দুর্গাপুর, ১ জুলাই (হি. স.) : ফের দুর্ঘটনা রাষ্ট্রায়ত্ত সেইল’র অ্যালয় ষ্টিল কারখানায়। ফার্নেস ফুটো দিয়ে গলিত লোহা পড়ে ভয়াবহ অগুন ছড়াল কারখানায়। প্রানহানি না হলেও আগুনের জেরে কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে কারখানায়। সোমবার সকালে ঘটনাটি ঘটেছে দুর্গাপুর অ্যালয় স্টিল কারখানার এসএমএস ইউনিটের ৩ নাম্বার ফার্নেস। কারখানার বেশ কয়েকটি দমকলের ইঞ্জিনের তৎপরতই নিয়ন্ত্রণে আসে আগুন। ঘটনার পর কারখানার উৎপাদন বন্ধ হয়ে পড়ে। কর্তৃপক্ষকের গাফিলতিকে দায়ী করে আধুনিকিকরনের দাবী তুলেছে শ্রমিক সংগঠন গুলি।
জানা গেছে, এদিন সকাল ১০ টা নাগাদ কাজ চলাকালীন এসএমএস ৩ ইউনিটের ফার্নেস ফুটো হয়ে গলিত লোহা বৈদ্যুতিক কেবল লাইনের ওপর পড়ে যায়। আর তাতেই আগুন লেগে যায় ফার্নেসে। ঘটনায় কোনো হতাহতের খবর নেই। ঘটনায় ব্যাপক আতঙ্ক ও ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে শ্রমিকদের মধ্যে। আগুন নিয়ন্ত্রনে আনতে কারখানার বেশ কয়েকটি দমকল ইঞ্জিিন তৎপর হয়। ঘন্টা দুয়েকের চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রনে আসলেও, কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে শ্রমিকদের দাবী। প্রায় ৫০ টন গলিত ইস্পাত নষ্ট হয়। প্রচুর কেবল পুড়ে যায়। ফার্নেস মেরামতির জন্য আপাতত ১০-১৫ দিন উৎপাদন বন্ধ। আর তাতেই ঘটনার পর প্রতিবাদ সরব হয়েছে কারখানার শ্রমিক সংগঠনগুলি।
প্রসঙ্গত, এই এসএমএস বিভাগে গত ৩ মার্চ ল্যাডেল থেকে গলিত লোহা ছিটকে পড়ে জখম হয় স্থায়ী কর্মী ঋষিরাজ দাস। প্রায় ৮০ শতাংশ পুড়ে যান তিনি। পরে বিধাননগরে একটি বেসরকারী হাসপাতালে মৃত্যু হয় তাঁর। তারপর এদিনের ঘটনায় আতঙ্ক ছড়িয়েছে শ্রমিক মহলে। শ্রমিকদের দাবী, গত কয়েকদিন ধরে ফার্নেসটি ঝুঁকিপুর্ন হওয়ায় কর্তৃপক্ষকে সেফটির জন্য জানানো হয়েছিল। কিন্তু বিষয়টি গুরুত্ব দেয়নি। ফলে এদিনের দুর্ঘটনা। আর তার জেরে কার্যত উৎপাদন বন্ধ হয়ে পড়ল অ্যালয় স্টিল কারখানায়। উল্লেখ, অ্যলয় স্টিল কারখানার ৪ টি ফার্নেস ছিল। যার মধ্যে বহুদিন আগে ১ নং ফার্নেস বোকারো পাঠানো হয়েছে। ২ নং ফার্নেসের ট্রান্সফরমার বিকল। ৪ নং ফার্নেস জন্মলগ্ন থেকে অকেজ। এদিন ৩ নং ফার্নেস দুর্ঘটনার জেরে বন্ধ হয়ে পড়ল। আর তাতেই প্রশ্ন উঠেছে, উল্লেখ্য, কারখানাটি বিলগ্নিকরনের জন্য উদ্যোগ নিয়েছিল কেন্দ্র সরকার। প্রশ্ন, তাহলে কি আধুনিকিকরন না করে কারখানাটিকে ‘অকেজ’ করার কোন কৌশল ছিল? যদিও সেসব তদন্ত সাপেক্ষ। দেশের মধ্যে ভারত সরকারের অন্যতম গুরুত্বপূর্ন ইস্পাত কারখানা দুর্গাপুর অ্যালয় স্টিল। বছর দুয়েক আগে বন্দে ভারত ট্রেনের এক্সেল তৈরীর গুরুত্বপুর্ন বিশেষ ইস্পাতে সরবরাহের বরাত পায় দুর্গাপুর অ্যালয় স্টীল। প্রথম পর্যায়ে বেঙ্গালুরুতে বন্দেভারত এক্সপ্রেস ট্রেনের চাকা তৈরির কারখানায় ৩৩ টন ইএ-ওয়ান এন গ্রেডের স্টিল পাঠিয়েছে দুর্গাপুর অ্যালয় স্টীল কারখানা।
