আলাস্কায় ঐতিহাসিক ট্রাম্প-পুতিন বৈঠক : শান্তির বার্তা, কিন্তু কোনো চুক্তি হয়নি, বল এখন জেলেনেস্কির কোর্টে

আলাস্কা, ১৬ আগস্ট : অবশেষে গোটা বিশ্ব দুই শক্তিধর দেশের প্রধানের মধ্যে বৈঠকে আলোচনা গঠনমূলক এবং পারস্পরিক শ্রদ্ধাশীল বলে জানতে পারল। কিন্তু, কোনো চুক্তি না হওয়ায় পুরোটা নিশ্চিন্ত হতে পারল না। অবশ্য ট্রাম্প-পুতিন উভয়েই বিশ্ববাসীর মনে আশা জাগিয়ে রেখেছেন। কারণ, রাশিয়া ও ইউক্রেনের দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধের সমাপ্তির বল এখন জেলেনস্কির কোর্টে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। তাই, আগামী সোমবার মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ডাকে বৈঠকে মিলিত হবেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি।

রাশিয়া ও ইউক্রেনের দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধের সমাপ্তি এবং ইউরোপীয় নিরাপত্তার ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনার জন্য মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন শনিবার আলাস্কার আঙ্করেজ শহরে একটি “উচ্চ-স্তরের” সম্মেলনে মিলিত হন। যদিও এ সম্মেলন থেকে কোনো শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়নি, তবে উভয় নেতা এটিকে “গঠনমূলক ও পারস্পরিক শ্রদ্ধাশীল” আখ্যা দিয়েছেন।

উভয় নেতা নিজ নিজ প্রেসিডেন্ট বিমানে করে আলাস্কার জয়েন্ট বেস এলমেনডর্ফ-রিচার্ডসনে পৌঁছান। ট্রাম্প পুতিনকে অভ্যর্থনা জানানোর সময় হাততালি দিয়ে তাকে স্বাগত জানান। শুরুতেই দুই নেতা উষ্ণ করমর্দনের মাধ্যমে তাঁদের আলোচনার সূচনা করেন। তবে পূর্ব পরিকল্পিত একান্ত বৈঠকের পরিবর্তে, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তার শীর্ষ উপদেষ্টাদের সঙ্গে নিয়ে আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও এবং বিশেষ দূত স্টিভ উইটকফ উপস্থিত ছিলেন। পরে এক বিস্তৃত মধ্যাহ্নভোজ বৈঠকে দুই দেশের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারাও অংশ নেন।

এই বৈঠক ছিল ফেব্রুয়ারি ২০২২ সালের ইউক্রেনে রুশ আগ্রাসনের পর পুতিনের প্রথম পশ্চিমা সফর। বৈঠক চলেছে প্রায় তিন ঘণ্টা। আলোচনার পর অনুষ্ঠিত হয় যৌথ সংবাদ সম্মেলন, যেখানে কোনো প্রশ্ন নেওয়া হয়নি। পুতিন বলেন, আলোচনা অত্যন্ত গঠনমূলক ও পারস্পরিক শ্রদ্ধাশীল ছিল। আমরা কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে একমত হয়েছি। ট্রাম্প জানান, আমাদের বৈঠক অত্যন্ত ফলপ্রসূ হয়েছে। বেশ কিছু বিষয়ে একমত হয়েছি, যদিও কয়েকটি বিষয়ে এখনো অমীমাংসিত। তবে দুই নেতা স্বীকার করেছেন, এখনো কোনো শান্তিচুক্তি হয়নি। ট্রাম্প বলেন, চুক্তি না হওয়া পর্যন্ত চুক্তি হয়নি।

