নয়াদিল্লি, ১৩ অক্টোবর : ভারতের বৈদেশিক বাণিজ্য নীতিতে এক ঐতিহাসিক মাইলফলক স্পর্শ করল ১ অক্টোবর, ২০২৫, যেদিন থেকে কার্যকর হলো ভারত ও ইউরোপীয় ফ্রি ট্রেড অ্যাসোসিয়েশন (ইএফটিএ) – এর মধ্যে স্বাক্ষরিত ট্রেড অ্যান্ড ইকনমিক পার্টনারশিপ অ্যাগ্রিমেন্ট (টেপা)। চলতি বছরের ১০ মার্চ নয়াদিল্লিতে স্বাক্ষরিত এই চুক্তি ভারতের জন্য প্রথম মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি, যা চারটি উন্নত ইউরোপীয় দেশ – সুইজারল্যান্ড, নরওয়ে, আইসল্যান্ড ও লিচেনস্টেইনের সঙ্গে সম্পাদিত হয়েছে।
এই চুক্তির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হল ইএফটিএ দেশগুলোর তরফ থেকে আগামী ১৫ বছরে ভারতের অর্থনীতিতে ১০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগের বাধ্যতামূলক অঙ্গীকার এবং এক কোটি সরাসরি কর্মসংস্থানের প্রতিশ্রুতি, যা ভারতের বাণিজ্য ইতিহাসে এই প্রথম। এই বিনিয়োগ দুটি পর্যায়ে বাস্তবায়িত হবে – প্রথম ১০ বছরে ৫০ বিলিয়ন ডলার এবং পরবর্তী পাঁচ বছরে আরও ৫০ বিলিয়ন ডলার। বিনিয়োগের লক্ষ্য হবে দীর্ঘমেয়াদী খাত যেমন পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তি, জীববিজ্ঞান, উন্নত প্রকৌশল, ডিজিটাল প্রযুক্তি এবং উদ্ভাবননির্ভর উৎপাদন। বিনিয়োগ ব্যবস্থাপনা ও সহায়তার জন্য ইতিমধ্যেই ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে একটি ‘ইন্ডিয়া–ইএফটিএ ডেস্ক’ চালু হয়েছে।
টেপা চুক্তি অনুযায়ী ইএফটিএ দেশগুলো ৯২.২ শতাংশ ট্যারিফ লাইনে শুল্ক তুলে দিয়েছে, যা ভারতের ৯৯.৬ শতাংশ রপ্তানি পণ্যের জন্য প্রযোজ্য। এর ফলে ভারতীয় রপ্তানিকারকরা বিশেষত প্রক্রিয়াজাত খাদ্য, শিল্পজাত পণ্য ও গৃহস্থালি সামগ্রীর ক্ষেত্রে বড় ধরনের সুবিধা পাবেন। ভারতের পক্ষ থেকে ইএফটিএ দেশগুলোর ৯৫.৩ শতাংশ রপ্তানি পণ্যের জন্য ৮২.৭ শতাংশ ট্যারিফ লাইনে ছাড় দেওয়া হয়েছে। তবে ভারত কিছু সংবেদনশীল খাত যেমন দুগ্ধজাত পণ্য, সোয়া, কয়লা, ওষুধ, চিকিৎসা যন্ত্র এবং কৃষিপণ্যকে এই ছাড়ের বাইরে রেখেছে বা ধাপে ধাপে শুল্ক হ্রাসের ব্যবস্থা করেছে, যাতে দেশীয় শিল্পকে প্রস্তুত হতে সময় দেওয়া যায়।
পরিষেবা খাতেও এই চুক্তি উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি এনেছে। বর্তমানে ভারতের জিডিপি-তে পরিষেবা খাতের অবদান ৫৫ শতাংশের বেশি, এবং টেপা চুক্তির আওতায় ভারত ১০৫টি পরিষেবা সাব-সেক্টরে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। বিপরীতে, ইএফটিএ দেশগুলোর মধ্যে সুইজারল্যান্ড ১২৮, নরওয়ে ১১৪, আইসল্যান্ড ১১০ এবং লিচেনস্টেইন ১০৭টি খাতে পরিষেবা সুবিধা দিয়েছে। এই চুক্তিতে প্রথমবারের মতো নিয়ন্ত্রিত পেশা যেমন নার্সিং, চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্সি ও স্থাপত্য পেশায় পারস্পরিক স্বীকৃতির ব্যবস্থা করা হয়েছে, যার ফলে ভারতীয় পেশাজীবীরা ইএফটিএ দেশে সহজে কাজ করার সুযোগ পাবেন।
বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদ সুরক্ষা ক্ষেত্রেও ভারসাম্য রক্ষা করা হয়েছে। ডব্লিউটিও-র ট্রিপস চুক্তির আওতায় বাধ্যবাধকতা বজায় রাখা হলেও ভারতকে গুরুত্বপূর্ণ ওষুধ খাতে জনস্বার্থ রক্ষার জন্য নমনীয়তা প্রদান করা হয়েছে। পেটেন্ট ‘এভারগ্রিনিং’-এর বিরুদ্ধে সুরক্ষা রেখে সামাজিক অন্তর্ভুক্তির দিকটি গুরুত্ব পেয়েছে। একইসঙ্গে পরিবেশবান্ধব ও টেকসই বাণিজ্যিক চর্চা, কাস্টমস প্রক্রিয়ার সরলীকরণ, ডিজিটাল টুল ব্যবহারে অগ্রাধিকার এবং আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী পদ্ধতির প্রতিশ্রুতি এই চুক্তিকে একটি ভবিষ্যতমুখী অংশীদারিত্বে পরিণত করেছে।
টেপা চুক্তির প্রভাব ইতোমধ্যেই বিভিন্ন খাতে দেখা যাচ্ছে। কৃষিতে ভারতীয় পণ্য যেমন গয়ার গাম, বসন্তি চাল, আঙুর, ডাল ইত্যাদি এখন ইএফটিএ বাজারে শুল্কমুক্ত হয়েছে। সুইজারল্যান্ড ও নরওয়ে – যারা ভারতের কৃষিপণ্যের ৯৯ শতাংশ আমদানি করে – তারা বাদাম, বীজ ও প্রক্রিয়াজাত সবজি ইত্যাদির উপর শুল্ক তুলে দিয়েছে। কফি ও চায়ের ক্ষেত্রেও ভারতের অবস্থান আরও মজবুত হয়েছে। ইএফটিএ দেশগুলো বছরে প্রায় ১৭৫ মিলিয়ন ডলারের কফি আমদানি করে এবং শুল্ক তুলে দেওয়ায় ভারতীয় কফির প্রতিযোগিতা ক্ষমতা বেড়েছে। ২০২৪–২৫ অর্থবছরে চায়ের প্রতি কেজির রপ্তানি আয় উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে, যা এই চুক্তির ইতিবাচক প্রভাব নির্দেশ করে।
সামুদ্রিক পণ্য রপ্তানিতেও ভারত লাভবান হয়েছে। চিংড়ি, স্কুইড, মাছের খাদ্য ও তেলসহ বিভিন্ন সামুদ্রিক পণ্যে নরওয়ে ও আইসল্যান্ড শুল্ক হ্রাস করেছে। এতে এই বাজারে ভারতের অংশীদারিত্ব বাড়বে বলে মনে করা হচ্ছে।
উৎপাদন খাতে, বিশেষ করে প্রকৌশল পণ্যের রপ্তানি ২০২৪–২৫ অর্থবছরে ১৮ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে ৩১৫ মিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। ইলেকট্রনিক্স, ইভি যন্ত্রাংশ, মেডিকেল ডিভাইস, এবং ফিনটেক ক্ষেত্রে কার্যকর শুল্কছাড় এবং আইপিআর সুরক্ষা বৃদ্ধির ফলে ভারতীয় এমএসএমই ও ওইএম প্রতিষ্ঠানগুলো সরাসরি লাভবান হচ্ছে। টেক্সটাইল, চামড়াজাত পণ্য ও রত্নগয়নার ওপর শুল্ক ও মান নিয়ন্ত্রণে স্থিতিশীলতা আনায় রপ্তানিতে ইতিবাচক প্রভাব পড়ছে।
রাসায়নিক, প্লাস্টিক ও সংশ্লিষ্ট খাতে ৯৫ শতাংশ রপ্তানি পণ্যে শুল্ক হ্রাসের ফলে এই খাতের রপ্তানি ৪৯ মিলিয়ন ডলার থেকে বেড়ে ৭০ মিলিয়ন ডলার ছাড়াতে পারে বলে অনুমান করা হচ্ছে।
সবমিলিয়ে, টেপা চুক্তি কেবল একটি বাণিজ্যিক চুক্তি নয়, বরং এটি ভারতের জন্য একটি কৌশলগত সুযোগ, যা বৈশ্বিক বাণিজ্য কাঠামোয় দেশের অবস্থানকে মজবুত করবে। এটি ভবিষ্যতে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাজ্য ও উপসাগরীয় অঞ্চলের সঙ্গে উচ্চমানের বাণিজ্য চুক্তি আলোচনার জন্য একটি মানদণ্ড স্থাপন করেছে। অর্থনৈতিক উদারতা এবং জাতীয় স্বার্থ রক্ষার মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করে ভারত সরকার দেখিয়েছে, সঠিক পরিকল্পনা ও দৃষ্টিভঙ্গির মাধ্যমে মুক্ত বাণিজ্যও হতে পারে দেশের উন্নয়নের চালিকাশক্তি।