এছাড়াও জানা গেছে, দেশের গুরুত্বপূর্ণ বিশেষধরনের ইস্পাত তৈরীতে খ্যাতি ও নজির রয়েছে দুর্গাপুর অ্যালয় স্টীলের। মুলত, প্রতিরক্ষা দফতরের সামগ্রী তৈরীতে গুরুত্বপুর্ন ভুমিকা য়েছে দুর্গাপুর অ্যালয় স্টীল কারখানা। এশিয়ার একমাত্র কারখানা যেখানে রঙ্গিন ইস্পাত তৈরী হয়। তাছাড়াও অগ্নি ক্ষেপনাস্ত্রের চাদর তৈরী জন্য বরাত পেয়েছিল। অতীতে বোফর্স কামানের গোলার চাদার তৈরী করে নজির গড়েছিল। তাছাড়াও প্রতিরক্ষা দফতরের ৪০০ টন স্পেড জ্যাকেল তৈরী করেছে। ‘বিক্রান্ত’ এয়ারক্রাপ্টের ক্যারিয়ার তৈরীর স্টীল তৈরী করেছে এই কারখানা। কার্গিল যুদ্ধের সময় আর্মাড গাড়ীর বুলেট প্রুফ শিল্ডিং হয়েছিল অ্যালয় স্টীল কারখানার স্টীলে। এখনও পর্যন্ত শতাধিক ধরনের প্রডাক্ট উৎপাদন করেছে অ্যালয় স্টিল। তারপর বন্দে ভারতের মতো গুরুত্বপুর্ন ট্রেনের এক্সেলের ইস্পাত তৈরী জন্য নজির সৃষ্টি করেছে। আর তাই দুর্গাপুর অ্যালয় স্টীলের সাফল্যে উচ্ছ্বসিত যেমন, তেমনই আবেগ জড়িয়ে রয়েছে শিল্পাঞ্চলের শ্রমিকমহল থেকে শিল্পশহরবাসী। লোকসান কাটিয়ে বন্দেভারত এক্সপ্রেসের হাত ধরে কারখানার ঘুরে দাঁড়ানোর আশা দেখছে শিল্পাঞ্চলের শ্রমিকমহল। স্বাভাবিকভাবে ওইরকম একটি কারখানাকে মৃত্যুরদিকে নিয়ে যাওয়ায় অখুশী শিল্পাঞ্চলবাসী।
কংগ্রেসের শ্রমিক সংগঠন আইএনটিইউসির নেতা রজত দীক্ষিত বলেন, ” সেইলর দুর্গাপুরে ডিএসপি ও এএসপি দুটো কারখানার যন্ত্রাংশ পুরোনো। তার ফলে প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটছে। শ্রমিকরা ঝুঁকি নিয়ে কাজ করছে। শ্রমিক নিরাপত্তা লাটে উঠেছে। আমরা বহুবার দাবী করেছি, দুর্গাপুরের এই কারখানা দুটি আধুনিকীকরণ করা হোক। তবুও কর্তৃপক্ষের কোনো গুরুত্ব নেই।” সিটু নেতা বিশ্বরূপ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন,” আমরা উদ্বিগ্ন। এদিনের ঘটনায় প্রচুর হট মেটাল নষ্ট হল। বড়সড় দুর্ঘটনা ঘটতে পারত। ইলেক্ট্রিক কেবেল পুড়ল। প্রচুর আর্থিক ক্ষতি হল। গুরুত্বপুর্ন এই কারখানায় উৎপাদন বন্ধে সব দিক দিয়ে প্রভাব পড়ল।” তিনি আরও বলেন,” পুরোনো কারখানা, লোকসান কাটিয়ে মুনাফার দিকে এগোচ্ছে। অথচ সেভাবে আধুনিকিকরন হয়নি। সঠিক নজরদারির অভাব। ফলে জটিল পরিস্থিতির মধ্যে শ্রমিক সুরক্ষা বিঘ্নিত হচ্ছে। স্বাভাবিকভাবেই কারখানাটি মৃত্যুর দিকে যাচ্ছে। সংস্থা ও কেন্দ্র সরকার সম্পূর্ন উদাসীন। তাই আমাদের আবারও দাবী জানাচ্ছি, নিয়মিত সেফটি কমিটির রুটিন পর্যবেক্ষন করতে হবে। কারখানার আধুনিকিকরণ, প্রযুক্তির ব্যাবহার ও অভিজ্ঞ শ্রমিক নিয়োগ জরুরী।” যদিও এবিষয়ে অ্যালয় ষ্টিল ও সেইল’র জনসংযোগ আধিকারিকের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে কোন প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি।