উত্তর-পূর্ব ভারতের উন্নতির নতুন গতি :বাইরবি–সায়রাং রেললাইন মিজোরামে বয়ে আনবে উন্নয়নের সুবাতাস

আইজল, জুলাই ১৫ : ২০২৫ সাল মিজোরামের ইতিহাসে এক ঐতিহাসিক অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। এই প্রথমবারের মতো রাজ্যের রাজধানী আইজল দেশের ব্রডগেজ রেল নেটওয়ার্কের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত হল। এটি সম্ভব হয়েছে বাইরবি–সায়রাং ব্রডগেজ রেল প্রকল্পের সম্পূর্ণতা লাভের মাধ্যমে। এই রেল প্রকল্প শুধু মিজোরামের নয়, গোটা উত্তর-পূর্ব ভারতের যোগাযোগ ব্যবস্থা, আর্থিক উন্নয়ন এবং সামাজিক সামঞ্জস্য বজায় রাখার ক্ষেত্রে এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ।

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ২০১৪ সালের ২৯ নভেম্বর এই প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। ২০১৫-১৬ সালে শুরু হয় নির্মাণকাজ। বহু প্রতিকূলতা অতিক্রম করে প্রকল্পটি ২০২৫ সালে সম্পূর্ণ হয় এবং চলতি বছরের জুন মাসে রেলওয়ে সুরক্ষা কমিশনারের অনুমোদন লাভ করে।

এই প্রকল্পের আওতায় ৫১.৩৮ কিলোমিটার দীর্ঘ ব্রডগেজ রেলপথ নির্মাণ করা হয়েছে, যেখানে ঘণ্টায় ১০০ কিলোমিটার গতিতে ট্রেন চলাচল সম্ভব। বাইরাবি থেকে সায়রাং পর্যন্ত এই পথে তিনটি স্টেশন — হরতোকি, কাভানপুই ও মুয়ালখাং — রয়েছে।

প্রকল্পে নির্মিত হয়েছে ৪৮টি সুড়ঙ্গ (মোট দৈর্ঘ্য ১২.৮৫ কিমি), ৫৫টি বড় সেতু, ৮৭টি ছোট সেতু, ৫টি রোড ওভারব্রিজ এবং ৯টি রোড আন্ডারব্রিজ। এর মধ্যে সবচেয়ে উঁচু সেতুটি ১০৪ মিটার উচ্চতা বিশিষ্ট, যা দিল্লির কুতুব মিনার থেকেও উঁচু। প্রকল্পের মোট ব্যয় ৭,৭১৪ কোটি টাকা এবং এর দায়িত্বে ছিল উত্তর-পূর্ব সীমান্ত রেলওয়ে।

এই প্রকল্প মিজোরামের গ্রামীণ ও পার্বত্য অঞ্চলের সাধারণ মানুষের কাছে আশীর্বাদস্বরূপ। এতদিন সীমিত সড়ক যোগাযোগে নির্ভরশীল এই মানুষদের জন্য এটি একটি দ্রুত, সুলভ এবং নিরাপদ পরিবহণ ব্যবস্থা হয়ে উঠবে। চিকিৎসা, উচ্চশিক্ষা এবং কর্মসংস্থানে এটি খুলে দেবে নতুন দিগন্ত।

কৃষিকাজেও এই রেলপথের প্রভাব সুদূরপ্রসারী হবে। কৃষকেরা এখন তাদের উৎপন্ন দ্রুত এবং কম খরচে দেশের বিভিন্ন বাজারে পৌঁছে দিতে পারবেন, যার ফলে আয় বৃদ্ধি পাবে এবং রাজ্যের অর্থনীতি পাবে গতি। পর্যটনের দিক থেকেও এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সুড়ঙ্গ, উপত্যকা ও পাহাড়ি দৃশ্যের মধ্যে দিয়ে যাওয়া এই রেলপথ পর্যটকদের জন্য এক স্মরণীয় অভিজ্ঞতা তৈরি করবে। এতে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক পর্যটনও উৎসাহিত হবে।

এই প্রকল্পের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হল এর কৌশলগত গুরুত্ব। মিয়ানমার সীমান্তের নিকটে অবস্থিত এই রেলপথ ভারতের প্রতিরক্ষা কৌশলকেও শক্তিশালী করবে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে রেল সংযোগের স্বপ্নপূরণে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ এবং ‘অ্যাক্ট ইস্ট পলিসি’-কে বাস্তবে রূপ দেওয়ার একটি বড় অবকাঠামো প্রকল্প।

এই প্রকল্পের মধ্য দিয়ে মিজোরামের রাজধানী আইজল এখন ভারতীয় রেল মানচিত্রে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। এর পাশাপাশি উত্তর-পূর্বের অন্যান্য রাজ্য যেমন গুয়াহাটি (অসম), ইটানগর (অরুণাচল প্রদেশ), আগরতলা (ত্রিপুরা) এবং শিলং (মেঘালয়) ইতিমধ্যেই ব্রডগেজ রেল সংযোগ পেয়েছে।

প্রকল্প চলাকালীন বছরজুড়ে মাত্র ৪–৫ মাস নির্মাণকাজ সম্ভব হত। বৃষ্টিপাত, ভূমিধস, শ্রমিক সংকট, সরবরাহ চ্যালেঞ্জ ইত্যাদির মধ্যেও ভারতীয় রেলের প্রকৌশল দক্ষতা, ব্যবস্থাপনা ও ভবিষ্যৎদৃষ্টি এই প্রকল্পকে সফল করেছে। বাইরাবি–সায়রাং রেলপথ এখন মিজোরামের উন্নয়নের রেলপথ। যা শুধু যোগাযোগ নয়, বরং সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং কৌশলগত পরিবর্তনের বাহক।