নয়াদিল্লি, ১৪ আগস্ট : ১৫ আগস্ট সকাল থেকে দেশজুড়ে উদযাপন করা হবে ভারতের ৭৯তম স্বাধীনতা দিবস। রাজধানী নয়াদিল্লির ঐতিহাসিক লালকেল্লায় আয়োজিত প্রধান অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী জাতীয় পতাকা উত্তোলন করবেন এবং জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেবেন। এই বছরের স্বাধীনতা দিবসের থিম নির্ধারিত হয়েছে “নয়া ভারত”, যা দেশের ২০৪৭ সালের মধ্যে “বিকসিত ভারত” হিসেবে আত্মপ্রকাশের স্বপ্নকে প্রতিফলিত করে।
সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, এই উদযাপন কেবল ঐতিহাসিক স্মৃতিকে স্মরণ করানো নয়, বরং এক আত্মবিশ্বাসী, উন্নয়নশীল ও আত্মনির্ভর ভারতের ভবিষ্যতের পথকেও আরও মজবুত করবে। এদিন সকালে প্রধানমন্ত্রীর আগমনেই শুরু হবে লালকেল্লার মূল অনুষ্ঠান। দিল্লি পুলিশ ও সশস্ত্র বাহিনীর পক্ষ থেকে তাঁকে গার্ড অফ অনার প্রদান করা হবে, এরপর জাতীয় পতাকা উত্তোলনের সঙ্গে সঙ্গে জাতীয় সঙ্গীত ও ২১ তোপধ্বনি সম্পন্ন হবে। একই সঙ্গে ভারতীয় বায়ুসেনার হেলিকপ্টার থেকে পুষ্পবৃষ্টি করা হবে। এ বছর প্রধানমন্ত্রীকে সহায়তা করবেন ফ্লাইং অফিসার রাশিকা শর্মা, এবং ২১ তোপধ্বনি পরিচালনা করবেন ১৭২১ ফিল্ড ব্যাটারি (সেরিমনিয়াল) ইউনিট। প্রধানমন্ত্রীর ভাষণের পর আবার জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশন এবং শেষ পর্যায়ে তেরঙা বেলুন ছেড়ে অনুষ্ঠান সম্পন্ন করা হবে।
এই বছর স্বাধীনতা দিবসের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ হলো অপারেশন সিঁদুরের সাফল্য উদযাপন, যা ভারতীয় কূটনৈতিক ও সামরিক কৌশলের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। আমন্ত্রণপত্রে অপারেশন সিঁদুরের লোগো এবং কাশ্মীরের বিখ্যাত চেনাব ব্রিজের জলছবি রাখা হয়েছে। প্রায় ৫০০০ বিশেষ অতিথিকে লালকেল্লায় আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে, যাঁদের মধ্যে রয়েছেন ২০২৫ সালে স্পেশাল অলিম্পিক্সে অংশগ্রহণকারী ভারতীয় দল, আন্তর্জাতিক ক্রীড়া ইভেন্টে বিজয়ী ক্রীড়াবিদ এবং খেলো ইন্ডিয়া প্যারা গেমসের স্বর্ণপদকপ্রাপ্তরা। এছাড়াও, দিল্লির ৫০ জন শ্রেষ্ঠ সাফাই কর্মী ও তাঁদের পরিবারের সদস্যদের সম্মান জানাতে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে, যা পরিচ্ছন্ন ভারত মিশনের প্রতি সরকারের অঙ্গীকারকে তুলে ধরে।
প্রথমবারের মতো স্বাধীনতা দিবসের সন্ধ্যায় দেশের ১৪০টিরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ স্থানে সশস্ত্র বাহিনী ও আধা-সামরিক বাহিনীর ব্যান্ড পরিবেশনা হবে। সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বায়ুসেনা, কোস্ট গার্ড, এনসিসি, সিআরপিএফ, সিআইএসএফ, আইটিবিপি, এসএসবি, বিএসএফ, আইডিএস, আরপিএফ এবং অসম রাইফেলস – সবকটি বাহিনী এতে অংশগ্রহণ করবে। এর মাধ্যমে দেশের প্রতিটি কোণায় দেশপ্রেমের আবেগ ছড়িয়ে পড়বে বলে আশাবাদী কেন্দ্র।
