বৃষ্টিভেজা কলকাতায় মিছিল মমতার, অভিযোগ বাংলা ভাষাভাষী অভিবাসীদের হয়রানির বিরুদ্ধে

কলকাতা, ১৬ জুলাই : আগামী বছর পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা নির্বাচন। তার আগে রাজনৈতিক উত্তেজনার পারদ চড়াতে শুরু করেছে শাসক তৃণমূল কংগ্রেস ও প্রধান বিরোধী দল বিজেপি। এই পরিস্থিতিতে বুধবার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কলকাতার বৃষ্টিভেজা রাস্তায় পায়ে হেঁটে পদযাত্রা করলেন। তাঁর অভিযোগ, বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলি ও কেন্দ্রের সরকার বাংলা ভাষাভাষী গরিব বাঙালি শ্রমিকদের বিরুদ্ধে একটি সুপরিকল্পিত ষড়যন্ত্র চালাচ্ছে। ভোটার তালিকা থেকে তাঁদের নাম বাদ দেওয়া থেকে শুরু করে বেআইনি আটক ও ‘বিদেশি’ তকমা দেওয়ার অভিযোগে সরব হয়ে মমতা বলেন, “বাংলা ভারতের স্বাধীনতার জন্য লড়াই করেছে। বিজেপির লজ্জা হওয়া উচিত।”

নির্বাচন কমিশন পশ্চিমবঙ্গে ভোটার তালিকার বিশেষ তদারকি বা স্পেশাল ইনটেনসিভ রিভিশন শুরু করতে চলেছে, যা ইতিমধ্যেই বিহারে চালু হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রীর আশঙ্কা, এই তালিকা সংশোধনের মাধ্যমে রাজ্যের গরিব, প্রান্তিক ও বিশেষ করে বাংলা ভাষাভাষী বাঙালিরা শ্রমিকদের নাম বাদ দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে। তিনি বলেন, “তালিকায় যদি কারও নাম না থাকে, তাহলে জেলে পাঠানো হবে। ভোটার তালিকা সংশোধনের সময় প্রয়োজনে কাজ ছেড়ে দিন, কিন্তু নিজের নাম নথিভুক্ত করুন। এটা অস্তিত্বের প্রশ্ন।”

তিনি আরও বলেন, “তারা বলছে ২০০২ সালের ভোটার তালিকা দেখা হবে। এত বছর কেটে গেছে, কত মানুষ মারা গেছেন, কত শিশু জন্মেছে। এটা কি আদৌ বাস্তবসম্মত?” তাঁর অভিযোগ, এটি মূলত নাগরিক পঞ্জি বা এনআরসি কার্যকর করার এক ‘পেছনের দরজা’।

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দাবি, বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলো বাংলা ভাষাভাষী বাঙালিদের ‘রোহিঙ্গা’ বলে আখ্যা দিচ্ছে এবং বেআইনিভাবে আটক করে নির্যাতন করছে। “রোহিঙ্গারা মায়ানমারে থাকে। এখানে নয়। বিজেপি কী ভাবছে? বাঙালিদের অপমান করবে? তারা বাঙালিদের আটক শিবিরে পাঠাচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গ কি ভারতের অংশ নয়?”—প্রশ্ন তোলেন মুখ্যমন্ত্রী।

তিনি জানান, “২২ লক্ষ গরিব শ্রমিক, যারা বাংলা ছেড়ে জীবিকার সন্ধানে অন্য রাজ্যে গিয়েছেন, আজ তারা সেখানেই বিপন্ন। ওডিশায় বাঙালি শ্রমিকদের আটক করা হচ্ছে, দিল্লিতে উচ্ছেদ অভিযান চলছে, আসামে এক কৃষককে বিদেশি ট্রাইব্যুনাল থেকে নোটিস পাঠানো হয়েছে—সবই প্রমাণ করে যে একটি পরিকল্পিতভাবে বাঙালিদের নিশানা করা হচ্ছে।”

তিনি আরও বলেন, “আমি ওই সমস্ত বাঙালিদের বলব, ফিরে আসুন বাংলায়। এখানে আপনাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করব। বিজেপির শাসিত রাজ্যগুলো আপনাদের জেলে পাঠাচ্ছে। আমরা তা হতে দেব না।”

তৃণমূলের বাঙালি পরিচয়ভিত্তিক রাজনীতির বিরুদ্ধে পাল্টা কটাক্ষ করেছেন বিধানসভায় বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী। তিনি বলেন, “বাঙালিয়ানা আজ শুধু ভোটের আগে মনে পড়ে। হাজার হাজার বাঙালি চাকরি প্রার্থী আজ রাস্তায়। তাঁদের চাকরি কেড়ে নিয়েছে দুর্নীতিগ্রস্ত তৃণমূল সরকার। তখন মুখ্যমন্ত্রীর মনে পড়ে না বাঙালিদের কথা।”

তিনি আরও বলেন, “আপনার সরকার বাঙালিদের অধিকার রক্ষা করছে না, বরং আপনার দলীয় স্বার্থে, ভোটব্যাংক বাঁচাতে বাংলা ভাষা ও জাতিসত্তাকে ব্যবহার করছে। আপনি যদি সত্যিই বাঙালিদের জন্য লড়তে চান, তাহলে আগে রাজ্যে কর্মসংস্থান তৈরি করুন, দুর্নীতি বন্ধ করুন।”

তৃণমূল সূত্রে জানা যাচ্ছে, এই পদযাত্রা শুধু প্রতিবাদ নয়, ২০২৬ সালের নির্বাচনের প্রচার কৌশলের সূচনা। বিজেপিকে ‘বহিরাগত’ ও বাঙালি স্বার্থবিরোধী হিসেবে তুলে ধরেই ভোটের ময়দানে নামতে চাইছে তৃণমূল। শাসক দলের মতে, ভোটার তালিকা থেকে নাম বাদ, বেআইনি আটক ও ভাষাগত বৈষম্য—সব মিলিয়ে এটি পরিচয়, অধিকার ও আত্মমর্যাদার লড়াই।

তৃণমূল কংগ্রেসের এক শীর্ষ নেতা বলেন, “বিজেপি সরকার শুধু বাঙালিদের নয়, ভারতের ফেডারেল কাঠামোকেই আঘাত করছে। এবার আমাদের লড়াই শুধু ভোট জেতার নয়, বাংলার অস্তিত্ব রক্ষার।”

বিধানসভা ভোট যত এগোচ্ছে, রাজ্যে রাজনৈতিক মেরুকরণ স্পষ্ট হচ্ছে। একদিকে শাসক তৃণমূল কংগ্রেস ‘বাঙালি পরিচয়’ ও আঞ্চলিক আত্মমর্যাদাকে সামনে রেখে বিজেপির ‘বহিরাগত’ নীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের রূপরেখা তৈরি করছে। অন্যদিকে বিজেপি শাসন ও দুর্নীতির ইস্যুতে তৃণমূলকে চাপে রাখার চেষ্টা করছে। এই রাজনৈতিক উত্তেজনার কেন্দ্রে এখন ভোটার তালিকা, যা আগামিদিনে আরও বড় রাজনৈতিক বিতর্কের রূপ নিতে পারে।