ডোনাল্ড ট্রাম্পের ‘মৃত অর্থনীতি’ মন্তব্যের বিরুদ্ধে ভারতের অর্থনৈতিক বাস্তবতা

নতুন দিল্লি, ৩ আগস্ট : যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ভারতের অর্থনীতি সম্পর্কে ‘মৃত’ মন্তব্য করলেও, বিশ্বব্যাপী প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলির বিশ্লেষণ বলে কিছুটা ভিন্ন গল্প। ভারতের অর্থনীতি কিছুটা মন্থর হতে পারে, বিশেষত বৈশ্বিক অনিশ্চয়তা এবং শুল্কযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে, তবে সত্ত্বেও দেশটি বিশ্বের দ্রুততম বর্ধনশীল বড় অর্থনীতি হিসেবে ৬ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি অর্জন করবে বলে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে।

ট্রাম্পের মন্তব্য এবং তার আক্রমণমূলক সোশ্যাল মিডিয়া পোস্ট ভারতীয় অর্থনীতি নিয়ে যে হতাশা এবং সংশয় সৃষ্টি করতে চায়, তা তেমন কার্যকর হয়নি। বরং, ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে দীর্ঘদিনের সম্পর্ক এবং নানা ক্ষেত্রের সহযোগিতা থেকে পরিষ্কার প্রমাণ মেলে যে, দুই দেশের মধ্যে সহযোগিতা যথেষ্ট গভীর এবং ভবিষ্যতের জন্য আশাব্যঞ্জক।

ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থা এবং যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ সংস্থা নাসা-র যৌথ উদ্যোগ ‘নিসার স্যাটেলাইট’ উৎক্ষেপণের মাধ্যমে দুই দেশের মধ্যে মহাকাশ প্রযুক্তি ক্ষেত্রে যে দৃঢ় সহযোগিতা হয়েছে, তা ভারতীয় অর্থনীতির শক্তিশালী অবস্থানকে আরও দৃঢ় করে। নিসার, পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী স্যাটেলাইট, গত সপ্তাহে মহাকাশে উৎক্ষেপণ করা হয়েছে, যা এক দশকেরও বেশি সময় ধরে ভারত এবং যুক্তরাষ্ট্রের বিজ্ঞানীরা উন্নয়ন করেছেন।

এছাড়া, ইসরো আগামী কয়েক মাসে যুক্তরাষ্ট্রের এএসটি স্পেসমোবাইল দ্বারা তৈরি ব্লক 2 ব্লুবার্ড যোগাযোগ স্যাটেলাইটও উৎক্ষেপণ করতে যাচ্ছে। এ ধরনের যৌথ উদ্যোগের মাধ্যমে ভারতের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক আরও শক্তিশালী হয়েছে, যা দেশটির প্রযুক্তিগত ক্ষমতা এবং অর্থনৈতিক দৃঢ়তা প্রদর্শন করছে।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ফেব্রুয়ারির যুক্তরাষ্ট্র সফরের সময়, দুই দেশের মধ্যে নতুন বাণিজ্যিক উদ্যোগ নিয়ে আলোচনা হয়েছে। বিশেষত “ট্রান্সফরমিং রিলেশনশিপ ইউটিলাইজিঙ স্ট্র্যাটেজিক টেকনোলজি” উদ্যোগের মাধ্যমে খনিজ সংগ্রহ ও প্রক্রিয়াজাতকরণে সহযোগিতা বাড়ানো হবে। ভারতীয় সরকারের মতে, এই উদ্যোগের লক্ষ্য হলো লিথিয়াম এবং বিরল পৃথিবী উপাদানগুলির পুনরুদ্ধার এবং প্রক্রিয়াজাতকরণে সহযোগিতা জোরদার করা, যা আগামীদিনে দুই দেশের মধ্যে আরও নিবিড় বাণিজ্যিক সম্পর্কের ভিত্তি তৈরি করবে।

