২০৪৭ সালের মধ্যে ভারতের সবুজ গন্তব্য হওয়া সিকিমের লক্ষ্য : প্রফেসর মহেন্দ্র পি. লামা

গ্যাংটক, ২৪ জুন : সিকিমের ভারত সংযুক্তির ৫০ বছর পূর্তির সূবর্ণ লগ্নে, সিকিম সরকারের প্রধান অর্থনৈতিক উপদেষ্টা ও জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র অধ্যাপক প্রফেসর মহেন্দ্র পি. লামা সিকিমের আগামী দিনের জন্য একটি দৃষ্টিভঙ্গি উপস্থাপন করেছেন। তিনি বলেছেন, ২০৪৭ সালের মধ্যে সিকিমকে ভারতের ‘সবুজ গন্তব্য’ হিসেবে পরিচিত করানো হবে, যেখানে প্রতিটি কর্মকাণ্ড—শক্তি, কৃষি, পর্যটন ও পরিবহন—স্থায়িত্বশীলতার ওপর ভিত্তি করবে।
একটি পডকাস্টে বক্তব্য রাখার সময় প্রফেসর লামা সিকিমের রাজনৈতিক ইতিহাস, জীববৈচিত্র্য, সাংস্কৃতিক ঐক্য এবং সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৩৭১এফ-এর অধীনে প্রাপ্ত সুরক্ষার মতো চারটি শক্তিশালী স্তম্ভ তুলে ধরেন, যা সিকিমকে বিশেষ পরিচিতি দেয় এবং ভারতীয় ইউনিয়নের সঙ্গে সাফল্যের সঙ্গে একীভূত করে। তিনি বলেন, “অন্যান্য উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলোর মতো সিকিমে কোনো সশস্ত্র বিদ্রোহ বা সহিংসতা নেই। এটি সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে স্থিতিশীল।”
সিকিমের মাথাপিছু আয় বর্তমানে প্রায় ৭.৫ লক্ষ টাকা, যা দেশের অন্যতম উচ্চ। ১৯৭৫ সালে প্রায় ৮৫% মানুষ দারিদ্রসীমার নিচে ছিল, যা আজ মাত্র ২%। তবে এই যাত্রা সহজ ছিল না। সংযুক্তির পরও সিকিমের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো শারীরিক যোগাযোগের অভাব। মাত্র একটি জাতীয় সড়ক রয়েছে, যা অনেক মাস বন্ধ থাকে, এবং বিমানবন্দর কম ব্যবহার হয়। উন্নত পরিবহন অবকাঠামো যেমন রেল ও সড়ক সংযোগ জরুরি, বলে তিনি উল্লেখ করেন।
পরিবেশগত ঝুঁকি আরও বাড়িয়েছে জলবায়ু পরিবর্তন। ২০২৩ সালের অক্টোবরের গ্লেশিয়ার লেক আউটব্রাস্ট বন্যা সিকিমের পরিবেশগত দুর্বলতার দৃষ্টান্ত। প্রফেসর লামা বলেন, “আমরা বিপর্যয়ের শিকার, কিন্তু সমাধানের অংশ হিসেবে কম বিবেচিত হই। সিকিমকে জলবায়ু সহনশীলতার একটি জ্ঞানকেন্দ্র হতে হবে।”
ভবিষ্যতের জন্য তিনি একটি রূপান্তরমূলক পরিকল্পনা উপস্থাপন করেন—২০৪৭ সালের মধ্যে সিকিমকে একটি সবুজ গন্তব্য হিসেবে গড়ে তোলা, যেখানে সব ধরনের কর্মকাণ্ড পরিবেশ বান্ধব ও টেকসই হবে। তিনি সবুজ প্রযুক্তি, পরিবেশবান্ধব উদ্যোগ ও জলবায়ু অভিযোজন ও দুর্যোগ প্রস্তুতির জন্য দ্বিতীয় প্রজন্মের প্রতিষ্ঠানগুলো গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তা জোর দেন।
প্রফেসর লামা বলেন, সিকিমের উন্নয়ন অন্য শিল্পনির্ভর রাজ্যগুলোর মতো হতে পারে না কারণ এখানে সংবেদনশীল বাস্তুতন্ত্র ও সীমিত পরিবহন ব্যবস্থা রয়েছে। তিনি পাহাড়ি রাজ্যগুলোর জন্য বিশেষ উন্নয়ন মডেলের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেন, যা উত্তরাখণ্ড, হিমাচল প্রদেশ এবং প্রতিবেশী দেশ ভুটান ও নেপালেও প্রয়োগযোগ্য হবে।
সিকিমের ভৌগোলিক গুরুত্বের কথাও উল্লেখ করে তিনি বলেন, এটি চীন, নেপাল ও ভুটানের সীমান্তবর্তী হওয়ায় ভারতের ‘এক্ট ইস্ট পলিসি’র কেন্দ্রস্থলে রয়েছে। তিনি সীমান্তকে শুধুমাত্র প্রতিরক্ষার সীমা নয় বরং সহযোগিতার ক্ষেত্র হিসেবে দেখার পরামর্শ দেন। সিকিম হিমালয়ীয় অঞ্চল ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্য, পর্যটন, শিক্ষা ও শক্তি বিনিময়ের সেতু হতে পারে।
টিবেটের সঙ্গে বাণিজ্য পথ পুনরায় খুলে দেওয়া, পশ্চিম সিকিম থেকে পূর্ব নেপালের মধ্যে অর্থনৈতিক করিডোর নির্মাণ এবং আঞ্চলিক শক্তি গ্রিডের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনসহ বিভিন্ন প্রস্তাবনা চলছে। সিকিমের সাংস্কৃতিক ও ভৌগোলিক সম্পর্ক এটিকে আঞ্চলিক সহযোগিতায় বিশেষ করে তোলে।
ভারত ২০৪৭ সালের মধ্যে উন্নত দেশের স্বপ্ন পূরণের পথে, প্রফেসর লামা বিশ্বাস করেন সিকিম ভারী শিল্পের মাধ্যমে নয়, বরং টেকসই উন্নয়ন ও পরিবেশগত উদ্ভাবনায় নেতৃত্ব দিয়ে অবদান রাখবে। তিনি বলেন, “আমাদের কাজ হলো দেখানো যে, উন্নয়ন ও প্রকৃতি সঙ্গেই চলতে পারে। যদি আমরা আমাদের সম্পদ রক্ষা করি, তাহলে শুধুমাত্র সিকিম নয়, পুরো অঞ্চলই রক্ষা পাবে।”