আগরতলা, ৩ আগস্ট: ত্রিপুরায় আজ ঐতিহ্যবাহী কের পূজা অনুষ্ঠিত হয়েছে। আগরতলায় উজ্জয়ন্ত প্রাসাদে প্রথা মেনে জনজাতি-দের এই পূজা অনুষ্ঠিত হয়েছে। কের পূজা উপলক্ষ্যে ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী সকলকে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন।
ত্রিপুরার রাজবংশের অন্যতম ধর্মীয় উৎসব হলো কের পূজা। শ্রাবন মাসের শুক্লা পঞ্চমীতে সাত দিনের খারচি পূজা ১৪ দেবতার মন্দিরে শেষ হওয়ার পরের সাত দিনের মাথায় শুরু হয় কের পূজা। হিন্দু ধর্মের দেব-দেবীর পূজায় যে সব আচার-উপাচার দেখা যায়, তা কের পূজায় দেখা যায় না। প্রথমত, উপাস্য দেব-দেবীর কোনরকম মূর্তি নেই এই পূজায়। এর আচার-অনুষ্ঠান সত্যই অনুপম। আদিভৌতিক শক্তির ভয় থেকে রক্ষা পেতে এই পূজা করা হয় এবং আচার-অনুষ্ঠানের পুরোহিত এবং যার নির্দেশে এই পূজা সম্পাদিত হয় তার নাম চন্তাই। কের পূজায় কঠোরভাবে নিয়ম কানুন মানা হয়। ওই নিয়ম চন্তাই যেমন নিখুঁত ভাবে মানেন, তেমনি এই নিয়ম পালনে জন ঘোষণাও দেওয়া হয়। এটাও তাঁদের পরম্পরাগত রীতি। বলা হয়ে থাকে, যে এই নিয়ম ভঙ্গ করবেন তাঁকে দৈব শক্তির কাছ থেকে শাস্তি পেতে হবে।
কের ও খারচি, উভয় পূজাই রাজ-পরিবরের ও ত্রিপুরার উপজাতিদের পূজা। কিন্তু, ত্রিপুরা ভারতের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পর থেকে এবং গণতান্ত্রিক শাসন কায়েম হতেই উভয় পূজার পৃষ্ঠপোষক ত্রিপুরা সরকার স্বয়ং। দুটো পূজার ক্ষেত্রেই সরকারী পুলিশ পূজার পবিত্রতা রক্ষায় নিয়োজিত থাকে।
তবে, কের পূজাকে ঘিরে বেশ কিছু নিষেধাজ্ঞামূলক সংস্কারও রয়েছে। এই পূজার দিনগুলিতে সমাজের প্রধান হয়ে উঠেন চন্তাই। কের পূজার সংস্কার কোনো কারণে কেউ ভঙ্গ করলে চন্তাই মহারাজ তাঁকে শাস্তি দিতে পারেন। আজকাল কের পূজার সস্কার ও বিধিনিষেধ বলবৎ থাকে পুজাস্থল সহ তার বাইরে বিরাট এলাকা জুড়ে। অবশ্য কের পূজার নিয়ম-কানুনের এই গন্ডি উজ্জয়ন্ত প্রাসাদের পশ্চিম দিকের একটি অংশের মধ্যেই এখন সীমাবদ্ধ। নির্ধারিত ওই এলাকায় লোক জনের প্রবেশ করতে দেওয়া হয় না। নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয় এই সময়ে। রাজবাড়ির বাইরের শহরের নির্দিষ্ট একটি বলয়ের মধ্যেও এই নিষেধাজ্ঞা বহাল থাকে রাত ১০টা থেকে সকাল ৫ টা পর্যন্ত। ওই সব স্থানে বসবাসকারী লোকজনদের ওই সময়কালে বাড়ি থেকে বেরুতে নিষেধ থাকে। এই নিষেধাজ্ঞা বহাল থাকে কের পূজার প্রথম ৩২ ঘন্টার সময়কালের জন্য।
আরো নিষেধাজ্ঞা আছে, যেমন কোনো অসুস্থ ব্যক্তি-কে কের পূজার ওই এলাকায় থাকতে দেওয়া হয় না। তেমনি, ওই অঞ্চলে সেসময় কোনো অন্তস্বত্বা মহিলা থাকলে, কের পূজার পবিত্রতা রক্ষার জন্য তাঁকে ওই সীমানার বাইরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। শিশুর জন্ম ও মৃত্যুর সম্ভাবনা, যা পূজার পবিত্রতা নষ্ট করতে পারে, তা রোধ করতেই ওই নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয় বলে জানা যায়। রাজ পরিবারের সদস্য ও মহারাজার আত্মীয়-স্বজন জুতো পরেন না। এই সময় তাঁদেরকে খালি পায়ে থাকতে হয়। এমনকি, ছাতা ব্যবহার করাও নিষিদ্ধ। আদিভৌতিক শক্তিকে তুষ্ট করতে এই সময়কালে কোনো রকম বিনোদন মূলক অনুষ্ঠান, নৃত্য, সঙ্গীত, গান-বাজনা করা নিষিদ্ধ থাকে। শুধুমাত্র চন্তাইয়ের সহকারিরার সমবেত স্তোত্র পাঠ করতে পারেন।
