লখনউ, ১০ সেপ্টেম্বর— লখনউ/গ্যাংটক, ১০ সেপ্টেম্বর: নেপালে চলমান সহিংস বিক্ষোভ ও রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে ভারতের উত্তরপ্রদেশ ও সিকিমে জারি হয়েছে হাই অ্যালার্ট। সীমান্তবর্তী জেলাগুলিতে বাড়ানো হয়েছে নিরাপত্তা ব্যবস্থা, কড়া নজর রাখা হচ্ছে আন্তর্জাতিক সীমান্তে। অন্যদিকে, কাঠমাণ্ডুর ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে আটকে পড়েছেন প্রায় ৭০০ ভারতীয় নাগরিক, যাদের মধ্যে আছেন বহু পর্যটক ও তীর্থযাত্রী।
নেপাল সংলগ্ন উত্তরপ্রদেশের সাতটি জেলা—শ্রাবস্তী, বলরামপুর, বহরাইচ, পিলিভীত, লখিমপুর খেরি, সিদ্ধার্থনগর ও মহারাজগঞ্জ—এ উচ্চ সতর্কতা জারি করেছে রাজ্য সরকার। এসব এলাকায় মোতায়েন করা হয়েছে অতিরিক্ত পুলিশ ও সশস্ত্র সীমা বল। সীমান্ত চৌকিগুলিতে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে সাধারণ যাতায়াত। শুধুমাত্র বৈধ নথিপত্র থাকা নেপালি নাগরিকদের প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হচ্ছে।
বাহরাইচের রূপাইধা, মহারাজগঞ্জের সোনৌলি ও লখিমপুর খেরির গৌরিফান্তা সীমান্তে সম্পূর্ণ নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছে। অনেক এলাকায় সড়কপথে ব্যারিকেড বসিয়ে দেওয়া হয়েছে এবং রাতভর যৌথ টহল চালানো হচ্ছে।
বাহরাইচের জেলাশাসক মনীশ কুমার জানান, “আমরা আন্তর্জাতিক সীমান্তে নজরদারি বাড়িয়েছি। যে কোনো সন্দেহজনক গতিবিধির ওপর নজর রাখা হচ্ছে।” ইতিমধ্যে বাহরাইচ সীমান্তে প্রায় ২০০টি ট্রাক আটকে পড়েছে, যেগুলোতে রয়েছে পেট্রোলিয়াম, সিমেন্ট ও খাদ্যপণ্য। যাত্রী পরিবহনেও ব্যাপক প্রভাব পড়েছে; সোনৌলি রুটে বাস চলাচল ৫০ শতাংশ কমিয়ে দেওয়া হয়েছে।
নেপালে সোমবার জেন জেড তরুণদের নেতৃত্বে হওয়া বিক্ষোভ চরম সহিংসতায় রূপ নেয়। অন্তত ২২ জনের মৃত্যু হয়েছে বলে জানা গেছে। দুর্নীতি ও সোশ্যাল মিডিয়া নিষেধাজ্ঞার কারণে তীব্র জনরোষের মুখে পড়ে প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা ওলি মঙ্গলবার পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। এরপর রাত ১০টা থেকে দেশের নিয়ন্ত্রণ সেনাবাহিনীর হাতে তুলে দেওয়া হয়। কাঠমাণ্ডু, ললিতপুর, ভক্তপুরসহ একাধিক শহরে কারফিউ জারি করেছে সেনা প্রশাসন।
সেনাবাহিনীর এক বিবৃতিতে জানানো হয়েছে, কিছু দুষ্কৃতকারী এই অস্থিরতার সুযোগ নিয়ে সরকারি সম্পত্তি ধ্বংস করছে এবং সাধারণ নাগরিকদের ওপর আক্রমণ চালাচ্ছে।
বিক্ষোভ ও সেনা হস্তক্ষেপের জেরে মঙ্গলবার দুপুর ১টার পর থেকে বন্ধ হয়ে যায় কাঠমাণ্ডুর ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। ফলে প্রায় ৭০০ ভারতীয় নাগরিক সেখানে আটকে পড়েন। আটকে পড়াদের মধ্যে রয়েছেন ইশা ফাউন্ডেশনের ১৩০ জন তীর্থযাত্রী, যাঁরা কাইলাশ মানসসরোবর সফরে গিয়েছিলেন।
