নয়াদিল্লি, ৩০ নভেম্বর : প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী রবিবার তাঁর মাসিক রেডিও অনুষ্ঠান ‘মন কি বাত’-এর ১২৮তম পর্বে দেশবাসীর প্রতি পুনরায় “ভোকাল ফর লোকাল” আন্দোলনকে আরও জোরদার করার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, উৎসবের মরসুমে দেশীয় পণ্যের প্রতি মানুষের আগ্রহ বেড়েছে, যা স্বদেশী চেতনার এক ইতিবাচক প্রতিফলন। প্রধানমন্ত্রী উল্লেখ করেন, সাম্প্রতিক জি–২০ সম্মেলনে তিনি যে উপহারগুলি বিশ্বনেতাদের প্রদান করেছিলেন, তার প্রতিটিই ভারতের স্থানীয় শিল্প ও কারুশিল্পের অনন্য নিদর্শন। দক্ষিণ আফ্রিকার রাষ্ট্রপতির উদ্দেশে চোলা যুগ অনুপ্রাণিত ব্রোঞ্জ নির্মিত নটরাজ মূর্তি, কানাডার প্রধানমন্ত্রীকে উদয়পুরের রূপোর ঘোড়া, জাপানের প্রধানমন্ত্রীকে তেলেঙ্গানার রূপোর বুদ্ধ মূর্তি, ইতালির প্রধানমন্ত্রীকে করিমনগরের রূপোর আয়না এবং অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রীকে কেরালার পিতলের উড়লি প্রদান করেন তিনি। মোদী বলেন, এসব উপহারের উদ্দেশ্য ছিল ভারতীয় শিল্প, হস্তশিল্প এবং স্থানীয় কারিগরদের দক্ষতাকে বিশ্বমঞ্চে তুলে ধরা। তিনি আরও জানান, তরুণ প্রজন্মসহ সচেতন নাগরিকদের উদ্যোগে দেশীয় পণ্য ক্রয় ও বিক্রয়ের প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বড়দিন ও নববর্ষ উপলক্ষে দেশবাসীকে অনুরোধ জানিয়ে তিনি বলেন, “দেশে যা তৈরি হয় তাই কিনুন, এবং যে জিনিসে দেশের নাগরিকের পরিশ্রমের ছাপ আছে তাই বিক্রি করুন।”
এদিন প্রধানমন্ত্রী ভারতের খেলাধুলার দ্রুত অগ্রগতির দিকেও আলোকপাত করেন। তিনি জানান, গত মাসটি ভারতের খেলাধুলার জন্য অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ছিল। ভারতীয় মহিলা দল আইসিসি মহিলা বিশ্বকাপ জিতে দেশের গৌরব বৃদ্ধি করেছে। একই সঙ্গে টোকিওতে অনুষ্ঠিত ডেফ অলিম্পিকে ভারত ২০টি পদক অর্জন করে ইতিহাস গড়ে। এছাড়া ভারতের মহিলা দল কাবাডি বিশ্বকাপ জেতে এবং বিশ্ব বক্সিং কাপ ফাইনালে ভারতীয় বক্সাররাও ২০টি পদক লাভ করে। মোদী বিশেষভাবে প্রশংসা করেন মহিলা ব্লাইন্ড ক্রিকেট দলের, যারা গোটা টুর্নামেন্টে অপরাজিত থেকে বিশ্বকাপ জিতেছে। তিনি বলেন, দলটির মানসিক দৃঢ়তা ও সাফল্য সমগ্র দেশের অনুপ্রেরণা হয়ে উঠেছে। প্রধানমন্ত্রী উল্লেখ করেন, দেশে এখন ম্যারাথন, সাইক্লিং ও অন্যান্য সহনশীলতা–ভিত্তিক খেলাধুলার জনপ্রিয়তা দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। বর্তমানে প্রতি মাসে দেশে ১,৫০০–রও বেশি এ ধরনের ইভেন্ট অনুষ্ঠিত হয়। সম্প্রতি গোয়ায় অনুষ্ঠিত আয়রনম্যান ট্রায়াথলনকে তিনি ভারতের ফিটনেস–কেন্দ্রিক আগ্রহের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হিসেবে উল্লেখ করেন। এছাড়াও “ফিট ইন্ডিয়া সানডেস অন সাইকেল”–এর মতো গণ–ফিটনেস উদ্যোগও ব্যাপক জনপ্রিয়তা পাচ্ছে বলে জানান তিনি।
