নয়াদিল্লি, ৩০ জুলাই : কাশ্মীরের পাহালগাম এলাকায় ২২ এপ্রিল সংঘটিত নৃশংস জঙ্গি হামলায় জড়িত তিন পাকিস্তানি সন্ত্রাসী ভারতে প্রবেশ করেছিল প্রায় তিন বছর আগে। গোপন সূত্র ও সরকারি কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে জানা গেছে, এদের সবাই লস্কর-ই-তইবা-এর সদস্য এবং দীর্ঘদিন ধরে কাশ্মীর উপত্যকায় সক্রিয় ছিল। তারা সম্প্রতি দাচিগাম জঙ্গলে সেনাবাহিনীর ‘অপারেশন মহাদেব’-এ নিহত হয়েছে।
এই তিনজন সন্ত্রাসীর নাম যথাক্রমে—সুলেমান ওরফে ফয়জল জট্ট, হামজা আফগানি এবং জিবরান। জানা গেছে, তারা ভারতে ঢুকেছিল ২০২২ সালের দিকে এবং গোপনে নিজেদের অবস্থান শক্ত করছিল। দীর্ঘ পরিকল্পনা এবং জটিল প্রস্তুতির পর তারা ২২ এপ্রিল ২০২৫-এ কাশ্মীরের জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্র পাহালগামে ভয়াবহ হামলা চালায়, যাতে ২৬ জন নিরীহ বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়।
সরকারি সূত্র জানায়, গত বছর এই তিনজন সন্ত্রাসী দুটি দলে ভাগ হয়ে যায়। একটি দলের নেতৃত্বে ছিল সুলেমান, অন্যটিতে ছিল একজন পাকিস্তানি জঙ্গি, যার নাম মুসা। সুলেমানের সঙ্গে নতুন অনুপ্রবেশকারী লস্কর-ই-তইবা সদস্যরা যোগ দেয় এবং তারা মূলত দাচিগাম ও আশপাশের এলাকায় সক্রিয় ছিল।
এই তিন সন্ত্রাসী হামলার পর থেকে দাচিগাম জাতীয় উদ্যানের জঙ্গলে আত্মগোপনে ছিল। তারা আধুনিক “আলট্রা হাই ফ্রিকোয়েন্সি ওয়্যারলেস সেট” ব্যবহার করছিল, যার মাধ্যমে সীমান্তপারের জঙ্গি নেটওয়ার্ক ও পাকিস্তান ভিত্তিক নির্দেশনাকেন্দ্রের সঙ্গে সংযোগ রাখা হতো। যদিও তাদের বার্তা গোপন রাখা হয়েছিল এবং এগুলো সরাসরি ইন্টারসেপ্ট করা যায়নি, তবে সেনাবাহিনী একটি দিকনির্দেশক যন্ত্রের মাধ্যমে সংকেত শনাক্ত করতে সক্ষম হয়। প্রথম সংকেত ২২ মে পাওয়া যায়।
সেনাবাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলি সংকেত ট্র্যাক করে দাচিগামের বিভিন্ন অঞ্চল ঘিরে ফেলে এবং একে একে সম্ভাব্য এলাকাগুলিকে চিহ্নিত করে অনুসন্ধান চালায়। অবশেষে ২২ জুলাই সেনাবাহিনী নিশ্চিত হয় যে এই তিন সন্ত্রাসী একটি নির্দিষ্ট এলাকায় লুকিয়ে আছে এবং অভিযান পরিকল্পনা করা হয়। ‘অপারেশন মহাদেব’-এর মাধ্যমে ২৮ জুলাই ওই তিনজনকে খতম করা হয়।
সুলেমান আগে থেকেই কাশ্মীরে সক্রিয় ছিল। সে ২০২৪ সালের ২০ অক্টোবর গান্ডেরবালের গাগানগির এলাকায় একটি নির্মাণ সংস্থার কর্মীদের উপর হামলায় জড়িত ছিল, যেখানে সাতজন প্রাণ হারিয়েছিল।
পাহালগাম হামলার দিন সন্ধ্যায়, স্থানীয় দুই ব্যক্তি—পরভেজ আহমেদ জোথার ও বশির আহমেদ জোথার—এই তিন সন্ত্রাসীকে একটি ‘ঢোক’ (পাহাড়ি কুঁড়েঘর)–এ আশ্রয় দিয়েছিল। ২২ জুন তাদেরকে জাতীয় তদন্ত সংস্থা গ্রেফতার করে।
এই ঘটনার পর কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ লোকসভায় জানান, নিহত তিন সন্ত্রাসীর কাছ থেকে পাকিস্তানি ভোটার আইডি কার্ড এবং পাকিস্তানি চকোলেট উদ্ধার হয়েছে। তিনি বলেন, “এটি প্রমাণ করে যে এই হামলার মূল পরিকল্পনা ও সমর্থন এসেছে পাকিস্তান থেকে।”
জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের ১২৬৭ স্যাংশনস কমিটির আওতায় গঠিত মনিটরিং টিমের সাম্প্রতিক রিপোর্টেও এই হামলার পেছনে পাকিস্তান-সমর্থিত সংগঠন লস্কর-ই-তইবা এবং তার প্রক্সি সংগঠন ‘দ্য রেজিস্ট্যান্স ফ্রন্ট’-এর জড়িত থাকার কথা বলা হয়েছে। টিআরএফ ২২ এপ্রিল হামলার দায় স্বীকার করে এবং হামলার সাইটের একটি ছবি প্রকাশ করে। ২৬ এপ্রিল তারা দাবি প্রত্যাহার করলেও, আর কোনো সংগঠন দায় স্বীকার করেনি।
এক সদস্য রাষ্ট্র জানিয়েছে, এই ধরনের একটি জটিল হামলা এলইটি-এর সহায়তা ছাড়া সম্ভব ছিল না এবং টিআরএফ মূলত এলইটি-এরই একটি ছায়া সংগঠন।
টিআরএফ এবং এলইটি-এর সংশ্লিষ্টতার কথা জাতিসংঘের রিপোর্টে উল্লেখ করা ভারতের কূটনৈতিক প্রচেষ্টার একটি বড় ফলাফল হিসেবে দেখা হচ্ছে। ভারত ২০২৩ সাল থেকে বিভিন্ন সময়ে টিআরএফ-এর বিরুদ্ধে তথ্যপ্রমাণ জাতিসংঘ ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থার কাছে তুলে ধরেছে। ২০২৪ সালের মে মাসে ভারত একটি বিশদ ডসিয়ার জাতিসংঘে জমা দেয় এবং টিআরএফ-এর কার্যক্রম, ভারতে হামলা এবং পাকিস্তানের সহায়তার বিষয়ে ব্রিফ করে।
এছাড়াও, টিআরএফ-কে সম্প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ‘বিদেশি সন্ত্রাসী সংগঠন’ এবং ‘বিশ্বব্যাপী বিশেষভাবে চিহ্নিত সন্ত্রাসী’ হিসেবে ঘোষণা করেছে। মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্ট জানিয়েছে, টিআরএফ বারবার ভারতের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী কার্যকলাপে যুক্ত থেকেছে এবং পাহালগাম হামলার দায়ভার এর উপর বর্তায়।
টিআরএফ ২০১৯ সালে গঠিত হয় এলইটি-এর প্রক্সি হিসেবে। ভারত ২০২৩ সালে টিআরএফ-কে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। সংগঠনটি অনলাইনের মাধ্যমে যুবকদের জঙ্গি কার্যকলাপে নিযুক্ত করছে, অস্ত্র ও মাদক পাচার করছে এবং সীমান্তের ওপার থেকে সন্ত্রাসী অনুপ্রবেশে সাহায্য করছে। এর প্রতিষ্ঠাতা শেখ সাজ্জাদ গুল বর্তমানে ভারতীয় সন্ত্রাস বিরোধী আইন ইউএপিএ-র অধীনে ঘোষিত সন্ত্রাসী।
পাহালগাম হামলার তদন্তে উঠে আসা তথ্য ও সংঘটিত ‘অপারেশন মহাদেব’ কেবলমাত্র একটি সফল সামরিক অভিযান নয়, বরং এটি পাকিস্তান-সমর্থিত সন্ত্রাসবাদ এবং তাদের ছদ্মবেশী সংগঠনগুলির মুখোশ খুলে দেওয়ার একটি বড় দৃষ্টান্ত। ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং গোয়েন্দা সংস্থার ঐক্যবদ্ধ ও ধারাবাহিক প্রচেষ্টায় আন্তর্জাতিক পরিসরে এই সন্ত্রাসী সংগঠনগুলির প্রকৃত চেহারা স্পষ্ট হয়ে উঠছে।
এই অভিযান এবং আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ভারতের সন্ত্রাস বিরোধী প্রচেষ্টাকে শুধু আরও শক্তিশালী করে তুলছে না, বরং বিশ্ববাসীর সামনে পাকিস্তানের ভূমিকাকেও তুলে ধরছে আরও স্পষ্টভাবে।

