ইসলামাবাদ/নয়াদিল্লি, ১২ আগস্ট : ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ এবং পরমাণু আক্রমণের হুমকি ছুঁড়ে দেওয়ার ঠিক কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই পাকিস্তান এবার শান্তিপূর্ণ বার্তা দিয়ে ভারতের কাছে ইন্দাস জল চুক্তির কার্যকারিতা পুনরায় শুরু করার আবেদন জানিয়েছে।
গত এপ্রিল মাসে জম্মু-কাশ্মীরের পহেলগামে জঙ্গি হামলার পর, ভারত এই ঐতিহাসিক জল চুক্তির কার্যকারিতা স্থগিত রাখে। পাকিস্তানের সামরিক প্রধান জেনারেল আসিম মুনির এবং প্রাক্তন পররাষ্ট্রমন্ত্রী বিলাওয়াল ভুট্টো সম্প্রতি ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধের হুঁশিয়ারি দেওয়ার পর, এই আবেদন কূটনৈতিক মহলে বিস্ময় তৈরি করেছে।
সোমবার (১১ আগস্ট) পাকিস্তানের বিদেশ মন্ত্রক এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, তারা ভারতের কাছে আহ্বান জানাচ্ছে সিন্ধু জল চুক্তির কার্যকরী বাস্তবায়ন অবিলম্বে পুনরায় চালু করতে।
এক্স-এ প্রকাশিত বিবৃতিতে বলা হয়েছে, “আমরা ভারতকে অনুরোধ করছি ইন্দাস জল চুক্তির স্বাভাবিক কার্যক্রম অবিলম্বে পুনরায় শুরু করতে এবং এই চুক্তির সব শর্ত পূর্ণ সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করতে।”
পাকিস্তান আদালতের সিদ্ধান্তকে ‘গুরুত্বপূর্ণ ব্যাখ্যা’ বলে স্বাগত জানিয়ে আরও জানিয়েছে, চুক্তি অনুযায়ী পশ্চিমাঞ্চলীয় নদীগুলি—চেনাব, ঝেলাম এবং সিন্ধু—এর জল প্রবাহিত রাখতে হবে যাতে পাকিস্তান তা অনিরুদ্ধভাবে ব্যবহার করতে পারে।
তারা দাবি করেছে, ভারতের তৈরি নতুন জলবিদ্যুৎ প্রকল্পগুলির ডিজাইন “চুক্তির নির্দিষ্ট শর্ত” অনুসারে হতে হবে, ভারতের নিজস্ব ‘আদর্শ’ বা ‘সেরা চর্চা’ অনুযায়ী নয়।
ভারতের দিক থেকে বলা হয়েছে, পাকিস্তান বারবার চুক্তির অপব্যবহার করে আন্তর্জাতিক মহলকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করেছে। ১৯৬০ সালে বিশ্বব্যাঙ্কের মধ্যস্থতায় স্বাক্ষরিত ইন্দাস চুক্তি অনুযায়ী, ভারতকে দেওয়া হয়েছে বেস, শতদ্রু ও রবি নদীর পূর্ণ অধিকার এবং পাকিস্তানকে দেওয়া হয়েছে সিন্ধু, ঝেলাম ও চেনাব নদীর অধিকার।
কিন্তু পাকিস্তান ভারতের হিমাচল ও জম্মু-কাশ্মীর অঞ্চলে গড়ে ওঠা জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের ডিজাইন নিয়ে বারবার আপত্তি জানিয়ে থাকে।
এপ্রিল মাসে জম্মু-কাশ্মীরের পহেলগামে ঘটে যাওয়া জঙ্গি হামলার পর, যাতে ভারতীয় সেনাবাহিনীর সদস্যরা শহিদ হন, ভারত চুক্তির কার্যকারিতা ‘অস্থায়ীভাবে স্থগিত’ রাখে এবং জানায়, সন্ত্রাসবাদকে সমর্থন করা দেশের সঙ্গে আর কোনো ‘বিশ্বাসভিত্তিক দ্বিপাক্ষিক চুক্তি’ বজায় রাখা সম্ভব নয়।
