নয়াদিল্লি, ৫ আগস্ট : ভারতের নির্বাচন কমিশনের (ইসিআই) নিরপেক্ষতা ও স্বচ্ছতা নিয়ে বড়সড় প্রশ্নচিহ্ন উঠে এসেছে ২০২৪ সালের সাধারণ নির্বাচনের পরে। লোকসভায় বিরোধী দলনেতা রাহুল গান্ধী সম্প্রতি কমিশনের বিরুদ্ধে একাধিক গুরুতর অভিযোগ তুলেছেন, যা দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মূল স্তম্ভের ওপর আস্থা নিয়ে সংকট সৃষ্টি করেছে।
রাহুল গান্ধীর দাবি, নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় ব্যাপক গড়মিল ও অনিয়ম হয়েছে, যার পূর্ণাঙ্গ তথ্য তিনি পর্যায়ক্রমে প্রকাশ করবেন। তার এই বক্তব্যের প্রেক্ষিতে রাজনৈতিক মহলে তীব্র আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে। তিনি সরাসরি নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা ও তাদের কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। এর ফলে সাধারণ ভোটার থেকে শুরু করে রাজনৈতিক দলগুলোতেও নতুন করে উদ্বেগ ছড়িয়েছে।
রাহুল গান্ধীর অভিযোগের মূল কেন্দ্রে রয়েছে ভিভিপ্যাট (ভোটার ভেরিফায়েবল পেপার অডিট ট্রেল) ব্যবস্থার স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন। ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম)-এর তিনটি মূল অংশ — ব্যালট ইউনিট, কন্ট্রোল ইউনিট এবং ভিভিপ্যাট-এর মধ্যে ভিভিপ্যাটই একমাত্র অংশ যাতে কেন্দ্রীয়ভাবে সফটওয়্যার ইনস্টল করা হয় এবং তা সরাসরি কন্ট্রোল ইউনিটের সঙ্গে সংযুক্ত থাকে।
নির্বাচন কমিশন যদিও দাবি করে এসেছে যে ইভিএম এবং ভিভিপ্যাট ট্যাম্পার প্রুফ, তবে কমিশনের তরফ থেকে যেভাবে ভিভিপ্যাটের স্বচ্ছতা এবং র্যান্ডম ট্যালির (যেখানে ভিভিপ্যাটের স্লিপ মিলিয়ে দেখা হয় ইভিএমের সঙ্গে) বিষয়টি পরিচালনা করা হচ্ছে, তাতে গভীর প্রশ্ন উঠে এসেছে। বর্তমানে এই র্যান্ডম ট্যালি প্রক্রিয়াটি অনেকেই “সম্পূর্ণরূপে খামখেয়ালি এবং অবৈজ্ঞানিক” বলে অভিহিত করছেন।
রাহুল গান্ধীর মতে, এই ট্যালি প্রক্রিয়া এতটাই সীমিত যে তা থেকে কোনও অর্থবহ পরিসংখ্যান পাওয়া যায় না, এবং এটি জনমানসে আস্থা ফিরিয়ে আনার পরিবর্তে সন্দেহ আরও গভীর করে তোলে।
নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে শুধু ভিভিপ্যাট ইস্যু নয়, আরও একাধিক অভিযোগ উঠেছে। অভিযোগ রয়েছে, নির্বাচনের সময়সূচি নির্ধারণ থেকে শুরু করে, আদর্শ আচরণবিধি প্রয়োগ, ভোটার তালিকা সংশোধন, ভোট গণনা, এবং অভিযোগ নিষ্পত্তি—প্রতিটি পর্যায়েই কমিশনের নিরপেক্ষতা ও দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।
যদিও নির্বাচন কমিশন বিভিন্ন সময়ে বলেছে যে তারা আইনের নিরিখেই কাজ করে এবং ইভিএম সংক্রান্ত সব অভিযোগ ভিত্তিহীন, তবুও তারা অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে যথাযথ তথ্য প্রকাশ করতে ব্যর্থ হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, কমিশন এখনও পর্যন্ত ভিভিপ্যাট সফটওয়্যার এবং তার অডিটিং প্রক্রিয়া নিয়ে বিস্তারিত কোনও তথ্য প্রকাশ করেনি, যা স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
