ঢাকা/নয়াদিল্লি, ১৭ জুলাই ২০২৫: দীর্ঘদিনের জল্পনা, বিতর্ক এবং আন্তর্জাতিক উদ্বেগের অবসান ঘটিয়ে অবশেষে বাংলাদেশের ময়মনসিংহে বিশ্ববরেণ্য চলচ্চিত্র নির্মাতা সত্যজিৎ রায়ের পৈতৃক ভিটা ভাঙার কাজ স্থগিত করা হয়েছে। এই ঐতিহাসিক স্থাপনাটি পুনর্গঠন ও সংরক্ষণের উপায় খুঁজে বের করতে বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ একটি কমিটিও গঠন করেছে। ভারতের পক্ষ থেকে কূটনৈতিক উদ্বেগ প্রকাশ এবং পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তীব্র প্রতিবাদের পরই এই গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নেওয়া হলো, যা বাংলার সাংস্কৃতিক ইতিহাসের সাথে নিবিড়ভাবে জড়িত এক অমূল্য স্থাপনার ভবিষ্যৎ নিয়ে নতুন আশা জাগিয়েছে। এই ঘটনা ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে বর্তমানে বিরাজমান জটিল রাজনৈতিক সম্পর্কের প্রেক্ষাপটেও গভীর তাৎপর্য বহন করছে।
ময়মনসিংহের হরিকিশোর রায় চৌধুরী রোডে অবস্থিত প্রায় দেড়শো বছরের পুরনো এই বাড়িটি ছিল সত্যজিৎ রায়ের পিতামহ, প্রখ্যাত শিশুসাহিত্যিক, চিত্রশিল্পী ও মুদ্রণশিল্পী উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর। জানা গেছে, উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী এবং সত্যজিৎ রায় কেউই এই বাড়িতে দীর্ঘকাল বসবাস করেননি। বাড়িটি বর্তমানে বাংলাদেশ সরকারের মালিকানাধীন এবং দীর্ঘদিন ধরে এটি জরাজীর্ণ অবস্থায় ছিল। একসময় এখানে বাংলাদেশ শিশু অ্যাকাডেমির কার্যালয় পরিচালিত হলেও, সংস্কারের অভাবে তা পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে।
বাংলাদেশ হাইকমিশনের মন্ত্রী ফয়সাল মাহমুদ এনডিটিভিকে জানিয়েছেন যে, এই বাড়িটি বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী স্থাপনার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত ছিল না। তিনি এটিকে ময়মনসিংহ প্রশাসনের একটি ‘তত্ত্বাবধানের ভুল’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তাঁর মতে, এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাকে ঐতিহ্যবাহী তালিকায় অন্তর্ভুক্ত না করাটা প্রশাসনের পক্ষ থেকে একটি ত্রুটি ছিল, যার কারণে এটি এতদিন অরক্ষিত ছিল এবং ভাঙার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল। তবে, সংবাদমাধ্যমে বিষয়টি আসার পরপরই সরকার দ্রুত পদক্ষেপ নিয়েছে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শাহজাদপুরের পৈতৃক বাড়িতে ভাঙচুরের ঘটনার পর সত্যজিৎ রায়ের পৈতৃক ভিটা ভাঙার খবর ভারতের সাংস্কৃতিক মহলে গভীর উদ্বেগ সৃষ্টি করে। ভারতে প্রশ্ন উঠতে শুরু করে, শেখ হাসিনা সরকারের ক্ষমতাচ্যুতির পর বাংলাদেশে কি সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ এবং ভারতের সাথে ভাগ করা ঐতিহ্য থেকে সরে আসার প্রবণতা বাড়ছে?