এই শান্তিপূর্ণ অনুরোধের আগে ও পরে, পাকিস্তানের শীর্ষ নেতাদের মুখে উঠে এসেছে চরম যুদ্ধংদেহী বক্তব্য।
প্রাক্তন পররাষ্ট্রমন্ত্রী বিলাওয়াল ভুট্টো বলেন, “মোদি সরকারের পদক্ষেপ পাকিস্তানের উপর চরম ক্ষতি এনেছে। পুরো পাকিস্তানকে একজোট হয়ে এর মোকাবিলা করতে হবে। যদি ভারত এই পথে চলতে থাকে, তাহলে পাকিস্তানের কাছে আর কোনো পথ থাকবে না—আমরা যুদ্ধ ছাড়া বিকল্প ভাবতে পারি না।”
তিনি আরও বলেন, পাকিস্তানের জনগণ ‘যুদ্ধ করে ছয়টি নদী পুনরুদ্ধার করার জন্য যথেষ্ট শক্তিশালী’।
এর আগে পাকিস্তানের সেনাপ্রধান জেনারেল আসিম মুনির বলেন, “যদি ভবিষ্যতে ভারতের সঙ্গে যুদ্ধ হয় এবং পাকিস্তান অস্তিত্বের সংকটে পড়ে, তাহলে তা পারমাণবিক যুদ্ধের রূপ নিতে পারে, যা বিশ্ববাসীর অর্ধেককেই ধ্বংস করতে পারে।”
এই হুমকিগুলি শুধু ভারতের উদ্দেশেই নয়, বরং আন্তর্জাতিক মহলের প্রতিও একটি বার্তা বলে মনে করছে কূটনৈতিক মহল।
একদিকে পরমাণু যুদ্ধের হুমকি, অন্যদিকে ইন্দাস চুক্তির আবেদন—এই দ্বিচারিতাকে নিয়ে উঠেছে নানা প্রশ্ন। আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, পাকিস্তান বর্তমানে কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক চাপের মুখে রয়েছে।
চীন এবং মধ্যপ্রাচ্যের আর্থিক সহায়তা ব্যাহত, আইএমএফ-এর কড়া শর্ত, এবং অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে পাকিস্তান চায় ভারতের সঙ্গে উত্তেজনা না বাড়িয়ে বিশ্বমঞ্চে ‘শান্তিপ্রিয় রাষ্ট্র’ হিসেবে পরিচিতি বজায় রাখতে।
সেই কারণেই একদিকে আগ্রাসী বক্তব্য, অন্যদিকে শান্তিপূর্ণ অনুরোধ—দুটিই কৌশলগত চাল হতে পারে।
এখনও পর্যন্ত ভারত সরকার পাকিস্তানের সর্বশেষ জলচুক্তি পুনরারম্ভ সংক্রান্ত দাবির বিষয়ে আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া দেয়নি।
তবে সরকারি সূত্রে ইঙ্গিত মিলেছে, পাকিস্তান সন্ত্রাসবাদ ও যুদ্ধের হুমকি না থামানো পর্যন্ত, কোনো ‘বিশ্বাসভিত্তিক চুক্তি’ পুনরায় চালু করার সম্ভাবনা নেই।
ইন্দাস জল চুক্তি, যা কয়েক দশক ধরে দুই দেশের মধ্যে একটি কার্যকর সহযোগিতার প্রতীক ছিল, এখন রাজনৈতিক ও কৌশলগত চাপের যাঁতাকলে পড়েছে। পাকিস্তান যদি সত্যিই চায় চুক্তির কার্যকারিতা ফেরাতে, তাহলে সন্ত্রাসবাদ থেকে সরে এসে, বিশ্বাসযোগ্য শান্তিপ্রয়াসের প্রমাণ রাখতে হবে—এটাই ভারতের অঘোষিত বার্তা।