এদিন পুতিন ইউক্রেন ও ইউরোপীয় দেশগুলিকে সতর্ক করে বলেন, এই অগ্রগতিকে যেন কেউ প্ররোচনা বা অন্তর্ঘাতের মাধ্যমে বাধাগ্রস্ত না করে। তিনি সম্মেলনের শেষ দিকে ট্রাম্পকে মস্কো সফরের আমন্ত্রণ জানান। ট্রাম্প মুচকি হেসে বলেন, এটা একটা মজার প্রস্তাব… হয়তো হবে। এদিকে হোয়াইট হাউস জানিয়েছে, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প পুতিনকে তার স্ত্রী মেলানিয়া ট্রাম্পের লেখা একটি ব্যক্তিগত চিঠি হস্তান্তর করেছেন। ওই চিঠিতে ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত শিশুদের পরিস্থিতির কথা তুলে ধরা হয়েছে। মেলানিয়া সম্মেলনে উপস্থিত না থাকলেও, শিশুদের অপহরণ এবং মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে তার উদ্বেগ প্রকাশ পেয়েছে এই চিঠিতে।

সম্মেলনের পর ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি ট্রাম্পের সঙ্গে ফোনে কথা বলেন এবং সোমবার ওয়াশিংটনে সাক্ষাৎ করবেন বলে জানান। তবে ইউক্রেনের জনগণের মধ্যে হতাশা লক্ষ্য করা যায়। পূর্ব ইউক্রেনের খারকিভ শহরে বসবাসকারী থিয়েটার ম্যানেজার পাভলো নেবরোয়েভ বলেন, এই সম্মেলন ছিল পুতিনের কূটনৈতিক জয়। অন্যদিকে, ইউক্রেনীয় নাগরিক ওল্যা ডোনিক বলেন, এতে কিছুই হয়নি। চলুন, আমাদের জীবন চালিয়ে যাই।

ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ, জার্মান চ্যান্সেলর ফ্রিডরিখ মার্জ, ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার এবং ইউরোপীয় কমিশনের প্রধান উরসুলা ভন ডার লেইয়েন এক যৌথ বিবৃতিতে এই সম্মেলনের পরে একটি ত্রিপাক্ষিক (ট্রাম্প-পুতিন-জেলেনস্কি) বৈঠকের আহ্বান জানান। তারা বলেন, শান্তি প্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত আমরা রাশিয়ার উপর অর্থনৈতিক চাপ অব্যাহত রাখব।

ভারত এই সম্মেলনকে স্বাগত জানিয়ে এক বিবৃতিতে বলেছে, আলোচনা ও কূটনৈতিক প্রচেষ্টা ছাড়া সামনে যাওয়ার আর কোনো পথ নেই। আমরা শান্তি প্রতিষ্ঠার অগ্রগতি দেখে সন্তুষ্ট। কিন্তু, মার্কিন প্রেসিডেন্টের জ্বালানি ক্রয় নিয়ে ভারতকে জড়িয়ে মন্তব্য কূটনীতির কোন দিশায় পৌছাবে তা এখনই বলা মুসকিল। ট্রাম্পের বিশ্বাস, রাশিয়া জ্বালানি তেল বিক্রির ভারতের অংশের ৪০ শতাংশ হারাবে। তাঁর বক্তব্য, রাশিয়ার তেল কিনলে চীন-ভারতের ওপর নিষেধাজ্ঞা বিবেচনায় এখনই যেতে হবে না। দু-তিন সপ্তাহ পরে প্রয়োজন হতে পারে। তিনি বলেন, আজকের বৈঠকের কারণে আপাতত তা প্রয়োজন হচ্ছে না। দেখা যাক, সামনে কী হয়।

যদিও ট্রাম্প-পুতিন বৈঠকে কোনো তাৎক্ষণিক যুদ্ধবিরতির ঘোষণা আসেনি, তবে আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার বিষয়ে উভয় পক্ষ আশাবাদ ব্যক্ত করেছে। পুতিন বলেন, আমরা সত্যিই যুদ্ধের অবসান চাই, আর ট্রাম্প বলেন, এখন বল জেলেনস্কির কোর্টে।