নয়াদিল্লি, ২৯ জুলাই : পহেলগামে সন্ত্রাসী হামলায় সংসদে বিরোধী বাণে বিদ্ধ কেন্দ্রীয় সরকারের ত্রাতা হিসেবে রুখে দাঁড়ালেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। ঝাঝালো জবাব, ব্যঙ্গ-বিদ্রুপে সংসদে দাঁড়িয়ে বিরোধীদের বিশেষ করে কংগ্রেসকে তুলোধুনা করে ছাড়লেন তিনি। পহেলগামে হামলার জবাবে অপারেশন সিঁদুর নিয়ে মোদীর বিস্ফোরক দাবি, কংগ্রেস পাকিস্তানের স্ক্রিপ্টে চলছে এবং প্রতিনিয়ত সেনা বাহিনীর মনোবল ভাঙছে। প্রধানমন্ত্রীর কটাক্ষ, কংগ্রেস আজ পাকিস্তানের রিমোট কন্ট্রোলে চলছে। যারা অপারেশন সিঁদুরকে ‘নাটক’ বলে কটাক্ষ করেছে, তারা দেশের সেনাদের অপমান করেছে। সাথে তিনি সাফ জানিয়েছেন, বিশ্বের কোন নেতা ভারতকে পাকিস্তানের উপর হামলা বন্ধ করতে বলেননি।
তাঁর দাবি, কংগ্রেসের ইতিহাস বরাবরই সেনাবাহিনীর প্রতি নেতিবাচক মনোভাবই দেখিয়েছে। উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন, কংগ্রেস সরকার কখনও কারগিল বিজয় দিবস আনুষ্ঠানিকভাবে পালন করেনি। ডোকলাম সংঘাত ও অন্যান্য নিরাপত্তা ইস্যুতেও কংগ্রেসের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন মোদী। তাঁর বিদ্রুপ, কংগ্রেস নেতাদের বক্তব্য পাকিস্তানের সঙ্গে মিলিয়ে দেখুন। কমা ও ফুলস্টপ পর্যন্ত এক।
পহেলগাম হামলার পর জঙ্গিদের পাকিস্তানি নাগরিক প্রমাণে কংগ্রেসের প্রমাণ চাওয়াকেও পাকিস্তানি প্রোপাগান্ডার পুনরাবৃত্তি বলে ব্যাখ্যা করেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, যখন প্রমাণ দেওয়া হয়, তখনও তারা প্রশ্ন তোলে। প্রমাণ না থাকলে কী করত?
এদিন প্রধানমন্ত্রী মোদী জোর গলায় দাবি করেন, ২২ এপ্রিল পাহেলগাম হামলার ঠিক ১৪ দিন পর ৬-৭ মে রাতে ভারতের সশস্ত্র বাহিনী অপারেশন সিঁদুর চালায় এবং মাত্র ২২ মিনিটে প্রতিশোধ সম্পন্ন হয়। তিনি আত্মবিশ্বাসের সুরে বলেন, ভারত এখন নিজের নিয়মে প্রতিশোধ নেয়। তিনি জানান, পাকিস্তান থেকে ছোঁড়া প্রায় ১,০০০টি মিসাইল ভারতের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা মাঝ আকাশেই ধ্বংস করেছে। এই ঘটনা ভারতীয় প্রযুক্তিগত সক্ষমতার উদাহরণ দিচ্ছে। আজ প্রতিটি ভারতীয়ের গর্বিত হওয়া উচিত, মন্তব্য মোদীর।
মোদী বলেন, ওয়াহওয়ালপুর ও মুরিদকে-র মতো গুরুত্বপূর্ণ সন্ত্রাসবাদী ঘাঁটি ধ্বংস করা হয়েছে। পাকিস্তানের একাধিক বিমানঘাঁটিও আজ অকার্যকর হয়ে পড়ে রয়েছে। তিনি বলেন, পাকিস্তানের পারমাণবিক ব্ল্যাকমেইল এখন আর কাজ করে না। আমরা প্রমাণ করেছি, যারা সন্ত্রাসে সাহায্য করে, তারাও নিশানা হবে।
