩৪.২, পশ্চিমবঙ্গের হার ২৮.৯।
শিশু সুরক্ষা কমিশনের চেয়ারপার্সন সুদেষ্ণা রায় এই প্রতিবেদককে বলেন, “আমরা যতটা সম্ভব ততটাই চেষ্টা করছি। আসলে এত বেশি মামলা রুজু হচ্ছে যে সেগুলো বিচার করার মত পর্যাপ্ত পরিকাঠামো নেই। রাজ্যে বেশ কয়েকটি বিশেষ আদালত হয়েছে। তবে আরও দরকার। সরকার নিশ্চয়ই বিবেচনা করবেন। এ রাজ্যে পকসো ও নারী নির্যাতনের অভিযোগ বেশি সওয়ার একটা কারণ সচেতনতা। এবং পুলিশ অভিযোগ লিপিবদ্ধ করে। আগে পকসো-র এত অভিযোগ নথিভূক্ত হত না।“
এ রাজ্যের ক্ষেত্রে সমস্যাটা কোথায়? কী করলে উন্নতি হতে পারে? নিষ্ঠাবান শিশু অধিকার-কর্মী সত্যগোপালবাবুর মতে, “শুধু মামলার প্রেক্ষাপটে দেখলে চলবে না। বকেয়া মামলা কমাতে হলে কোনও আদালতকে অতিরিক্ত দায়িত্ব দিয়ে পকসো আদালত না করে নির্ধারিত আদালত করা দরকার। দেশের অধিকংশ রাজ্যে ডেডিকেটেড পকসো আদালত নেই। কারন এর জন্য যে বাজেট দরকার তার ব্যবস্থা নেই। এ বছর মোট বাজেটের ২.৩০ শতাংশ শিশু খাতে নির্ধারিত যা ১১ বছরে সব থেকে কম। শুধু আদালত করলে হবে না, আদালত আইন অনুযায়ী শিশু বান্ধব হতে হবে।”
একই সুর বেড়িয়ে এসেছে কেন্দ্রীয় সমীক্ষায়। তাতে বলা হয়েছে, “নারী ও শিশুদের বিরুদ্ধে যৌন অপরাধের তদন্তের জন্য ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ সহ অতিরিক্ত পুলিশ সুপার এবং/অথবা পুলিশ কমিশনারের নেতৃত্বে একটি নিবেদিত ইউনিটের প্রয়োজন রয়েছে। ইউনিটটিতে পর্যাপ্ত জনবল, অবকাঠামো এবং সরঞ্জাম থাকা প্রয়োজন। যাতে এই মামলাগুলি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে এবং অগ্রাধিকার ভিত্তিতে তদন্ত করা হয়।
কেন্দ্রীয় সমীক্ষাও বলছে, বেশিরভাগ জেলায় নারী ও শিশুদের বিরুদ্ধে সংঘটিত যৌন অপরাধের তদন্তের জন্য নিবেদিত বিশেষ ইউনিট নেই। তাই, ভুক্তভোগীদের প্রতি সহানুভূতিশীল আচরণের জন্য একটি বিশেষ ইউনিটের প্রয়োজন রয়েছে। নারী ও শিশুরা যে আঘাতের সম্মুখীন হয় তা মোকাবেলা করার জন্য শিশুমনের ব্যাপারে প্রশিক্ষিত জনশক্তি প্রয়োজন।
২০১৯-এ বিচারের জন্য আদালতে পাঠানো মোট মামলার সংখ্যা ছিল ৪২,৬৮১। এর মধ্যে ১৬,২৩৮টিতে বিচার সম্পন্ন হয়েছে, যা মোট মামলার মাত্র ৩৮%। বিচারাধীনতা কমাতে আরও বেশি মামলার নিষ্পত্তি করা উচিত। যেহেতু প্রতি বছর বিচারের জন্য পাঠানো মোট মামলার মধ্যে মাত্র ১০% মামলা নিষ্পত্তি হয়, তাই পকসো-র জন্য আরও বিশেষ আদালতের প্রয়োজন অপরিহার্য। ন্যায়বিচার প্রদানের পদ্ধতিতে আর বিলম্ব না করে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে বিচার সম্পন্ন করার জন্য আরও আদালত স্থাপন এবং কার্যকরী করতে হবে।