নয়াদিল্লি, ১০ জুলাই : বিহারের আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনের আগে নির্বাচন কমিশনের পরিকল্পিত ‘বিশেষ ইনটেনসিভ পুনঃসংশোধন’ প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে গম্ভীর সন্দেহ এবং উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। আদালত নির্বাচন কমিশনকে কঠোর প্রশ্ন করেছে এবং তার সময়সীমা, প্রক্রিয়া এবং প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছে। বৃহস্পতিবার অনুষ্ঠিত এক গুরুত্বপূর্ণ শুনানিতে বিচারপতিরা নির্বাচন কমিশনের এই প্রক্রিয়ার উদ্দেশ্য ও কার্যকারিতা সম্পর্কে নিজেদের চিন্তা ভাগ করে নিয়েছেন।
বিহার ভোটার তালিকার ‘বিশেষ পুনঃসংশোধন’ প্রক্রিয়া সম্পর্কে সুপ্রিম কোর্ট বলেছে, “আপনার প্রচেষ্টা সমস্যার সৃষ্টি করছে না, সমস্যা হচ্ছে সময়। এত বিশাল জনগণের (আট কোটি মানুষ) উপর এই ‘ইনটেনসিভ রিভিউ’ কার্যক্রম চালানো কি সম্ভব? এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে নির্বাচনের তাগিদও তো রয়েছে, এইভাবে সময়সীমা পূর্ণ হওয়া কি সম্ভব?” আদালত আরও জানায়, “এটি একটি বড় এবং গুরুতর কাজ, এবং আমাদের গম্ভীর সন্দেহ আছে যে এই কাজটি সফলভাবে করা সম্ভব হবে কিনা।”
শীর্ষ আদালত আরও উল্লেখ করেছে যে, এই ধরনের বৃহত্তম জনগণের রিভিউ প্রক্রিয়ায় যদি কোনও ব্যক্তির নাম বাদ পড়ে, তবে তাকে ভোট দেওয়ার আগে আদালতে আপিল করার সুযোগ থাকতে হবে। বিচারপতি সুধাংশু ধুলিয়া বলেন, “যদি কেউ নির্বাচন থেকে বঞ্চিত হয়, তাহলে তাকে ভোট দেওয়ার আগে আপিল করার সুযোগ থাকবে না।” তিনি আরও বলেন, “যেহেতু আদালত একবার ভোটার তালিকা চূড়ান্ত করার পরে তা নিয়ে কোনো বিচার করবে না, তাই একটি বঞ্চিত ব্যক্তি নির্বাচনের আগে তালিকায় অন্তর্ভুক্তির জন্য আইনিভাবে প্রক্রিয়া অনুসরণ করার সুযোগ পাবে না।”
এছাড়া, আদালত নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্তের উপর প্রশ্ন তুলেছে যে কেন তারা আধার কার্ডকে ভোটার তালিকার পুনঃসংশোধনে গ্রহণ করছে না। আদালত মনে করে যে, আধার একটি গুরুত্বপূর্ণ সরকারী পরিচয়পত্র হিসেবে গ্রহণযোগ্য হওয়া উচিত। “আপনি যদি একে আইডেন্টিটি যাচাইয়ের জন্য ব্যবহার করছেন, তাহলে আধার কেন বাদ পড়ছে?” আদালত নির্বাচন কমিশনকে প্রশ্ন করে।
এদিন সুপ্রিম কোর্ট নির্বাচন কমিশনকে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন রেখেছে। প্রথমত, আদালত জানতে চেয়েছে, “বিশেষ ইনটেনসিভ পুনঃসংশোধন” প্রক্রিয়া চালানোর জন্য নির্বাচন কমিশনের আইনগত অধিকার কোথায়? দ্বিতীয়ত, আদালত প্রক্রিয়ার বৈধতা এবং এটি কীভাবে আসন্ন নির্বাচনের সঙ্গে সম্পর্কিত, তা ব্যাখ্যা করতে কমিশনকে বলেছে। তৃতীয়ত, কেন এই পুনঃসংশোধন প্রক্রিয়া নির্বাচনের আগে শুরু করা হচ্ছে, তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে আদালত। এসব প্রশ্নের মাধ্যমে আদালত কমিশনকে তাদের কার্যক্রমের আইনগত ভিত্তি, সময়সীমা এবং নির্বাচনের সঙ্গে এর সম্পর্ক সম্পর্কে আরও বিস্তারিত ব্যাখ্যা দিতে বলেছে।
