‘আমাদের পাশে ব্রিকস সহযোগীরা আছে’ — ট্রাম্পের শুল্ক হুমকির জবাবে মস্কোর তীব্র প্রতিক্রিয়া রাশিয়ার

মস্কো, ৫ আগস্ট: যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সম্প্রতি যে নতুন শুল্ক নীতি ঘোষণা করেছেন, তার তীব্র সমালোচনায় মুখর হয়েছে রাশিয়া। দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মারিয়া জাখারোভা সোমবার এক বিবৃতিতে বলেন, ওয়াশিংটন এখনো “নব্য-ঔপনিবেশিক” মনোভাব ত্যাগ করতে পারেনি এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অর্থনৈতিক চাপ সৃষ্টি করে বিশ্বের অন্যান্য স্বাধীন দেশকে বাধ্য করার চেষ্টা করছে। এই প্রসঙ্গে তিনি স্পষ্ট ভাষায় বলেন, ‘‘আমরা ইতিহাসের স্বাভাবিক গতিতে বিশ্বাস করি, এবং কোনও শুল্ক যুদ্ধ কিংবা নিষেধাজ্ঞা তা থামাতে পারবে না।’’

জাখারোভা জানান, যুক্তরাষ্ট্র বর্তমানে যে বহুপাক্ষিক শক্তির বিরুদ্ধে অবস্থান নিচ্ছে, তা এক ধরনের আধিপত্যবাদী মনোভাবের প্রতিফলন। তিনি বলেন, ‘‘আজকের যুগে যখন বিশ্ব একটি বহু-মেরুকেন্দ্রিক কাঠামোর দিকে অগ্রসর হচ্ছে, তখন ওয়াশিংটনের একক আধিপত্যের ভাবনা একটি অচল দৃষ্টিভঙ্গি। তারা যেসব দেশ স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করছে তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা, শুল্ক এবং অর্থনৈতিক বাধার মাধ্যমে চাপে রাখার চেষ্টা করছে। এটা কেবল বৈশ্বিক স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি নয়, বরং আন্তর্জাতিক আইনের পরিপন্থী।’’

সাবেক প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সম্প্রতি তার নির্বাচনী প্রচারের সময় এক বিবৃতিতে জানান, তিনি ক্ষমতায় ফিরলে একাধিক দেশের ওপর “ব্যাপক হারে” নতুন আমদানি শুল্ক আরোপ করবেন। এর মধ্যে ভারত, চীন, ব্রাজিলসহ বেশ কয়েকটি দেশ রয়েছে যারা রাশিয়ার সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বজায় রেখেছে বা বাড়িয়েছে।

বিশেষভাবে ভারতকে লক্ষ্য করে ট্রাম্প বলেন, ‘‘ভারত রাশিয়া থেকে বিপুল পরিমাণে তেল কিনছে এবং পরে তা প্রক্রিয়াজাত করে খোলা বাজারে বিক্রি করছে—এতে তারা বড় মুনাফা করছে। অথচ তারা যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে শুল্ক ছাড়ে প্রবেশাধিকার পাচ্ছে। এটা বন্ধ হওয়া উচিত।’’

ট্রাম্পের এই বক্তব্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে ভারতও। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে জানায়, ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর পশ্চিমা বিশ্ব যখন রাশিয়ার জ্বালানি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছিল, তখন আমেরিকাই প্রথম ভারতকে রাশিয়া থেকে তেল আমদানির জন্য উৎসাহ দিয়েছিল।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, ‘‘ভারতের তেল আমদানি একটি বাস্তবতা, বৈশ্বিক বাজার পরিস্থিতির বাধ্যবাধকতা। এ বিষয়ে যারা ভারতকে সমালোচনা করছে, তারা নিজেরাই রাশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক বজায় রেখেছে—যা কোনো প্রয়োজনে বাধ্যতামূলক নয়। এটি দ্বিচারিতা ছাড়া কিছু নয়।’’

রাশিয়া জানিয়েছে, তারা যুক্তরাষ্ট্রের একতরফা নীতির বিরুদ্ধে গ্লোবাল সাউথের দেশগুলোর সঙ্গে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে প্রস্তুত। জাখারোভা বলেন, ‘‘আমরা ব্রিকস সহযোগীদের সাথে সম্পর্ক জোরদারে অঙ্গীকারবদ্ধ। আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি হচ্ছে একটি সত্যিকার অর্থে বহুপাক্ষিক ও ন্যায়সংগত বিশ্বব্যবস্থা গঠন।’’

ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন ও দক্ষিণ আফ্রিকা নিয়ে গঠিত ব্রিকস জোটটি ২০২৪ সালে প্রসারিত হয়। নতুন সদস্য হিসেবে মিশর, ইথিওপিয়া, ইরান ও সংযুক্ত আরব আমিরাত যোগ দেয়। আর ২০২৫ সালের শুরুতে ইন্দোনেশিয়াও সদস্যপদ লাভ করে।

জাখারোভা বলেন, ‘‘এই সম্প্রসারণ প্রমাণ করে যে বিশ্ব এখন একমুখী আধিপত্য থেকে বেরিয়ে একটি ভারসাম্যপূর্ণ বহুপাক্ষিক কাঠামোর দিকে অগ্রসর হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক ও নিষেধাজ্ঞার নীতি সরাসরি এসব দেশের সার্বভৌমত্বে হস্তক্ষেপ এবং আন্তর্জাতিক অর্থনীতিতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করছে।’’

তিনি আরও বলেন, ‘‘যে সমস্ত পশ্চিমা দেশ এক সময় মুক্তবাজার ও অবাধ বাণিজ্যের আদর্শ প্রচার করত, এখন তারাই রাজনৈতিক কারণে শুল্ক বাড়িয়ে যাচ্ছে। এটা নিছক সঙ্কীর্ণ স্বার্থের প্রতিফলন এবং এতে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।’’

বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, ট্রাম্প আবারও প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে বিশ্ববাণিজ্য আরও সংকটে পড়বে। তার আগের মেয়াদেও চীন, ইউরোপ, এমনকি কানাডার সঙ্গেও বাণিজ্য যুদ্ধের পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল।

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক ড. অভিজিৎ চৌধুরী বলেন, ‘‘রাশিয়া এবং ভারতসহ ব্রিকস দেশগুলো একযোগে যদি এই ধরনের একতরফা বাণিজ্য নীতির বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়, তাহলে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য তা কৌশলগতভাবে চাপ সৃষ্টি করবে। ট্রাম্পের নীতি স্বল্পমেয়াদে মার্কিন অভ্যন্তরীণ বাজারকে রক্ষা করলেও দীর্ঘমেয়াদে তার নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।’’