এক যাত্রী রজনী মাস্কি জানান, “আমরা একটা বন্ধ ঘরের মধ্যে বন্দির মতো আছি। খাবার নেই, পানি নেই, একটা মাত্র চার্জিং পয়েন্টে সবাই লাইন দিচ্ছে। অনেকে অসুস্থ হয়ে পড়ছেন।” আর এক যাত্রী মুম্বইয়ের ময়ূর পাতিল বলেন, “আমরা পশুপতিনাথ দর্শনে এসেছিলাম। এখন ভারতীয় দূতাবাস বলছে, যেখানে আছি সেখানেই নিরাপদে থাকি।”
বিমানবন্দরে নিরাপত্তাকর্মী ও এয়ারলাইন স্টাফদেরও এলাকা ছেড়ে যেতে বলা হয়েছে, যার ফলে পুরো পরিবেশে বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়েছে।
নেপালের পরিস্থিতির জেরে পূর্ব ভারতে সিকিম সরকারও সীমান্ত এলাকায় কড়া সতর্কতা নিয়েছে। সোরেং ও গ্যালসিং জেলার জ্যেষ্ঠ আধিকারিকদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে এসএসবি-র সঙ্গে যৌথ টহল দিতে। রাংপো, মেল্লি, রেশি সহ গুরুত্বপূর্ণ চেকপোস্টে বাড়ানো হয়েছে নজরদারি। অবৈধ অনুপ্রবেশ রুখতে চেকপোস্টগুলিতে গাড়ি তল্লাশি জোরদার করা হয়েছে।
ডিআইজি ও সংশ্লিষ্ট এসপি-দের স্পর্শকাতর এলাকাগুলি পরিদর্শন করে নিরাপত্তা নিশ্চিত করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থাগুলি সতর্ক অবস্থানে রয়েছে, যাতে এই অস্থিরতা বাংলাদেশের মতো ‘ভারতবিরোধী’ মনোভাব সৃষ্টি না করে। ছাত্র সংগঠন, সিভিল সোসাইটি ও রাজনৈতিক দলগুলির গতিবিধি পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে।
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রক নেপালে অবস্থানরত ভারতীয় নাগরিকদের স্থানীয় নির্দেশিকা মেনে চলার আহ্বান জানিয়েছে।
সহিংসতার ফলে সীমান্ত বাণিজ্য কার্যত থমকে গেছে। বাহরাইচ, মহারাজগঞ্জ, সিদ্ধার্থনগরে ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, নেপালি ক্রেতাদের অভাবে বেচাকেনা বন্ধ। বিমানে যাতায়াতেও বড় প্রভাব পড়েছে—মঙ্গলবার লখনউ ও বারাণসীতে অন্তত ৪টি কাঠমাণ্ডু অভিমুখী ফ্লাইট ঘুরিয়ে দেওয়া হয়েছে।
এমনকি, বিয়ে-শাদির মতো পারিবারিক অনুষ্ঠানও প্রভাবিত হয়েছে। মহারাজগঞ্জে এক নেপালি পাত্র শাহনাওয়াজকে বহু পরিচয়পত্র ও অনুমতি দেখিয়ে ভারতে ঢুকতে দেওয়া হয়েছে, যা এই পরিস্থিতির জটিলতা আরও স্পষ্ট করে।
বর্তমানে উত্তরপ্রদেশের সীমান্ত অঞ্চল কার্যত একটি সামরিকীকৃত অঞ্চলে পরিণত হয়েছে। টহল, নজরদারি, ড্রোন ব্যবহার নিয়ে আলোচনা চলছে। সীমান্তে ওলির পতনের পরও বিক্ষোভ না থামায় পরিস্থিতির আরও অবনতি হতে পারে বলে আশঙ্কা করছে প্রশাসন।
শঙ্করাচার্য স্বামী অবিমুক্তেশ্বরানন্দ সরস্বতী বলেন, “নেপাল আমাদের সাংস্কৃতিক ও আধ্যাত্মিক পরিবারের অবিচ্ছেদ্য অংশ। সহিংসতার পরিবর্তে সংলাপই হোক সমাধানের পথ।”
এদিকে, যতক্ষণ না নেপালে স্থিতিশীলতা ফিরে আসে, ততক্ষণ ভারত-নেপাল সীমান্তজুড়ে এই উত্তেজনা অব্যাহত থাকবে বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

