কলকাতা, ১২ নভেম্বর (হি. স.) : নন্দীগ্রামে গিয়ে রাজ্যের বিরোধী দলনেতা তথা স্থানীয় বিধায়ক শুভেন্দু অধিকারীকে মেরে হাত-পাঁজরও ভেঙে দেওয়ার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন রাজ্যের মন্ত্রী অখিল গিরি। মন্তব্য করেছেন রাষ্ট্রপতি সম্পর্কেও। বিষয়টি সম্পর্কে প্রশ্ন উঠেছে নানা মহলে। প্রতিক্রিয়া জানালেন বিশিষ্টরা।
শুক্রবার মন্ত্রী বলেন, “শুভেন্দু কেন্দ্রীয় বাহিনী নিয়ে খুব বাড়াবাড়ি করছে। মেরে ওর হাত ভেঙে দেব। পাঁজরও ভাঙব। শুধু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় চান না বলে আমি চুপ আছি। না হলে ওর পাঁজর ভেঙে দিতাম। আমরা রাস্তায় নামি না বলে চুপ আছি। তবে সব সময় চুপ থাকব না। দলকে বাঁচাতে সমস্ত শক্তি নিয়ে ঝাঁপাব।’’ ওই সভায় রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মু সম্পর্কেও অবমাননাকর মন্তব্যের অভিযোগ ওঠে অখিল গিরির বিরুদ্ধে।
সাংসদ তথা সিপিএমের আইনজীবী নেতা বিকাশ ভট্টাচার্য এই প্রতিবেদককে বলেন, “খুব খারাপ। এরকম মন্তব্য রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে নষ্ট করে দিচ্ছে। রাজনীতি হল দর্শনের সংস্কৃতির লড়াই। বিতর্ক হবে। মানুষকে বোঝাতে তাঁদের কাছে নেতাদের যেতে হবে। তা না করে এরকম মন্তব্য গুন্ডাদের উৎসাহিত করবে। যাঁরা সুস্থ চিন্তা করেন, পিছিয়ে যাবেন অথবা নিজেদের গুটিয়ে নেবেন।”
“নেতা বা জনপ্রতিনিধিদের মুখের এরকম ভাষা আমি ভাবতেই পারি না। আমাকে পীড়া দেয়।“ এই মন্তব্য করলেন একটি সাপ্তাহিকের সম্পাদক তথা দীর্ঘকালের সক্রিয় রাজনীতিবিদ, অশীতিপর হিমাংশু হালদার। তিনি এই প্রতিবেদককে বলেন, “আমি ছেলেবেলায় থাকতাম বসিরহাট-সংলগ্ন হাসনাবাদ লোকসভা কেন্দ্রে। ১৯৫২ সালে লোকসভা ভোটের আগে কমিউনিস্ট পার্টির প্রার্থী রেণু চক্রবর্তী প্রচারে এসেছিলেন। শৈশব থেকেই সমাজকর্মীর একটা পরিচয় তৈরি হয়েছিল। নিতান্তই বালক হওয়া সত্বেও আমাকে মঞ্চে বক্তা হিসাবে তুলে দেওয়া হল। সেই শুরু। অজস্র ভাষণ দিয়েছি। কখনও অশ্লীল শব্দ তো দূরের কথা, মানুষের শুনতে খারাপ লাগে, এরকম একটা বাক্যও বলিনি। আগের চেয়ে রাজনীতিবিদদের খারাপ কথা বলার প্রবণতা বেড়েছে। এগুলো জেনে বা শুনে কষ্ট পাই।”
বামফ্রন্টের পরিচালনমন্ডলীর সদস্য তথা সিপিএম-এর কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য রবীন দেব প্রত্যক্ষ রাজনীতি করছেন ৫৭ বছর ধরে। শনিবার তিনি এই প্রতিবেদককে বলেন, “কী যে চলছে! গিরি আর অধিকারী পরিবারের সদস্যরা তো কেবল রাজনীতিবিদ নন! ওঁরা পরস্পরের আত্মীয়তায় আবদ্ধ। একটা নীতিবোধ থাকবে না? দুষ্কর্ম ও দুর্নীতি তৃণমূলের অঙ্গের ভূষণ। সর্বত্র হিংসার বাতাবরণ। নেতাদের প্রকাশ্য হিংসাশ্রয়ী মন্তব্যে সামাজিক সুস্থতা বিপন্ন হচ্ছে।”
তৃণমূল নেতা, দলের অন্যতম মুখপাত্র তাপস রায় এই প্রতিবেদককে পাল্টা প্রশ্ন করেন, “সিপিএম-এর অনিল বসু, বিনয় কোঙাররা যখন প্রকাশ্যে ঝুড়ি ঝুড়ি উত্তেজক মন্তব্য করতেন? আমি কটূ কথা বলি না। অনেকেই বলেন না। গত ক’বছর ধরে বিজেপি-র দিলীপ ঘোষ, সায়ন্তন বসু, রাজু ব্যানার্জী এবং সর্বোপরি শুভেন্দু অধিকারীরা কী কথা ব্যবহার করছেন? এগুলো বাংলার ভাষা নয়। আমাদের দলের অনেকে তা মেনে নিতে পারছেন না।“
