নয়াদিল্লি, ২৫ জুলাই : ভারতের প্রতিরক্ষা খাতে একটি গুরুত্বপূর্ণ সাফল্য হিসেবে চিহ্নিত হল ড্রোন থেকে উৎক্ষেপণযোগ্য প্রিসিশন গাইডেড ক্ষেপণাস্ত্র-এর তৃতীয় সংস্করণ ইউএলপিজিএম-ভি3-এর সফল পরীক্ষা। প্রতিরক্ষা গবেষণা ও উন্নয়ন সংস্থা এই অত্যাধুনিক মিসাইলটির সফল পরীক্ষা চালায় আন্ধ্র প্রদেশের কুরনুল জেলার ন্যাশনাল ওপেন এরিয়া রেঞ্জ-এ।
এই পরীক্ষা দেশের প্রতিরক্ষা আত্মনির্ভরতার লক্ষ্যে এক উল্লেখযোগ্য মাইলফলক বলে মনে করা হচ্ছে। প্রতিরক্ষা মন্ত্রী রাজনাথ সিং নিজেই সামাজিক মাধ্যমে এক পোস্টে ডিআরডিও-কে অভিনন্দন জানিয়ে বলেন, “ভারতের প্রতিরক্ষা সক্ষমতায় এক বড় উত্তরণ ঘটল। ডিআরডিও সফলভাবে ইউএভি লঞ্চড প্রিসিশন গাইডেড মিসাইল -ভি3-এর ফ্লাইট ট্রায়াল সম্পন্ন করেছে। এটি ভারতীয় প্রতিরক্ষা প্রযুক্তির উন্নয়নে এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ। ডিআরডিও, শিল্প অংশীদার, ডিসিপিপি, এমএসএমই এবং স্টার্টআপদের অভিনন্দন জানাই। এই সাফল্য প্রমাণ করে যে ভারতীয় শিল্প এখন গুরুত্বপূর্ণ প্রতিরক্ষা প্রযুক্তি আত্মস্থ করে নিজেরাই উৎপাদন করতে সক্ষম।”
ইউএলপিজিএম-ভি3 হল একটি হালকা, নির্ভুল এবং উচ্চ প্রযুক্তি সমৃদ্ধ ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা, যা নির্দিষ্ট লক্ষ্যবস্তুতে অত্যন্ত কার্যকরভাবে আঘাত হানতে সক্ষম। এটি বিভিন্ন ধরণের ইউএভি বা ড্রোন প্ল্যাটফর্ম থেকে উৎক্ষেপণযোগ্য। এই ক্ষেপণাস্ত্রের অন্যতম বিশেষত্ব হল এর উন্নত ইমেজিং ইনফ্রারেড সিকার, যা লক্ষ্যবস্তুকে অত্যন্ত নির্ভুলভাবে শনাক্ত করতে সাহায্য করে, এবং ডুয়াল থ্রাস্ট প্রপালশন সিস্টেম, যা ক্ষেপণাস্ত্রটিকে দীর্ঘ পাল্লায় দ্রুত ও স্থিতিশীলভাবে চালিত করতে সক্ষম করে তোলে।
ইউএলপিজিএম সিরিজের আগের সংস্করণ ভি2, ডিআরডিও-র টার্মিনাল ব্যালিস্টিক্স রিসার্চ ল্যাবরেটরি দ্বারা উন্নয়ন করা হয়েছিল। সেই সংস্করণে একাধিক ওয়ারহেড কনফিগারেশনের সুযোগ ছিল, যা বিভিন্ন যুদ্ধ পরিস্থিতিতে অভিযোজনযোগ্যতা এনে দেয়। নতুন ভি৩ সংস্করণে সেই সক্ষমতাকে আরও প্রসারিত করে আরও আধুনিক প্রযুক্তি সংযুক্ত করা হয়েছে।
ইউএলপিজিএম-ভি৩-এর সফল পরীক্ষা ভারতের সামরিক বাহিনীর কৌশলগত ক্ষমতা বহুলাংশে বৃদ্ধি করবে। যুদ্ধক্ষেত্রে নির্ভুল লক্ষ্যবস্তুর উপর আঘাত হানার প্রয়োজনীয়তা যেমন বাড়ছে, তেমনই প্রতিপক্ষের নজর এড়িয়ে নিরাপদ দূরত্ব থেকে হামলা চালানোর সক্ষমতাও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এই মিসাইল সেই দুই ক্ষেত্রেই ভারতের শক্তি বাড়াবে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ড্রোন বা ইউএভি-এর মাধ্যমে পরিচালিত ক্ষেপণাস্ত্র হামলা ভবিষ্যতের যুদ্ধের রূপরেখা নির্ধারণ করবে। এই সফল পরীক্ষা ভারতীয় সেনার আধুনিকীকরণ এবং প্রযুক্তিগত অগ্রগতির পথে একটি বড় পদক্ষেপ।
এই সফল ট্রায়ালের পেছনে নোয়ার, অর্থাৎ ন্যাশনাল ওপেন এরিয়া রেঞ্জ -এর অবদান গুরুত্বপূর্ণ। কুরনুল জেলার এই অত্যাধুনিক পরিকাঠামো ডিআরডিও-এর হাই-টেক অস্ত্র পরীক্ষার কেন্দ্র হিসেবে ইতিমধ্যেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছে। সাম্প্রতিক সময়ে এখানেই সফলভাবে লেজারভিত্তিক ডিরেক্টেড এনার্জি ওয়েপন -এর ট্রায়াল চালানো হয়েছে, যেখানে স্থির-উইং ইউএভি এবং স্বার্ম ড্রোনগুলিকে ধ্বংস করা হয়েছে।
এটি প্রমাণ করে যে ভারতের পরীক্ষণ এবং উন্নয়ন অবকাঠামো দ্রুত আধুনিক হচ্ছে এবং বিভিন্ন উচ্চ প্রযুক্তির অস্ত্রের জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি করতে সক্ষম হচ্ছে।
এই ইউএলপিজিএম-ভি৩ ট্রায়াল সফল হওয়ায় ভারতের প্রতিরক্ষা উৎপাদন শিল্পের আত্মনির্ভরতা আরও দৃঢ় হল। ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ উদ্যোগ এবং প্রতিরক্ষা প্রযুক্তিতে দেশীয় উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে এটি এক গুরুত্বপূর্ণ অর্জন। ডিআরডিও ছাড়াও বেসরকারি শিল্প অংশীদার, এমএসএমই এবং স্টার্টআপদের যৌথ উদ্যোগে তৈরি এই প্রকল্প ভবিষ্যতে প্রতিরক্ষা খাতে দেশীয় উৎপাদনের পরিমাণ বহুগুণে বাড়িয়ে তুলতে পারে।
এই মিসাইল ভবিষ্যতে সেনাবাহিনী, বিমান বাহিনী এমনকি নৌবাহিনী – সকল বাহিনীর অস্ত্রভাণ্ডারে যুক্ত হতে পারে বলে বিশেষজ্ঞদের ধারণা।
ভারতের প্রতিরক্ষা প্রযুক্তিতে এই ইউএলপিজিএম-ভি৩-এর সফল পরীক্ষা শুধু একটি প্রযুক্তিগত সাফল্য নয়, বরং একটি বড় কৌশলগত এবং রাজনৈতিক বার্তা। এটি স্পষ্ট করে দেয় যে ভারত এখন আর প্রতিরক্ষার দিক থেকে পিছিয়ে নেই, বরং আধুনিক প্রযুক্তিতে বিশ্বমানের প্রতিযোগিতায় নেতৃত্ব দিতে প্রস্তুত।