চন্তাই বিশ্বাস করেন, কের পূজার এই বিধিনিষেধ অমান্য করলে অশুভ শক্তিকে আহ্বান করা হয় এবং পূজার পবিত্রতা তাতে অশুচি হয়। কের পূজার দিনক্ষণ স্থির হওয়ার পর আগের দিন চন্তাই জিপ গাড়ি চড়ে পূজা স্থলে আসেন।তখন তাঁকে আনুষ্ঠানিকভাবে মর্যাদা দিয়ে অভ্যর্থনা জানাতে সেখানে থাকেন রাজকর্মচারীরা ও ত্রিপুরা সরকারের দেবস্থান পরিচালন কমিটির কর্মচারীরা। যারা চন্তাই ও তার সহকারীদের খাওয়া-থাকার সুবন্দোবস্ত করেন। পূজা শুরু হয় কামানের গোলা ফাটিয়ে। নাগরিকদের পূজা শুরুর বার্তা জানাতেই এটা করা হয়। এবং পূজার যাবতীয় উপাচার শুরু হয়ে যায়। পূজা শেষ হলেও তেমনি গোলা ফাটানো হয়।
পরদিন ভোরকালে চন্তাই রাজকীয় পোশাক পরে আসেন পুজাস্থলে। তাঁর মাথায় থাকে পাগড়ি, গায়ে রঙিন ঝুল্ঝুলে জামা, সাদা ঢিলা কোমরবন্ধ এবং স্বর্ণালী সুতোর তাগা। এই পরিচ্ছদের প্রতিকী অর্থ হলো উপাস্য দেবতা এগুলোর মধ্যেই নিহিত। চন্তাই এরপর তার সহকারীদের নিয়ে এবং পেছনে সরকারী ও রাজকর্মচারীদের নিয়ে শোভাযাত্রা করে মানিক্য শাসনের হাতির দাঁত ও রুপো দিয়ে তৈরী প্রাচীন সিংহাসনের কাছে গিয়ে সম্মান জানান।
এর পর তাঁরা রাজবাড়ির ভেতর রাখা মঙ্গলচন্ডি দেবীর কাছে গিয়ে প্রার্থনা জানান। এর পর তাঁদের উজ্জয়ন্ত প্রাসাদের সদর দেওরি পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া হয় এবং সেখান থেকে নির্ধারিত পবিত্র স্থানের দিকে রওয়ানা করা হয়। ওই পবিত্র স্থান হচ্ছে, আয়তাকার এক খন্ড ভূমি, যা কের পূজার জন্য পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে প্রস্তুত করে রাখা হয় আগে থেকেই। ওই আয়তাকার ভূমি খন্ডের প্রত্যেক কোনায় সবুজ বাঁশ গাছের খন্ড পুঁতা হয়। এই বাঁশ গাছগুলি উপাস্য দেব-দেবী ও পূর্ব-পুরুষদের প্রতিক হিসেবে দেখা হয়| বাঁশের দন্ড গুলির এক একটার এক রক রকম আকৃতি এবং প্রত্যেকটি ফুল দিয়ে মুড়ানো থাকে। এদের উপর একটি জ্যামিতিক আকৃতিতে একটি চাঁদোয়া আটকানো হয়। বাইরের দিক থেকে মন্দিরের সদৃশ এই সজ্জা। চন্তাই ও সহকারীরা উচ্চস্বরে অজানা ভাষায় স্তোত্র উচারণ করতে থাকেন।যা জনসাধারনকে অশুভ প্রভাব থেকে পরিত্রান করে বলে বিশ্বাস। চন্তাই পুজাস্থলে, বাঁশেবাঁশ ঘসে আগুন জ্বালান, পূজার পর ওই আগুনের ভষ্ম উপজাতি, অ-উপজাতি লোক-জনেরা ঘরে নিয়ে যান। তারা বিশ্বাস করেন, ওই ভস্ম পরিবারে কল্যাণ করে, অপদেবতার কু-দৃষ্টি থেকে রক্ষা করে। পশু, পাখির বলি দেওয়াও এই পূজার অন্যতম উপাচার।
ত্রিপুরার রাজবাড়ি উজ্জয়ন্ত প্রাসাদ ও পুরান হাবেলিতে কের পূজা যেমন করা হয়, তেমনি উপজাতি সাধারণ মানুষ ফসল রোপনের পর গ্রামে গ্রামে সামাজিকভাবে এই পূজা করেন।