হিমাংশু হালদার বলেন, “রাজনীতিবিদের ভাষা কত পরিশীলিত হতে পারে, আচরণ কত মার্জিত হতে পারে, দীর্ঘকাল অতুল্য ঘোষের সংস্পর্শে থাকায় তা দেখার, অনুভব করার সুযোগ পেয়েছি। বছরের পর বছর গোটা দেশে কংগ্রেসের এক নম্বর নিয়ন্ত্রক ছিলেন তিনি। অথচ, অনেক কমিউনিস্টকে নীরবে সাহায্য করেছেন। এই কমিউনিস্টদের একাংশই আবার তাঁকে প্রকাশ্য সভায় কানা, খোঁড়া, নুলো বলে প্রকাশ্যে অপমান করতেন। কিন্তু উনি তো কারাগারে পুলিশের অত্যাচারে এরকম হয়ে গিয়েছিলেন। ওনার শারীরিক প্রতিবন্ধকতার জন্য উনি তো দায়ী নন! রাজনীতিবিদের এই বোধ কেন থাকবে না?“
১৯৯৯ থেকে ২০০২ পর্যন্ত রাজ্য বিজেপি-র সভাপতি ছিলেন অধ্যাপক অসীম ঘোষ। শনিবার তিনি এই প্রতিবেদককে বলেন, “আমরা অন্য রাজনৈতিক সংস্কৃতির আবহে বেড়ে উঠেছি। তবে এটাও ঠিক, মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন জ্যোতি বসু পর্যন্ত একাধিকবার বলেছেন, ‘মাথা ভেঙে দেব। ফাটিয়ে দেব।’ নেতাদের কথার এই প্রবণতা অত্যন্ত নিন্দনীয়। এই সব কারণে এদেশে ভাল পরিবারের, মেধাবীরা রাজনীতিতে আসেন না। উন্নত পশ্চিমী রাষ্ট্রগুলোয় ভাল ছেলেমেয়েরা রাজনীতিতে আসছে। সমাজ তার সুফল পাচ্ছে। কোনও নেতা বা নেত্রী যদি প্রকাশ্যেই বকাটেদের রাজনীতিতে সাদরে আহ্বাণ জানান, মুখের ভাষার এই অবনমন হওয়ার আশঙ্কা থেকেই যায়। আমি সব দল সম্পর্কে এ ব্যাপারে একই দৃষ্টিভঙ্গী পোষণ করি।“
হিমাংশু হালদারের মতে, “খারাপ কথার মত আর একটা অন্যায় নেতাদের অসত্য ভাষণ। প্রফুল্ল সেনের মত নিষ্ঠাবান কংগ্রেসি বহু বছর খাদ্যমন্ত্রী থাকার পর তিন বছর রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন। খারাপ মম্তব্য করতেন না। বিরোধী নেতারা ছড়িয়ে দিলেন তিনি বকলমে স্টিফেন হাউসের মালিক। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে কিছুই ছিল না তাঁর। শেষ বয়সে তিনি তাঁর অনুগামী অশোক কৃষ্ণ দত্তের ফ্ল্যাটে থাকতেন। অনেকটা কপর্দকহীন অবস্থায় বিদায় নেন ইহজগৎ থেকে। কেন রাজনীতিকদের মধ্যে একটা সততা, সজ্জনতার ছাপ থাকবে না? তাঁদের দেখেই তো সমাজ শিখবে!“
তাহলে নেতাদের প্রকাশ্যে এরকম ভাষণই চলবে? সমাধানের পথ কী? সিপিএমের বিকাশ ভট্টাচার্যের মতে, “দলের নেতৃত্বকে অনুভব করতে হবে। সতর্ক হতে হবে। তৃণমূলের তাপস রায়ের দাওয়াই, “ঠিক করতে গেলে সব দলকে সম্মিলিত সিদ্ধান্ত নিতে হবে!“ অসীম ঘোষ বলেন, “শৃঙ্খলার বাতাবরণ তৈরি করতে হবে। এর জন্য শীর্ষমহলের আন্তরিকতা দরকার। কিন্তু শীর্ষমহলই তো ব্যধিতে আক্রান্ত!”
বিষয়টি নিয়ে রাজনৈতিক বিতর্ক সৃষ্টি হওয়ার ক্ষমা চেয়েছেন অখিলবাবু। শনিবার দুঃখপ্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘‘এক মাস আগে থেকে শুভেন্দু অধিকারী বিভিন্ন জায়গায় আমার সম্পর্কে কটূক্তি করেছেন। আমি বয়স্ক মানুষ। আমার মনে ক্রোধ জন্মেছিল। রাষ্ট্রপতি মহোদায়াকে আমি কোনও অসম্মান করিনি। তাঁর প্রতি আমার অগাধ শ্রদ্ধা রয়েছে। যে কথা আমার মুখ থেকে বেরিয়েছে, তা ক্রোধের বশে বেরিয়ে এসেছে। আমি অনুতপ্ত।’’