‘মন কি বাত’–এর বক্তৃতায় প্রধানমন্ত্রী ভারতের শীতকালীন পর্যটনের সম্ভাবনার দিকেও দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। তিনি বলেন, বহু দেশ শীতকালীন খেলাধুলা যেমন স্কিইং, স্নো–বোর্ডিং, ট্রেকিং, আইস–ক্লাইম্বিং-এর উপর ভিত্তি করে শক্তিশালী পর্যটন ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলেছে, আর ভারতও তার বৈচিত্র্যময় পাহাড়ি ভূপ্রকৃতির কারণে সে পথে এগোতে সক্ষম। বিশেষ করে উত্তরাখণ্ডে আউলি, মুন্সয়ারি, চোপতা ও দেউরা অঞ্চলে পর্যটকদের আগ্রহ ক্রমশ বাড়ছে। পিথোরাগড় জেলার আদি কৈলাশে সম্প্রতি ১৪,৫০০ ফুট উচ্চতায় অনুষ্ঠিত উচ্চ–অঞ্চল আল্ট্রা রান ম্যারাথনে দেশের ১৮টি রাজ্য থেকে ৭৫০–রও বেশি ক্রীড়াবিদের অংশগ্রহণ উল্লেখযোগ্য বলে জানান তিনি। তিন বছর আগে যেখানে এই অঞ্চলে পর্যটকদের সংখ্যা ছিল ২,০০০–এরও কম, বর্তমানে তা বেড়ে ৩০,০০০ ছাড়িয়েছে। মোদী আরও জানান, আগামী সপ্তাহগুলিতে উত্তরাখণ্ডে উইন্টার গেমস অনুষ্ঠিত হবে এবং স্কিইং ও স্নো–বোর্ডিং–সহ বিভিন্ন বরফ–ভিত্তিক খেলার প্রস্তুতি ইতিমধ্যেই শুরু হয়েছে। পর্যটন বৃদ্ধির পেছনে রাজ্যের সংযোগব্যবস্থা, অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও নতুন হোমস্টে নীতির ভূমিকা রয়েছে বলে মন্তব্য করেন তিনি। এছাড়া পাহাড়ি রাজ্যগুলিতে গঙ্গার তীরে ডেস্টিনেশন ওয়েডিং–এর প্রবণতাও সাম্প্রতিক সময়ে দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। তিনি দেশবাসীকে আহ্বান জানান, শীতকালীন ছুটিতে হিমালয় অঞ্চলকে ভ্রমণের পরিকল্পনায় অন্তর্ভুক্ত করতে।
প্রধানমন্ত্রী এদিন জানান, গত কয়েক বছরে ভারতে মধু উৎপাদনের হার প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। বর্তমানে দেশে বছরে ১.৫ লক্ষ মেট্রিক টনের বেশি মধু উৎপাদিত হয়, যা ১১ বছর আগে ছিল মাত্র ৭৬,০০০ মেট্রিক টন। পাশাপাশি মধু রপ্তানিও তিনগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। তিনি জানান, জম্মু–কাশ্মীরের রামবন সুলাইয়ের বন্য তুলসি থেকে তৈরি মধু GI ট্যাগ পাওয়ার পর ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। দক্ষিণ কন্নড় জেলার গ্রামজন্য সংগঠন আধুনিক প্রক্রিয়াকরণ ও ট্র্যাকিং কেন্দ্র স্থাপন করে ইতিমধ্যেই ২,৫০০–রও বেশি কৃষককে উপকৃত করেছে। কর্নাটকের তুমি কুরু জেলায় শিবগঙ্গা কলঞ্জিয়া কৃষকদের মৌ বাক্স বিতরণ করে সম্মিলিতভাবে মধু আহরণ ও বিপণনে সহায়তা করছে। প্রধানমন্ত্রী নাগাল্যান্ডের খিয়ামনি–ইয়াঙ্গান উপজাতির প্রচলিত ক্লিফ–হানি সংগ্রহের ঐতিহ্যকেও প্রশংসা করেন। তিনি জানান, খাদি অ্যান্ড ভিলেজ ইন্ডাস্ট্রিজ কমিশনের ‘হানি মিশন’–এর আওতায় এখনও পর্যন্ত ২.২৫ লক্ষেরও বেশি মৌ বাক্স বিতরণ করা হয়েছে, যা গ্রামীণ কর্মসংস্থানের নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। পাশাপাশি তিনি কোয়েম্বাটোরে অনুষ্ঠিত প্রাকৃতিক কৃষি সম্মেলনে তাঁর সাম্প্রতিক উপস্থিতির প্রসঙ্গ তুলে বলেন, দেশে প্রশিক্ষিত পেশাদার এবং তরুণ কৃষকদের মধ্যে প্রাকৃতিক চাষের চর্চা দ্রুত বাড়ছে, যা ভারতীয় ঐতিহ্যনির্ভর কৃষিপদ্ধতির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ।
প্রধানমন্ত্রী মোদীর বক্তব্যে দেশীয় উৎপাদন থেকে কৃষি, পর্যটন, খেলাধুলা ও সুস্বাস্থ্য—প্রতিটি ক্ষেত্রেই আত্মনির্ভর ভারতের স্বপ্ন বাস্তবায়নের স্পষ্ট বার্তা উঠে এসেছে।
_____