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে এই ভাঙার ঘটনায় গভীর দুঃখ প্রকাশ করে। বিবৃতিতে বলা হয়, এই সম্পত্তিটি ‘বাংলা সাংস্কৃতিক নবজাগরণের প্রতীক’ এবং এর ভাঙা বন্ধ করে একটি সাহিত্য জাদুঘর অথবা ভারত ও বাংলাদেশের অভিন্ন সংস্কৃতির প্রতীক হিসেবে এর মেরামত ও পুনর্গঠনের বিকল্পগুলি পরীক্ষা করা বাঞ্ছনীয় হবে। ভারত সরকার এই কাজে সম্ভাব্য সকল প্রকার সহযোগিতার প্রস্তাবও দেয়।
পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও এই ঘটনায় তাঁর গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তিনি ‘এক্স’-এ একটি পোস্টে লেখেন, “রায় পরিবার বাঙালি সংস্কৃতির অন্যতম প্রধান ধারক ও বাহক। উপেন্দ্রকিশোর বাংলার নবজাগরণের একটি স্তম্ভ। অতএব, আমি বিশ্বাস করি এই বাড়িটি বাংলার সাংস্কৃতিক ইতিহাসের সাথে নিবিড়ভাবে জড়িত। আমি বাংলাদেশ সরকার এবং সেই দেশের সকল বিবেকবান মানুষের কাছে এই ঐতিহ্যপূর্ণ বাড়িটি সংরক্ষণের জন্য পদক্ষেপ নেওয়ার আবেদন জানাচ্ছি। ভারত সরকারেরও এই বিষয়ে মনোযোগ দেওয়া উচিত।”
এই ঘটনাগুলি এমন এক সময়ে ঘটল, যখন ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক এক নতুন মোড়ে দাঁড়িয়ে আছে। গত বছর আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর এবং নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে দিল্লি ও ঢাকার মধ্যে সম্পর্ক তলানিতে ঠেকেছে। ভারত যেখানে সংখ্যালঘু হিন্দুদের উপর হামলার খবর প্রকাশ করেছে, সেখানে বাংলাদেশ পাল্টা দাবি করেছে যে, দিল্লি তার অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করুক এবং প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে প্রত্যর্পণ করুক। দশকের পর দশক ধরে ঘনিষ্ঠ অংশীদারিত্বের পর এই টানাপোড়েন, ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের কাছ থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে ভারতের ঐতিহাসিক সমর্থনের প্রেক্ষাপটে এটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।
ক্ষমতা পরিবর্তনের পর বাংলাদেশে একটি ‘সাংস্কৃতিক পরিবর্তন’ দেখা যাচ্ছে বলে অনেক বিশ্লেষক মনে করছেন। ফেব্রুয়ারি ২০২৫-এ বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের পৈতৃক বাড়ির একাংশ ভেঙে ফেলা, এবং জুন ২০২৫-এ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাড়িতে ভাঙচুর – এই ঘটনাগুলি সাংস্কৃতিক কেন্দ্রগুলির প্রতি অবহেলা ও ধ্বংসের ইঙ্গিত দিচ্ছে।
সংখ্যালঘু হিন্দুদের উপর নৃশংসতার খবরগুলি এই জল্পনা তৈরি করেছে যে, আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর বাংলাদেশে ইসলামী মৌলবাদ মাথাচাড়া দিচ্ছে। জামায়াতে ইসলামী, যারা ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন পাকিস্তানকে সমর্থন করেছিল এবং শেখ হাসিনা কর্তৃক নিষিদ্ধ হয়েছিল, তারা আবার রাজনৈতিক অঙ্গনে ফিরে এসেছে এবং এখন নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার যোগ্য।
বাংলাদেশের সংবিধানে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম বলা হয়েছে, তবে একইসাথে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান এবং অন্যান্য ধর্মের সমান মর্যাদা ও অধিকার নিশ্চিত করার কথাও বলা হয়েছে। ধর্মনিরপেক্ষতার মূলনীতিও সংবিধানের একটি অংশ। এই মুহূর্তে বাংলাদেশ একটি ‘ক্রসরোড’-এ দাঁড়িয়ে, যেখানে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গণতান্ত্রিক সংস্কার নিয়ে আলোচনা করছে এবং ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ থেকে ‘বহুত্ববাদ’-এর দিকে সংবিধানের শর্তাবলী পরিবর্তনের সুপারিশ নিয়ে বিতর্ক চলছে।
সত্যজিৎ রায়ের পৈতৃক ভিটা সংরক্ষণের সিদ্ধান্ত এই সংকটপূর্ণ সময়ে ভারত ও বাংলাদেশের অভিন্ন সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য রক্ষায় একটি ইতিবাচক বার্তা বয়ে আনল। এটি দুই দেশের মধ্যে সাংস্কৃতিক বিনিময়ের গুরুত্ব এবং ঐতিহ্যের সংরক্ষণে উভয় দেশের সদিচ্ছার প্রতিফলন বলে মনে করা হচ্ছে।

