কৈলাসহর, ২৩ ডিসেম্বর: কৈলাসহর মহকুমার রাংরুং গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকায় নাবালক ও প্রাপ্তবয়স্ক যুবকদের অপহরণ ও বহিঃরাজ্যে নিয়ে গিয়ে অমানবিক নির্যাতনের অভিযোগকে কেন্দ্র করে তীব্র চাঞ্চল্য ছড়িয়েছে। ঘটনায় এলাকাজুড়ে উত্তেজনা ও আতঙ্কের পরিবেশ তৈরি হয়েছে।
বিষয়টির গুরুত্ব বিবেচনা করে ত্রিপুরা সরকারের যুব বিষয়ক, ক্রীড়া ও সমাজকল্যাণ দপ্তর এবং শ্রম দপ্তরের মন্ত্রী টিংকু রায় অরুণাচল প্রদেশের শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রী ন্যাটো দুুকামের কাছে একটি লিখিত চিঠি পাঠিয়ে দ্রুত হস্তক্ষেপের আবেদন জানিয়েছেন।
অভিযোগ অনুযায়ী, কৈলাসহর থানাধীন রাংরুং গ্রাম পঞ্চায়েতের অন্তর্গত রাংরুং চা বাগান ও কালীশাসন চা বাগান এলাকা থেকে প্রায় ৩০ জনকে(যাদের মধ্যে ৭ জন নাবালক)গত ৯ আগস্ট মিথ্যা প্রলোভন দেখিয়ে বহিঃরাজ্যে নিয়ে যাওয়া হয়। তাদের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয় মাসে ১৪ হাজার টাকা বেতন, বিনামূল্যে থাকা ও খাওয়ার ব্যবস্থা এবং অগ্রিম ২ হাজার টাকা প্রদান করা হয়।
ভুক্তভোগী পরিবারগুলির অভিযোগ, ওইদিন সকাল আটটায় পরিবারের সদস্যরা প্রতিদিনের মতো চা বাগানে কাজ করতে যায়। বিকেলে বাড়ি ফিরে তারা দেখতে পান, তাদের ছেলেরা নিখোঁজ। পরে ফোনে যোগাযোগ করলে ছেলেরা জানায়, তারা কাজের উদ্দেশ্যে আগরতলা যাচ্ছে। তিনদিন পর তারা গন্তব্যে পৌঁছায় বলে জানানো হয়।
কিন্তু এক সপ্তাহ পর ফোনে বাড়িতে জানানো হয়, অগ্রিম দেওয়া ২ হাজার টাকা মালিক পক্ষ কেড়ে নিয়েছে। অভিযোগ, যুবকদের একটি ট্রাকের মধ্যে পলিথিনের উপর বসিয়ে কাজের জায়গায় নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তাদের দিয়ে প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কমলা পাড়ানোর কঠোর পরিশ্রম করানো হচ্ছে। নির্দিষ্ট এলাকা ছেড়ে বের হতে দেওয়া হচ্ছে না। প্রতিবাদ করলে মারধর করা হচ্ছে বলেও অভিযোগ।
ভুক্তভোগীদের পরিবার সূত্রে আরও জানা যায়, প্রতিদিন তিনবেলা খাবারের প্রতিশ্রুতি থাকলেও কখনও এক বেলা, কখনও দু’বেলা খাবার দেওয়া হচ্ছে, তাও অপর্যাপ্ত। ফোনে কথা বলতে দেখলে তাদের মোবাইল ফোন কেড়ে নেওয়া হচ্ছে।
রাংরুং চা বাগান এবং কালীশাসন চা বাগান থেকে প্রায় ৩০ জন যুবক ও নাবালককে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় হলো, ওই ৩০ জন যুবক নিজেরাই ঠিক কোথায় রয়েছে তা স্পষ্টভাবে জানাতে পারছে না। তাদের মধ্যে একজন জানিয়েছে, তারা অরুণাচল প্রদেশের কোনও এক স্থানে রয়েছে, তবে সঠিক স্থান বলতে পারছে না।
অভিযোগে আরও বলা হয়েছে, কালীশাসন চা বাগানের ভবতারিণী মন্দিরের পুরোহিত সনৎ কুমার উপাধ্যায়ের ছেলে ওমপ্রকাশ উপাধ্যায় বহিঃরাজ্যে কাজের জন্য যুবক পাঠানোর উদ্দেশ্যে স্থানীয় বাগান শ্রমিক বধুরাম উরাং-এর সঙ্গে যোগাযোগ করে। পরবর্তীতে বধুরাম উরাং ওই যুবকদের ওমপ্রকাশ উপাধ্যায়ের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দেয়। অভিযোগ, গত ৯ ডিসেম্বর ওমপ্রকাশ উপাধ্যায় এই যুবকদের বহিঃরাজ্যে পাঠায়। বর্তমানে সে এলাকায় গা ঢাকা দিয়ে রয়েছে বলেও দাবি স্থানীয়দের।