বিহার ভোটার তালিকার এই ‘বিশেষ পুনঃসংশোধন’ প্রক্রিয়া নিয়ে রাজনৈতিক বিতর্কও তীব্র হয়েছে। বিরোধী দলগুলি বিশেষত কংগ্রেস এবং রাষ্ট্রীয় জনতা দল (আরজেডি) নির্বাচন কমিশনের এই উদ্যোগকে সমালোচনা করেছে। তাদের দাবি, এই প্রক্রিয়া ভোটারদের একটি বৃহৎ অংশকে বাদ দেওয়ার উদ্দেশ্যে চলছে, যা নির্বাচনের ফলাফলে শাসক জোটের পক্ষ থেকে সুবিধা দিতে পারে। বিরোধী দলগুলো অভিযোগ করছে যে, দরিদ্র, অভিবাসী শ্রমিক এবং দুর্বল জনগণের অংশকে এই তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হচ্ছে।
সিনিয়র আইনজীবী ভ্রিন্দা গ্রোভার, যিনি পিটিশনারদের পক্ষ থেকে আদালতে যুক্তি দেন, বলেছেন, “এটি একটি সাধারণ প্রক্রিয়া নয়… এটি বিশেষভাবে দরিদ্র, শ্রমিক এবং নির্দিষ্ট জনগণের অংশকে বাদ দেওয়ার জন্য তৈরি করা হয়েছে।” তিনি আরও বলেন, “এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এটি স্পষ্ট যে, এটা সরকারের শাসক জোটের ভোট ব্যাংককে শক্তিশালী করার চেষ্টা করা হচ্ছে।”
নির্বাচন কমিশন এর উত্তরে বলেছে, পুনঃসংশোধন প্রক্রিয়া আইনিভাবে সঠিক এবং জনগণের সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য এটি প্রয়োজনীয়। কমিশন দাবি করেছে যে, বিহারে ১.১ কোটি মৃত ব্যক্তির নাম ভোটার তালিকা থেকে বাদ পড়েছে এবং প্রায় ৭০ লাখ মানুষ অভিবাসী হয়ে গেছে, তাই এই প্রক্রিয়া জরুরি ছিল।
এছাড়া, নির্বাচন কমিশন বলেছে যে, যাদের নাম বাদ যাবে তাদের সংশোধিত তালিকায় পুনরায় অন্তর্ভুক্তির জন্য আপিল করার সুযোগ দেওয়া হবে। তবে আদালত সেই দৃষ্টিকোণ থেকে প্রশ্ন তুলেছে, “নির্বাচনের আগে বঞ্চিত ব্যক্তির কাছে কি যথাযথ সময় থাকবে তাদের আপিল করার?”
নির্বাচন কমিশন আধারের গ্রহণযোগ্যতা নিয়েও নিজেদের যুক্তি উপস্থাপন করেছে। কমিশন জানিয়েছে, আধার শুধুমাত্র পরিচয় প্রমাণের জন্য ব্যবহৃত হলেও এটি নাগরিকত্ব বা বাসস্থান প্রমাণের জন্য গ্রহণযোগ্য নয়। তবে আদালত মনে করে যে, অন্যান্য সরকারী আইডি যেমন কাস্ট সার্টিফিকেট এবং ভেটারান সার্টিফিকেটও আধারের ভিত্তিতে দেওয়া হয়, তবে আধার কেন বাদ পড়ছে, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে।
এই মামলাটি এখনও চলমান এবং আদালত নির্বাচন কমিশনকে উপরের প্রশ্নগুলির ব্যাখ্যা দেওয়ার জন্য নির্দেশ দিয়েছে। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ মামলা, যা দেশের নির্বাচন ব্যবস্থার ক্ষেত্রে একটি বড় পরিবর্তন আনতে পারে। এর ফলে, বিহারের নির্বাচনী প্রক্রিয়ার সময়সূচী এবং নির্বাচনের ভবিষ্যতেও এক নতুন দিশা নির্দেশিত হতে পারে।

