নয়াদিল্লি, ২৫ জুলাই : দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনীতিতে এক নতুন মোড়ের সূচনা ঘটল যখন পাকিস্তান ও বাংলাদেশ কূটনৈতিক এবং সরকারি পাসপোর্টধারীদের জন্য ভিসামুক্ত প্রবেশাধিকার চুক্তিতে উপনীত হলো। ঢাকায় অনুষ্ঠিত এক উচ্চপর্যায়ের বৈঠকে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, যা শুধু দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে নয়, ভারত-পাকিস্তান-বাংলাদেশ সম্পর্কের ত্রিপাক্ষিক প্রেক্ষাপটেও তাৎপর্যপূর্ণ।
বুধবার ঢাকায় পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মোহসিন নকভি ও বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী (অব.) লেফটেন্যান্ট জেনারেল জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীর মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এই বৈঠকে ভিসামুক্ত যাতায়াতের সিদ্ধান্ত ছাড়াও অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা, পুলিশ প্রশিক্ষণ, মাদক ও মানব পাচার রোধ, এবং সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যৌথ পদক্ষেপ গ্রহণে সম্মত হন দুই দেশের মন্ত্রীরা।
বৈঠকের পর পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যম রেডিও পাকিস্তান জানায়, এই চুক্তি দু’দেশের মধ্যকার দীর্ঘদিনের ঠান্ডা সম্পর্কের বরফ গলানোর একটি বড় পদক্ষেপ।
বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী প্রধানমন্ত্রী ও নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনুসের নেতৃত্বাধীন সরকারের অধীনে এ ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ প্রথমবার দেখা গেল। ইউনুস অতীতে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারতপন্থী এবং পাকিস্তানবিরোধী নীতির কড়া সমালোচক ছিলেন। তার সরকার প্রতিষ্ঠার পর পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক নতুন করে সাজানো শুরু করেছে বাংলাদেশ।
এই চুক্তির আওতায় পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে একটি যৌথ কমিটি গঠিত হয়েছে, যার নেতৃত্বে রয়েছেন স্বরাষ্ট্র সচিব খুররম আগা। বাংলাদেশ শীঘ্রই একটি উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধি দলকে ইসলামাবাদ পাঠাবে, যারা পাকিস্তানের সেফ সিটি প্রজেক্ট ও জাতীয় পুলিশ অ্যাকাডেমি পরিদর্শন করবেন। এ থেকে স্পষ্ট যে, দুই দেশ অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় যৌথ উদ্যোগে অগ্রসর হতে আগ্রহী।
জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, “এই সফর দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতা বাড়ানোর জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর জন্য প্রশিক্ষণের যে প্রস্তাব পাকিস্তান দিয়েছে, তা প্রশংসনীয়।”
এই চুক্তি ভারতের জন্য উদ্বেগজনক বলে মনে করছেন কূটনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা। ইসলামাবাদের সরকারি ও কূটনৈতিক প্রতিনিধিদের জন্য ঢাকায় ভিসামুক্ত প্রবেশের ফলে পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা ইন্টার-সার্ভিসেস ইন্টেলিজেন্স (আইএসআই)-এর অনুপ্রবেশ আরও সহজ হতে পারে বলে আশঙ্কা করছে নয়াদিল্লি।
বিশেষ করে, বাংলাদেশে আইএসআই কার্যক্রমের ইতিহাস এবং পূর্বে জঙ্গি গোষ্ঠীগুলির সঙ্গে পাকিস্তানি সংযোগের অভিযোগ নতুন করে মাথাচাড়া দিতে পারে। ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার মতে, এর ফলে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ভারতবিরোধী চরমপন্থী সংগঠনগুলি আবার সক্রিয় হতে পারে, যা ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীগুলির সঙ্গে সংযুক্ত হতে পারে।
ভারতের এক সাবেক জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা বলেন, “এই চুক্তি শুধুই কূটনৈতিক সৌজন্য নয়; এর মধ্য দিয়ে পাকিস্তান নতুন করে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করছে। ভারতের কৌশলগত স্বার্থ এখন আরও বেশি চ্যালেঞ্জের মুখে।”
বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশ-পাকিস্তান সম্পর্কের উষ্ণতা দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের প্রভাব কমানোর একটি কৌশলগত প্রচেষ্টা হতে পারে। শেখ হাসিনার সরকারের অধীনে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক এক নতুন উচ্চতায় পৌঁছেছিল, যার মধ্যে ছিল জলবণ্টন, বাণিজ্য, সীমান্ত নিরাপত্তা, এবং যৌথ অবকাঠামো প্রকল্পে সহযোগিতা।
কিন্তু ইউনুসের নেতৃত্বে বর্তমান প্রশাসনের দৃষ্টিভঙ্গি এই ভারসাম্যকে বদলে দিতে পারে। পাকিস্তান এই পরিস্থিতিকে কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশে তার কূটনৈতিক ও নিরাপত্তা প্রভাব পুনর্গঠন করতে আগ্রহী বলে মনে করা হচ্ছে।