রাজ্যগুলিতেও স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে কড়া নিরাপত্তা ও সাজ-সজ্জা চলছে পুরোদমে। অসমে মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মা গুয়াহাটির খানাপাড়ায় সকাল ৯টায় জাতীয় পতাকা উত্তোলন করবেন। রাজ্যের অন্যান্য জেলায় মন্ত্রীরা পতাকা উত্তোলন করবেন। তবে এই উদযাপনকে ঘিরে অশান্তির আশঙ্কাও দেখা দিয়েছে, কারণ উলফা (স্বাধীন) সংগঠন রাজ্যজুড়ে বনধ ডেকে অনুষ্ঠান বয়কটের আহ্বান জানিয়েছে। ফলে রাজ্য সরকার স্পর্শকাতর এলাকায় নজরদারি ও নিরাপত্তা জোরদার করেছে।
৭৯তম স্বাধীনতা দিবসের আগে মণিপুরে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। রাজ্য রাজধানী ইম্ফলসহ গুরুত্বপূর্ণ এলাকাগুলিতে বাড়ানো হয়েছে পুলিশ, সেনা এবং আধা-সামরিক বাহিনীর মোতায়েন। বৃহস্পতিবার রাজ্য প্রশাসনের তরফে জানানো হয়, কেইসাম্পাট এবং মইরাংখম চৌমাথায় অতিরিক্ত বাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে রাজ্য পুলিশ, সিআরপিএফ, আসাম রাইফেলস এবং সেনাবাহিনী। স্বাধীনতা দিবসের প্রস্তুতি হিসাবে ইম্ফলের ১ নম্বর মণিপুর রাইফেলস ময়দান এবং জেলা সদর দপ্তরগুলিতে চলছে মহড়া। মার্চপাস্টে অংশ নিচ্ছেন সিআরপিএফ, রাজ্য পুলিশ, আসাম রাইফেলস এবং বিভিন্ন স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রীরা। বুধবার সিআরপিএফ রাজ্যের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে মোবাইল চেকপোস্ট বসিয়ে ৪৪৩টি গাড়ি তল্লাশি এবং ৭২২ জন ব্যক্তিকে জেরা করে।এই অতিরিক্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থার পেছনে কারণ রয়েছে – কয়েকটি নিষিদ্ধ ঘোষিত বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন ১৫ আগস্টের আগের দিন সাধারণ ধর্মঘটের ডাক দিয়েছে। সেই প্রেক্ষিতেই রাজ্যজুড়ে সর্বোচ্চ সতর্কতা জারি করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন প্রশাসনিক কর্মকর্তারা।
এদিকে, স্বাধীনতা দিবস উদযাপন উপলক্ষে ইটানগর জুড়ে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। শহরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে চেকপোস্ট স্থাপন করা হয়েছে এবং নাগরিকদের নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে সহযোগিতা করে নির্ধারিত নির্দেশিকা মেনে চলার আহ্বান জানানো হয়েছে। বৃহস্পতিবার কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ইন্দিরা গান্ধী পার্কে মূল অনুষ্ঠান ঘিরে বহুস্তরীয় নিরাপত্তা পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে পুলিশ প্রশাসন। ডেপুটি ইনস্পেক্টর জেনারেল তুম্মে আমো জানান, নিরাপত্তা ব্যবস্থার অংশ হিসেবে রুট