ঘটনায় উদ্বিগ্ন অভিভাবকরা আজ কৈলাসহর থানায় লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন এবং দ্রুত তাদের সন্তানদের উদ্ধার করার দাবি জানান। এলাকায় চরম আতঙ্ক ও উৎকণ্ঠার পরিবেশ তৈরি হয়েছে।
পরবর্তী সময়ে অভিভাবকরা স্থানীয় বিধায়ক তথা রাজ্যের মন্ত্রী টিংকু রায়ের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। বিষয়টির গুরুত্ব বুঝে মন্ত্রী তৎক্ষণাৎ অরুণাচল প্রদেশের শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রী ন্যাটো দুুকাম-এর কাছে একটি লিখিত চিঠি পাঠান এবং অপহৃত যুবকদের দ্রুত উদ্ধার ও নিরাপদ প্রত্যাবর্তনের জন্য হস্তক্ষেপ কামনা করেন। পাশাপাশি অরুণাচল প্রদেশের বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্বের সঙ্গেও তিনি যোগাযোগ করেছেন বলে জানান।
চিঠিতে মন্ত্রী টিংকু রায় উল্লেখ করেন, কৈলাসহর থানায় সম্প্রতি একটি মামলা দায়ের হয়েছে, যেখানে অভিযোগ করা হয়েছে যে উনকোটি জেলার কৈলাসহরের রাংরুং চা বাগান ও কালীশাসন এলাকার একটি চা বাগান থেকে প্রায় ৩০ জন নাবালক শ্রমিকসহ কয়েকজন প্রাপ্তবয়স্ক শ্রমিককে অরুণাচল প্রদেশে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তাদের কাজের বিনিময়ে নির্দিষ্ট মজুরি ও সুযোগ-সুবিধার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলেও বাস্তবে তারা তাদের আইনসম্মত প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন বলে অভিযোগ।
চিঠিতে আরও বলা হয়েছে, শ্রমিকদের পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ওই নাবালক শ্রমিকদের অমানবিক নির্যাতনের শিকার হতে হচ্ছে এবং তারা অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর ও অমানবিক পরিবেশে বসবাস করতে বাধ্য হচ্ছেন। এর ফলে তারা মারাত্মক মানসিক চাপ ও আতঙ্কের মধ্যে রয়েছেন। পরিবারগুলিও গভীর উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন এবং তাঁদের সন্তানদের দ্রুত ও নিরাপদে ঘরে ফেরানোর জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছেন।
এই প্রেক্ষিতে মন্ত্রী টিংকু রায় চিঠিতে অরুণাচল প্রদেশ সরকারের কাছে অনুরোধ জানান, বিষয়টির মানবিক দিক বিবেচনা করে দ্রুত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করে সংশ্লিষ্ট শ্রমিকদের অবিলম্বে উদ্ধার ও নিরাপদে নিজ রাজ্যে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করা হোক।
চিঠির অনুলিপি অরুণাচল প্রদেশ সরকারের শ্রম কমিশনার এবং ত্রিপুরা সরকারের শ্রম দপ্তরের শ্রম কমিশনারের কাছেও পাঠানো হয়েছে, যাতে দুই রাজ্যের মধ্যে সমন্বয়ের মাধ্যমে দ্রুত উদ্ধার অভিযান ও প্রত্যাবর্তনের ব্যবস্থা করা যায়। শিশুশ্রম আইন লঙ্ঘন ও মানবাধিকার হরণের এই গুরুতর অভিযোগকে কেন্দ্র করে প্রশাসনিক স্তরে তৎপরতা শুরু হয়েছে বলে জানা গেছে। স্থানীয় মানুষের দাবি, দোষীদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের পাশাপাশি অবিলম্বে ভুক্তভোগী নাবালক ও শ্রমিকদের নিরাপদে ফিরিয়ে আনা হোক।

