নয়াদিল্লি, ৪ আগস্ট : মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ২৫% শুল্ক আরোপ এবং রাশিয়া সঙ্গে বাণিজ্য অব্যাহত রাখার বিরুদ্ধে সতর্কতার মধ্যে, ভারত সরকার শক্ত অবস্থানে দাঁড়িয়েছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, একদিকে যেখানে মার্কিন প্রেসিডেন্টের শুল্ক আরোপ এবং রাশিয়া সম্পর্কের বিষয়ে কঠোর প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করছেন, সেখানে তিনি দেশবাসীকে ‘স্বদেশি’ পণ্য কেনার আহ্বান জানিয়ে চলেছেন। প্রধানমন্ত্রী মোদি তার সরকারের স্থানীয় উৎপাদন ও ভোগ ব্যবহারে জোর দেয়ার প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন, যা তার দীর্ঘকালীন ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ উদ্যোগের অংশ হিসেবে বিবেচিত।
শনিবার, উত্তর প্রদেশে এক জনসভায় প্রধানমন্ত্রী মোদি বলেন, “বিশ্ব অর্থনীতি অনেক অনিশ্চয়তার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে এবং এর প্রভাব আমাদের উপর পড়বে। তবে আমাদের দেশের স্বার্থ রক্ষা করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এখন থেকে, আমরা যা কিছু কিনব, তার একমাত্র মানদণ্ড হওয়া উচিত—এগুলো ভারতীয় শ্রমে তৈরি।”
মোদি তার বক্তৃতায় এইও বলেন, “বিশ্ব অর্থনীতিতে এক ধরনের অস্থিরতা চলছে, যার কারণে আমাদের নিজেদের পণ্য কেনা এবং দেশীয় শিল্পকে সহায়তা করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।” তার এই বার্তা স্পষ্টভাবে “মেক ইন ইন্ডিয়া” প্রকল্পের প্রতি সরকারের অঙ্গীকারকে তুলে ধরে, যেখানে দেশীয় উৎপাদনকে উৎসাহিত করা এবং ভারতের ছোট শিল্প ও কৃষকদের সহায়তা করা হবে। তিনি আরও যোগ করেন, “আমাদের কৃষক, ছোট শিল্প এবং যুবকদের কর্মসংস্থান নিরাপদ করতে হবে।”
যদিও যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে রাশিয়া থেকে তেল আমদানি বন্ধ করার জন্য চাপ সৃষ্টি করছে, তবুও ভারত সরকার এখনও তার অবস্থানে অটল রয়েছে। ব্লুমবার্গের খবরে বলা হয়েছে, ভারত সরকার এখনও রাশিয়া থেকে তেল ক্রয় বন্ধ করার কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেনি। ভারতীয় রিফাইনারি গুলোকে তাদের তেল সরবরাহের উৎস বেছে নেওয়ার স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে। এদিকে, নিউ ইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদন অনুসারে, ভারত রাশিয়া থেকে তেল কেনার প্রক্রিয়া অব্যাহত রেখেছে, যদিও ট্রাম্প প্রশাসন পরোক্ষভাবে এর বিরুদ্ধে সতর্কতা জারি করেছে।
ভারত রাশিয়া থেকে তেল ক্রয়ের ক্ষেত্রে একটি বিশাল প্রবৃদ্ধি দেখিয়েছে, যেখানে রাশিয়া থেকে সস্তায় তেল কেনার সুযোগ কাজে লাগিয়ে ভারত প্রায় এক-তৃতীয়াংশ তেল আমদানি করছে রাশিয়া থেকে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং যুক্তরাষ্ট্র এই পদক্ষেপকে রাশিয়ার বিরুদ্ধে ইউক্রেনের যুদ্ধের সমর্থন হিসেবে দেখছে। এমন পরিস্থিতিতে, ভারতীয় রিফাইনারি গুলোর জন্য রাশিয়া থেকে তেল কেনা সস্তা হওয়া সত্ত্বেও এটি যুক্তরাষ্ট্রের কাছে বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে ভারতকে চাপ দেওয়া হচ্ছে, কারণ তারা রাশিয়া থেকে তেল ক্রয় অব্যাহত রেখেছে এবং এর ফলে ইউক্রেনের যুদ্ধের অর্থায়নে অবদান রাখছে। ট্রাম্প প্রশাসনের উপ-প্রধানমন্ত্রীর স্টিফেন মিলার সম্প্রতি বলেছেন, “ভারতকে বাস্তববাদী হতে হবে। তারা যদি এই যুদ্ধের অর্থায়নে অংশ নেয়, তবে এর পরিণতি হতে পারে।” মিলার আরও যোগ করেছেন, “আমরা ভারতকে একদিন আমাদের শক্তিশালী বন্ধু হিসেবে দেখেছি, তবে এখন তারা রাশিয়া থেকে তেল কিনছে। আমাদের উচিত তাদের এ বিষয়ে বাস্তব পরিস্থিতি বুঝতে সাহায্য করা।”
তিনি উল্লেখ করেন, “যুক্তরাষ্ট্রের জন্য এই বিষয়টি অত্যন্ত গুরুতর, এবং আমরা সব ধরনের পদক্ষেপ নিতে প্রস্তুত আছি, যাতে এই যুদ্ধের অবসান ঘটানো যায়।”
এটি একটি বড় কূটনৈতিক পরিবর্তন, কারণ যুক্তরাষ্ট্র আগে ভারতকে চীনের বিরুদ্ধে একটি শক্তিশালী কৌশলগত অংশীদার হিসেবে দেখেছিল। দীর্ঘদিন ধরে ভারত-রাশিয়া সম্পর্ক উষ্ণ ছিল এবং ভারত রাশিয়ার কাছ থেকে অস্ত্র এবং সামরিক সরঞ্জাম আমদানি করতো। তবে, ট্রাম্প প্রশাসন এখন রাশিয়ার উপর চাপ তৈরি করার জন্য ভারতের এই সম্পর্ককে সমালোচনা করছে।
ইউক্রেনের যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে, যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে রাশিয়ার বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়ার জন্য চাপ দিয়ে যাচ্ছে। তবে ভারতের সরকার তার নিজস্ব আঞ্চলিক এবং বৈদেশিক নীতির অধীনে এ বিষয়ে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে চায় এবং তা যুক্তরাষ্ট্রের চাপের বাইরে।
ভারত সরকার তার দীর্ঘদিনের রাশিয়া সম্পর্ককে গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করছে, এবং সরকারের পক্ষ থেকে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে, ভারতের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভিন্ন দেশের মধ্যে স্বাধীনভাবে বিচার করা উচিত। ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রন্ধীর জয়সওয়াল বলেন, “ভারতের রাশিয়া সম্পর্ক একটি সময়-পরীক্ষিত অংশীদারিত্ব। আমরা আমাদের সম্পর্কগুলো স্বাধীনভাবে বিবেচনা করি এবং কোনো অন্য দেশের দৃষ্টিকোণ থেকে তাদের মূল্যায়ন করা উচিত নয়।”
ভারত এবং যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে একাধিক বাণিজ্য আলোচনা এবং দ্বিপাক্ষিক চুক্তি সত্ত্বেও, ভারতের রাশিয়া সম্পর্ক এবং তেলের ক্রয় নিয়ে আলোচনা তীব্রতর হতে পারে। তবে, ভারতের অবস্থান স্পষ্ট—দেশীয় স্বার্থ রক্ষা করা তাদের প্রথম অগ্রাধিকার, এবং এতে তারা কোনো ধরনের আপোষ করতে প্রস্তুত নয়।
ভারত-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের ভবিষ্যত অনিশ্চিত, বিশেষত রাশিয়া থেকে তেল ক্রয় এবং শুল্ক নিয়ে উত্তেজনা বাড়ছে। তবে, ভারত তার আঞ্চলিক স্বার্থ এবং বৈদেশিক নীতি বজায় রেখে চলবে, এবং এ পরিস্থিতিতে শীঘ্রই ভারত এবং যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে আলোচনা আরও তীব্র হবে।