তিনি দৃঢ় প্রত্যয়ের সুরে বলেন, এটাই নতুন ভারত। অপারেশন সিঁদুর ছিল ভারতের আত্মনির্ভরতা ও কৌশলগত অগ্রগতির প্রতীক। তিনি জানান, দেশেই তৈরি ড্রোন ও মিসাইল ব্যবহার করে গভীরভাবে পরিকল্পিত হামলা চালানো হয়।
মোদী এদিন সুর চড়িয়ে বলেন, আজ পাকিস্তানে বসে থাকা জঙ্গি নেতারাও জানে, ভারতের বাহিনী তাদের ঘরে গিয়ে প্রতিশোধ নিতে পারে। তাঁর কথায়, এই হামলার মাধ্যমে সারা বিশ্ব দেখেছে, ‘আত্মনির্ভর ভারত’ কেমনভাবে সন্ত্রাসের জবাব দেয়। ব্রিকস সহ ১৯৩টি দেশের মধ্যে মাত্র তিনটি দেশ পাকিস্তানকে পরোক্ষভাবে সমর্থন করেছে, জানান প্রধানমন্ত্রী।
তিনি এদিন অত্যন্ত আক্ষেপের সুরে বলেন, আমাদের দেশ, বিশ্বের দেশগুলো, সবাই ভারতীয় সেনাকে সমর্থন করেছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে কংগ্রেস সমর্থন করেনি। তারা পহেলগাম হামলার পর শুধু রাজনীতির সুযোগ খুঁজেছে। তিনি আরও বলেন, তথ্য ও প্রপাগান্ডার যুদ্ধেই আজ যুদ্ধের চরিত্র নির্ধারিত হয়। কংগ্রেস নেতারা যদি এই বিষয়ে দায়িত্বশীল না হন, তবে তা সেনাবাহিনীর মনোবল নষ্ট করবে।
বিরোধীদের লক্ষ্য করে মোদী কটাক্ষ করে বলেন, সার্জিকাল স্ট্রাইকের সময় যেমন প্রমাণ চেয়েছিল, এবারও তাই করছিল। কিন্তু এবার বুঝে গেছে, জনতা তা মেনে নেবে না। তাই এখন বলছে, ওরাও নাকি এমন স্ট্রাইক করত! ভাগ্য ভালো, অপারেশন সিঁদুরের কৃতিত্বও দাবি করেনি।
মোদী পাহেলগাম হামলাকে ধর্মীয় পরিচয় দেখে পরিকল্পিত গণহত্যা বলে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, জঙ্গিরা পর্যটকদের ধর্ম দেখে গুলি করেছে। এটা ছিল দেশের মধ্যে সাম্প্রদায়িক বিভাজন তৈরির চক্রান্ত ছিল। কিন্তু দেশ একজোট ছিল এবং সেনা তার জবাব দিয়েছে।
বিশ্বের কোন নেতা ভারতকে পাকিস্তানের উপর হামলা বন্ধ করতে বলেননি। সংসদে এ-কথা সাফ জানালেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, গত ৯ মে যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স তাঁকে একাধিকবার ফোন করলেও তিনি সেই সময় একটি গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় নিরাপত্তা বৈঠকে থাকায় ফোন ধরতে পারেননি। প্রধানমন্ত্রী বলেন, মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট আমাকে চার-পাঁচবার ফোন করেন। কিন্তু আমি তখন নিরাপত্তা বৈঠকে ছিলাম, ফোন ধরা সম্ভব হয়নি… পরে আমি তাঁকে ফোন করি।