এর আগে রাজনৈতিক নেতারা নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। এমনকি বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিও যখন গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন, তখন তিনি ইসিআই-এর ভূমিকা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছিলেন। সেইসব অভিযোগ অনেক সময় রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে উড়িয়ে দেওয়া হলেও, এবারের পরিস্থিতি কিছুটা ভিন্ন। কারণ, নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে অভিযোগ শুধু রাজনৈতিক রণকৌশলের অংশ নয়, বরং জনগণের বিশ্বাসহীনতার দিকে ইঙ্গিত করছে।
বিহারেও সম্প্রতি একটি বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। রাজ্যের বিরোধী দলনেতা তেজস্বী যাদব অভিযোগ করেছেন, খসড়া ভোটার তালিকায় তার নাম নেই। পরে দেখা যায়, তার দাবি করা এপিক(ভোটার পরিচয়পত্র) নম্বরটি নির্বাচন কমিশনের ডেটাবেসে অন্য নামের সঙ্গে যুক্ত। এই ঘটনা কমিশনের ভোটার তালিকা প্রস্তুতির ওপর আস্থাহীনতা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।
একটি সুস্থ গণতন্ত্রের মূল ভিত্তি হল, নির্বাচনী প্রক্রিয়া স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ এবং বিশ্বাসযোগ্য হওয়া। এটি এমন এক প্রক্রিয়া যেখানে হারজিতের পরেও সবাই মেনে নেয় যে, ফলাফল একটি ন্যায়সংগত ও স্বচ্ছ পদ্ধতির মাধ্যমে এসেছে। কিন্তু যদি হারে যাওয়া পক্ষ মনে করে যে প্রক্রিয়াটি পক্ষপাতদুষ্ট ছিল, তবে গণতন্ত্রে একটি গভীর সংকট তৈরি হয়।
বর্তমান পরিস্থিতিতে এটাই ঘটছে। রাহুল গান্ধী যেসব অভিযোগ তুলেছেন এবং আরও যেসব তথ্য সামনে আনার কথা বলছেন, তা যদি বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণসহ আসে, তাহলে দেশের নির্বাচনী ব্যবস্থার প্রতি জনগণের আস্থায় বড় ধাক্কা লাগবে।
রাজনৈতিক দলগুলোর দায়িত্ব রয়েছে তারা যেন নির্বাচনী প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন তোলে তথ্যভিত্তিকভাবে ও যথাযথ প্রমাণের ভিত্তিতে। একই সঙ্গে, নির্বাচন কমিশনেরও উচিত, নিজেদের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বাড়ানো। নাগরিক সমাজ, মিডিয়া ও আদালতের ভূমিকা থাকলেও, শেষ পর্যন্ত এটি কমিশনের ওপরই নির্ভর করে তারা কতটা স্বচ্ছতা দেখাতে প্রস্তুত।
বর্তমান পরিস্থিতিতে নির্বাচন কমিশনের উচিত, একটি স্বাধীন ও স্বচ্ছ তদন্তের উদ্যোগ নেওয়া, এবং ভিভিপ্যাটসহ অন্যান্য প্রযুক্তিগত বিষয়ে বিস্তারিত ব্যাখ্যা জনগণের সামনে তুলে ধরা। শুধু রাজনৈতিক দল নয়, জনগণের মধ্যেও আস্থা ফিরিয়ে আনা এখন জরুরি। নইলে, ভবিষ্যতের জন্য ভারতের গণতান্ত্রিক ভিত্তি আরও নড়বড়ে হয়ে পড়বে।