এছাড়া, গত ২০২৪ সালে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে পণ্য বাণিজ্যের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১২৯.২ বিলিয়ন ডলার, যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের আমদানি বৃদ্ধি পেয়েছে ৩.৪ শতাংশ। ভারতে তৈরি স্মার্টফোনের রপ্তানি, বিশেষ করে অ্যাপলের আইফোন, যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বিশেষ ভূমিকা পালন করছে। এটাই প্রমাণ করে যে, ভারত এখন যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যিক প্রবৃদ্ধির জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার।

যদিও কিছু বিশ্ব অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের কারণে ভারতীয় অর্থনীতি কিছুটা ধীরগতিতে চলতে পারে, তবে ভারতকে ‘মৃত অর্থনীতি’ হিসেবে চিহ্নিত করা যায় না। বর্তমান সময়ের হিসাব অনুযায়ী, ভারত ২০২৪ সালে বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম অর্থনীতি হিসেবে ৩.৯ ট্রিলিয়ন ডলার জিডিপি অর্জন করেছে। এবং এই প্রবৃদ্ধি আগামী বছরগুলিতে আরও শক্তিশালী হবে। আইএমএফ-এর ২০২৮ সালের পূর্বাভাস অনুযায়ী, ভারত জার্মানি এবং জাপানকে পেছনে ফেলে বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি হবে।

এছাড়া, আইএমএফ-এর সর্বশেষ পূর্বাভাসে ভারতের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ২০২৫-২৬ এবং ২০২৬-২৭ সালে ৬.৪ শতাংশ হতে পারে। আর ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংক, রিজার্ভ ব্যাংক অফ ইন্ডিয়া, ২০২৬ সালের জন্য ৬.৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস দিয়েছে। এমনকি, ভারতের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ও সম্ভাবনা সত্ত্বেও, কিছু সমস্যাও রয়েছে, যেমন সঙ্কুচিত ক্রেডিট প্রবৃদ্ধি এবং বেসরকারি খাতে বিনিয়োগের সীমাবদ্ধতা, যা মূলত রাজস্বসংগ্রহের দিক থেকে চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করতে পারে। তবে, এই সব সমস্যা ভারতের উন্নয়নশীল অর্থনীতির ক্ষেত্রে অপ্রাসঙ্গিক নয়।

ট্রাম্পের ভারতকে ‘মৃত’ অর্থনীতি হিসেবে আক্রমণ এবং ভারতীয় পণ্যসম্ভারের ওপর ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপের হুমকি, মূলত যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যিক আলোচনা নিয়ে হতাশা প্রকাশের একপ্রকার চাপ তৈরির কৌশল হিসেবে দেখা হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি সেক্রেটারি স্কট বেসেন্ট সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, “ভারত আলোচনা শুরু করেছিল দ্রুত, কিন্তু তা যথেষ্ট গতি পায়নি। আমরা এই বিলম্বের জন্য হতাশ।”

তবে, ভারতের প্রতিক্রিয়া ছিল দৃঢ়। বাণিজ্যমন্ত্রী পীয়ূষ গোয়েল জানিয়েছেন, ভারতের সরকার দেশের জাতীয় স্বার্থ রক্ষায় “সব প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ” নেবে। তাদের দাবি, ভারতও বাণিজ্যিক আলোচনা গতি বাড়ানোর জন্য যথাযথ পদক্ষেপ নিতে প্রস্তুত, কিন্তু তাতেও দেশটির দীর্ঘমেয়াদী স্বার্থের ক্ষতি হতে পারে না।

তবে, ভারতের অর্থনীতি যখন বিভিন্ন আন্তর্জাতিক চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে, তখন ট্রাম্পের ‘মৃত অর্থনীতি’ মন্তব্য যেন একটি ভুল দৃষ্টিভঙ্গি ছাড়া আর কিছুই নয়। ভারতের অর্থনীতি ক্রমেই শক্তিশালী হচ্ছে এবং ভবিষ্যতে আরও বড় স্থানে উঠে আসবে বলে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলির পূর্বাভাস স্পষ্ট করছে।