মোদীর দাবি, ভ্যান্স তাঁকে জানান যে পাকিস্তান একটি বড় সামরিক পদক্ষেপ নিতে চলেছে। মোদীর জবাব ছিল, আমি স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছিলাম, যদি পাকিস্তান হামলা করে, তার ফল মারাত্মক হবে। ভারত আরও জোরালো জবাব দেবে। তিনি বলেন, কোনও বিশ্ব নেতা ভারতকে পাকিস্তানের উপর আক্রমণ বন্ধ করতে বলেননি। বরং পাকিস্তানের ডিরেক্টর জেনারেল অফ মিলিটারি অপারেশন (ডিজিএমও) নিজে ভারতীয় ডিজিএমও-কে অনুরোধ করেন হামলা বন্ধ করতে। মোদীর ভাষায়, ওরা বলেছে, ‘অনেক মেরেছ, আর সহ্য করতে পারছি না, হামলা বন্ধ করুন’।
মোদী কংগ্রেসের সমালোচনা করে বলেন, কংগ্রেস বরাবরই ভারতের সেনাদের আত্মত্যাগ ও সফল অভিযানকে তুচ্ছ করেছে। বালাকোট সার্জিকাল স্ট্রাইকের সময় একাধিক কংগ্রেস নেতা সেই অভিযানের প্রমাণ চেয়েছিল। তিনি বলেন, একজন কংগ্রেস নেতা বলেছে ৩টি স্ট্রাইক হয়েছে, কেউ বলেছে ৬টি, কেউ ১৫টি। নেতা যত বড়, সংখ্যা তত বেশি। ২০১৯ সালে উইং কমান্ডার অভিনন্দন বন্দনা হওয়ার পরেও কিছু কংগ্রেস নেতা খুশি হয়েছিল বলে মোদী অভিযোগ করেন। পাকিস্তান তো খুশি ছিলই, কিন্তু এখানে কংগ্রেসও ভেবেছিল ‘মোদি শেষ হয়ে গেল’। কিন্তু অভিনন্দন ফিরে এসেছিল।
মোদী বলেন, এপ্রিলের পহালগাম হামলার পাল্টা হিসাবে ২৮ জুন চালানো ‘অপারেশন মহাদেব’ নিয়েও কংগ্রেস প্রশ্ন তুলেছে, কারণ সেই সময় সংসদে অপারেশন সিঁদুর নিয়ে আলোচনা চলছিল। আগে প্রমাণ চাইত, এখন জিজ্ঞেস করছে কেন অপারেশন বন্ধ হল? গোটা দেশ কংগ্রেসকে নিয়ে হাসছে, বিদ্রুপের সুরে বলেন প্রধানমন্ত্রী।
মোদী তাঁর বক্তব্যে কংগ্রেসের অতীত কূটনৈতিক সিদ্ধান্তগুলিকে আক্রমণ করে বলেন, নেহরুর আমলের সিন্ধু জল চুক্তি ছিল ভারতের সবচেয়ে বড় ভুল পদক্ষেপ ছিল। তিনি শুধু তাৎক্ষণিক প্রভাব দেখেছিলেন, দীর্ঘমেয়াদী কুফল বোঝেননি, নেহেরুর সমালোচনা করেন মোদী। তিনি বলেন, বর্তমান সরকার সেই ভুল সংশোধন করেছে। রক্ত ও জল একসাথে বইতে পারে না।
তিনি আরও বলেন, পাকিস্তানকে “সর্বাধিক পছন্দের দেশ” মর্যাদা ১৯৯৬-এ দেওয়া হয়েছিল এবং ২৬/১১’র মতো হামলার পরও কংগ্রেস সরকার পাকিস্তানের একটিও কূটনীতিক বহিষ্কার করেনি। যখন ওরা রক্ত দিয়ে হোলি খেলেছে, তখন কংগ্রেস কাব্য আসর বসিয়েছে।
তিনি কচ্ছে হস্তান্তর, কার্তারপুর, হাজী পীর পাসের মতো ঐতিহাসিক কূটনৈতিক ভুল তুলে ধরে বলেন, এই সুযোগগুলো নষ্ট না করলে আজ ইতিহাস অন্য রকম হত। মোদীর দাবি, এখন ভারত নিজের কৌশল নিজেই ঠিক করে। তাঁর সরকারের সাহসী পদক্ষেপ ও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি দেশবাসীকে নিরাপত্তার আশ্বাস দেয়।

