ঢাকা, ২৮ ডিসেম্বর : বাংলাদেশের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশে গণতন্ত্র, চরমপন্থা এবং ভবিষ্যতের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে এক কঠোর মন্তব্য করেছেন। একান্ত সাক্ষাৎকারে তিনি অভিযোগ করেন যে, মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারে চরমপন্থার উত্থান ঘটেছে, সংবিধানিক কাঠামো ভেঙে পড়েছে এবং বিচারব্যবস্থাকে পরিকল্পিতভাবে দুর্বল করা হয়েছে।
শেখ হাসিনার মতে, অবাধ এবং অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন ছাড়া বাংলাদেশের গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার সম্ভব নয়। তিনি দাবি করেন, ২০২৪ সালের ছাত্র আন্দোলনের অস্থিরতার ঘটনা দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি আরও জটিল করেছে। “প্রথমে প্রকৃত ছাত্র আন্দোলন শুরু হলেও পরে চরমপন্থীরা সেটি সহিংস বিদ্রোহে রূপান্তরিত করে,” বলেন শেখ হাসিনা। তিনি উল্লেখ করেন, থানা জ্বালিয়ে দেওয়া, রাষ্ট্রীয় এবং যোগাযোগ পরিকাঠামো ভাঙচুরসহ পরিস্থিতি পুরোপুরি আইনশৃঙ্খলার ভঙ্গনে পরিণত হয়েছিল। “এটি আর নাগরিক প্রতিবাদ ছিল না, ছিল হিংস্র জনতার তাণ্ডব,” বলেন তিনি।
বাংলাদেশ ছাড়ার সিদ্ধান্ত প্রসঙ্গে শেখ হাসিনা জানান, এটি তার জন্য এক কঠিন সিদ্ধান্ত ছিল। “এখন দেশে চরমপন্থার দাপাদাপি,” বলেন তিনি। তিনি বলেন, “মানুষ ও নাগরিকদের নিরাপত্তা আমার কাছে সর্বাগ্রে। তাই আরও প্রাণহানি ঠেকাতে এবং আশপাশের মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আমি বাধ্য হয়ে দেশ ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।”
শেখ হাসিনা স্পষ্টভাবে জানান, তিনি দেশের শাসনব্যবস্থায় ফিরতে চান তবে তার জন্য কিছু শর্ত রয়েছে। তার মতে, সংবিধান ও আইনের শাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে হবে, আওয়ামী লীগের উপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করতে হবে, মিথ্যা মামলায় আটক রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তি দিতে হবে এবং অবাধ নির্বাচন নিশ্চিত না করা হলে গণতান্ত্রিক বৈধতার প্রশ্নই ওঠে না। “গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত একটি দলকে নিষিদ্ধ রেখে কোনো সরকার গণতান্ত্রিক দাবি করতে পারে না,” বলেন শেখ হাসিনা।
২০২৪ সালের ছাত্র আন্দোলন দমনে সরকারের ভূমিকা নিয়ে ওঠা অভিযোগের ব্যাপারে শেখ হাসিনা বলেন, “প্রথম দিকে শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদকারীদের অনুমতি দেওয়া হয়েছিল এবং দাবিও মেনে নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু পরে চরমপন্থীরা পরিস্থিতি বদলে দেয়। পুলিশ স্টেশন পোড়ানো এবং রাষ্ট্রীয় সম্পত্তিতে হামলা করার পর যে কোনও সরকার আইনশৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে পদক্ষেপ নেয়,” জানান তিনি।
তিনি আরও বলেন, ২০২৪ সালের আগস্টে ঘটে যাওয়া মৃত্যুর তদন্তে একটি বিচার বিভাগীয় কমিশন গঠন করা হয়েছিল। তবে, ইউনূস সরকার ক্ষমতায় আসার পর সেই কমিশন ভেঙে দেওয়া হয় এবং সন্ত্রাসীদের মুক্তি দেওয়া হয়। শেখ হাসিনার অভিযোগ, সত্য উদ্ঘাটনের জন্য তদন্ত বন্ধ করা হয়েছিল।
বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের বিষয়ে তিনি বলেন, “ইউনূস জনগণের একটিও ভোট না পেয়ে ক্ষমতায় বসেছেন। মন্ত্রিসভায় চরমপন্থীদের স্থান দেওয়া হয়েছে, দোষী সন্ত্রাসীদের মুক্তি দেওয়া হয়েছে এবং সংখ্যালঘুদের উপর হামলা রুখতে সরকার ব্যর্থ।” তিনি দাবি করেন, আওয়ামী লীগ সরকারের সময় অর্থনীতি চারগুণ বেড়েছিল, কিন্তু বর্তমান সরকারে তা থমকে গেছে।
২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিতব্য প্রস্তাবিত নির্বাচন নিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, “আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ থাকলে, কোনো নির্বাচনই বৈধ হতে পারে না।” তিনি আশঙ্কা করেন, চরমপন্থীরা ইউনূসকে সামনে রেখে আন্তর্জাতিক মহলে গ্রহণযোগ্য মুখ দেখিয়ে দেশের ভিতরে মৌলবাদী প্রতিষ্ঠান তৈরি করছে। তবে তিনি বাংলাদেশের জনগণের গণতন্ত্রে অটল বিশ্বাসের উপর আস্থা রেখেছেন।
নিজের শাসনকালে গণতান্ত্রিক পরিসর নিয়ে বিতর্ক প্রসঙ্গে শেখ হাসিনা বলেন, “নব্বইয়ের দশকে আমার দলই দেশে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেছিল। সামরিক শাসনের অভিজ্ঞতা থেকেই আমরা গণতন্ত্রের গুরুত্ব উপলব্ধি করেছি।” তার দাবি, আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে বিরোধী রাজনীতির সুযোগ ছিল, যদিও কিছু দল নির্বাচন বয়কট করেছিল এবং সাধারণ মানুষের পছন্দের সুযোগ কমিয়ে দিয়েছিল।
বর্তমান সরকারের আন্তর্জাতিক অবস্থান নিয়ে কড়া সমালোচনা করেন শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, “পশ্চিমী সমর্থনে ক্ষমতায় এলেও এখন আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলি ইউনূস সরকারের পদক্ষেপের নিন্দা করছে, মন্ত্রিসভার সদস্যরা পদত্যাগ করছেন, সাংবাদিকদের কণ্ঠরোধ করা হচ্ছে এবং নির্বিচারে গ্রেফতার চলছে। এর ফলে দীর্ঘদিনের কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।”
পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “সব প্রতিবেশীর সঙ্গে সম্পর্ক রাখা জরুরি, তবে ১৯৭১ সালের গণহত্যার স্বীকৃতি না দেওয়া পাকিস্তানের সঙ্গে ইউনূস সরকারের তড়িঘড়ি ঘনিষ্ঠতা উদ্বেগজনক।” তিনি জানান, “এ ধরনের কৌশলগত সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার কোনো অন্তর্বর্তী সরকারের নেই।” তার মতে, অবাধ নির্বাচনের মাধ্যমে বৈধ সরকার গঠিত হলেই বাংলাদেশের বিদেশনীতি জাতীয় স্বার্থের ভিত্তিতে পুনর্গঠিত হবে।
এই সাক্ষাৎকারে শেখ হাসিনা স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেন যে, বাংলাদেশের ভবিষ্যত নির্ভর করছে গণতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠা, আইন শাসনের প্রতিষ্ঠা এবং সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠার উপর।