লাইনিং, প্রতিটি প্রবেশপথে নিয়ন্ত্রিত প্রবেশ, নাশকতা রোধে তল্লাশি এবং সার্বক্ষণিক সিসিটিভি ও ড্রোন নজরদারির ব্যবস্থা করা হয়েছে। বিশেষ প্রশিক্ষিত দলসমূহ ভিড় নিয়ন্ত্রণে নিয়োজিত থাকবে এবং মেডিকেল, ফায়ার ও জরুরি পরিষেবা ইউনিটগুলি দিনভর সতর্ক অবস্থায় থাকবে। নাগরিকদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে আমো বলেন, “আসুন আমরা ঐক্য, শৃঙ্খলা ও গর্বের সঙ্গে এই স্বাধীনতা দিবস উদযাপন করি।”
পাঞ্জাবেও সুরক্ষা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। রাজ্যজুড়ে ১৫০০-রও বেশি পুলিশ কর্মী মোতায়েন করা হয়েছে ২৫০টি দলের মাধ্যমে। পাঞ্জাব পুলিশের ডিজিপি গৌরব যাদব সীমান্ত জেলা ও গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলিতে নিরাপত্তা পর্যালোচনা করেছেন এবং আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখতে নিরবিচারে নজরদারি ও সমন্বিত অভিযানের নির্দেশ দিয়েছেন। বেঙ্গালুরুতে স্বাধীনতা দিবস উদযাপন আরও সুসংগঠিত করতে জনসাধারণের জন্য ই-পাস ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে, যা পাওয়া যাবে সেবা সিন্ধু ওয়েবসাইটে (www.sevasindhu.karnataka.gov.in)। ৩ হাজার পাসের মধ্যে মাত্র ১০০টি আবেদন করা হয়েছে, এবং নাগরিকদের উৎসবে অংশ নেওয়ার জন্য আবেদন করতে আহ্বান জানানো হয়েছে। সাধারণ দর্শনার্থীদের জন্য আলাদা গেট ও সিটিং ব্লক নির্ধারণ করা হয়েছে। নিরাপত্তা ব্যবস্থার অংশ হিসেবে সিসিটিভি, ব্যাগ স্ক্যানার, মেডিকেল টিম ও জরুরি অ্যাম্বুলেন্স প্রস্তুত রাখা হয়েছে।
স্বাধীনতা দিবসের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট স্মরণ করলে জানা যায়, ১৫ আগস্ট ১৯৪৭ সালে ভারত ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীনতার স্বাদ গ্রহণ করে। সেই দিন মধ্যরাতে পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু তাঁর বিখ্যাত “ট্রিস্ট উইথ ডেসটিনি” ভাষণে জাতির কাছে স্বাধীনতার নব দিগন্ত উন্মোচন করেন। সেই দিন থেকেই প্রতি বছর ১৫ আগস্ট জাতীয় ছুটির দিন হিসেবে পালন করা হয়, যখন দেশজুড়ে সরকারি ভবনে জাতীয় পতাকা উত্তোলন, কুচকাওয়াজ ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়। স্বাধীনতা সংগ্রামীদের আত্মত্যাগ স্মরণে এই দিনটি এক অনন্য মর্যাদাপূর্ণ মুহূর্ত হয়ে থাকে ভারতের ইতিহাসে।
এই বছরের থিম “নয়া ভারত” কেবলমাত্র বর্তমানের অর্জন উদযাপন নয়, বরং ভবিষ্যতের জন্য দেশের লক্ষ্য নির্ধারণের প্রতিশ্রুতি। ২০৪৭ সালের মধ্যে ভারতকে একটি বিকসিত, নিরাপদ, শক্তিশালী ও সমৃদ্ধ রাষ্ট্রে পরিণত করার লক্ষ্যে এই থিম দেশের প্রতিটি নাগরিককে উৎসাহিত করছে। এই উদযাপন কেবল অনুষ্ঠানমাত্র নয়, বরং এক জাতীয় চেতনার জাগরণ – একটি ঐক্যবদ্ধ, আত্মবিশ্বাসী ও উদ্যমী ভারতের প্রতীক।

