হরসিল ও কাঠুয়ায় বিপর্যয়: হিমালয়ে মেঘভাঙা ও হঠাৎ বন্যায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি, জলবায়ু পরিবর্তনের আশঙ্কাজনক ইঙ্গিত

দেরাদুন, ১৭ আগস্ট : হিমালয়ের বিভিন্ন অংশে সম্প্রতি ঘন ঘন মেঘভাঙা, আকস্মিক বন্যা এবং অতি বৃষ্টির ঘটনা সামনে এসেছে, যা শুধু স্থানীয় জনগণ নয়, গোটা দেশের জন্যই উদ্বেগজনক। উত্তরাখণ্ডের হরসিলের কাছে ধারালি গ্রামে ৫ আগস্ট ঘটে এক ভয়াবহ মেঘভাঙার ঘটনা, যেখানে ভারতীয় সেনার ঘাঁটির পাশেই কাদা ও পাথরের স্রোতে বহু ঘরবাড়ি এবং ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান ধ্বংস হয়ে যায়। ঘটনায় অন্তত পাঁচজনের মৃত্যু হয়েছে এবং বহু মানুষ এখনও নিখোঁজ।

এর পাশাপাশি, হিমাচল প্রদেশের মান্ডি জেলার থুনাগ এলাকাও জুলাই থেকে ভয়াবহ জলসংকটে ভুগছে। বন্যায় নষ্ট হয়ে গেছে পানীয় জল সরবরাহের সমস্ত পরিকাঠামো, যেমন—মেশিনারি, পাইপলাইন ও ট্রান্সফর্মার। একই ধরনের বিপর্যয় ঘটেছে জম্মু ও কাশ্মীরের কাঠুয়া জেলায়, যেখানে একটি প্রত্যন্ত গ্রামে মেঘভাঙা ও হঠাৎ বন্যায় সাতজন প্রাণ হারিয়েছেন।

বিশেষজ্ঞদের মতে, এইসব ঘটনা এককভাবে প্রাকৃতিক নয়; এর পেছনে রয়েছে জলবায়ু পরিবর্তন, বন উজাড়, হিমবাহ হ্রদের গঠন ও বিস্ফোরণ, এবং অনিয়ন্ত্রিত নির্মাণ ও জমির ব্যবহার। ২০২৪ সালে বৈজ্ঞানিক প্রতিবেদন-এ প্রকাশিত একটি গবেষণায় বলা হয়েছে, হিমালয় অঞ্চলের এই ধরণের আকস্মিক বন্যা মূলত প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট উপাদানের মিলিত ফল। মেঘভাঙা বৃষ্টির পাশাপাশি হিমবাহ গলে গঠিত হ্রদের পরিমাণ ও আকার বৃদ্ধি পাওয়ায় যেকোনও সময় ঘটতে পারে গ্লেসিয়াল লেক আউটবার্স্ট ফ্লাড ।

২০১৩ সালের কেদারনাথ বিপর্যয়ের ক্ষেত্রেও এমনই একটি হিমবাহ হ্রদ ফেটে পড়েছিল, যেখানে অকাল বর্ষণ ও মেঘভাঙার কারণে প্রায় ৬ হাজারের বেশি মানুষ প্রাণ হারান। একটি ২০২৩ সালের গবেষণায় দেখা গেছে, ২০০৬ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে বিশ্বজুড়ে প্রতিবছর গড়ে ৩৩২ গিগাটন বরফ গলেছে। সেই সঙ্গে ১৯৯০ সালের পর থেকে গ্লেসিয়াল লেকের সংখ্যা বেড়েছে ৫০ শতাংশের বেশি। এই পরিস্থিতিতে ভারত, পাকিস্তান, চিন ও পেরু সবচেয়ে বেশি ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে, কারণ এই দেশগুলোতে হিমবাহ হ্রদের ১০ কিমি ব্যাসার্ধের মধ্যে লক্ষাধিক মানুষ বসবাস করেন।

বিজ্ঞানীরা বলছেন, এসব দুর্যোগ কখন ঘটবে তা নির্দিষ্টভাবে বলা যায় না, যা পরিস্থিতিকে আরও বিপজ্জনক করে তুলেছে। ফলে হিমালয় অঞ্চলকে ঘিরে এখনই জরুরি সতর্কতা ও প্রস্তুতি প্রয়োজন। বিশেষজ্ঞদের মতে, উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার, বৈজ্ঞানিক গবেষণা এবং স্থানীয় মানুষের সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে গড়ে তোলা উচিত একটি কার্যকর দুর্যোগ মোকাবিলা নেটওয়ার্ক।

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব এখন আর ভবিষ্যতের সতর্কবার্তা নয়—এটা বর্তমানে ঘটছে। আর হিমালয় অঞ্চলে বারবার প্রকৃতির এই ধ্বংসযজ্ঞ আমাদের এই বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড় করাচ্ছে।