চলে গেলেন কুসংস্কারের বিরুদ্ধে লড়াকু সত্ত্বা, সমাজ সংস্কারক পদ্মশ্রী ভূষিত বিরুবালা রাভা

প্ৰয়াতের শেষকৃত্য সম্পূৰ্ণ রাজ্য মর্যাদায় সম্পন্ন করার নির্দেশ মুখ্যমন্ত্রী হিমন্তবিশ্বের

গুয়াহাটি১৩ মে (হি.স.) : চলে গেলেন কুসংস্কারের বিরুদ্ধে লড়াকু সত্ত্বা, সমাজ সংস্কারক পদ্মশ্রী ভূষিত (ড.) বিরুবালা রাভা। আজ সোমবার সকাল ৯:২৩ মিনিটে গুয়াহাটির স্টেট ক্যানসার ইনস্টিটিউটে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন অন্ধবিশ্বাস, কুসংস্কার, কালাজাদু ও ডাইনি সন্দেহে হত্যার বিরুদ্ধে নিরলস সংগ্ৰামী মানবাধিকার কর্মী বিরুবালা। দুরারোগ্য ক্যানসারে আক্রান্ত ছিলেন তিনি। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭০ বছর।

ক্যানসার-আক্রান্ত পদ্মশ্রী (ড.) বিরুবালা রাভার চিকিৎসার যাবতীয় ব্যয় বহনভার গ্রহণ করেছিল অসম সরকার। আজ সকালে তাঁর মৃত্য সংবাদ পেয়ে গুয়াহাটির স্টেট ক্যানসার ইনস্টিটিউটে গিয়ে প্রয়াতের মরদেহ জাতীয় পতাকা দিয়ে ঢেকে পুষ্পাঞ্জলি অর্পণ করে শেষ শ্রদ্ধা জানিয়েছেন রাজ্যের পরিষদীয় মন্ত্রী চন্দ্রমোহন পাটোয়ারি। এছাড়া আরও বহু বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গও হাসপাতালে গিয়ে বিরুবালার মরদেহে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করে শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণ করেছেন। মন্ত্রী পাটোয়ারির তত্বাবধানে প্রয়াত রাভার মরদেহ সুসজ্জিত শকটে করে গোয়ালপাড়া জেলার মেঘালয় সীমান্তবর্তী তাঁর ঠাকুরভিলা গ্রামে পাঠানোর ব্যবস্থা হয়েছে।

এদিকে পদ্মশ্রী (ড.) বিরুবালা রাভার শেষকৃত্য সম্পূৰ্ণ রাজ্য মর্যাদায় সম্পন্ন করতে নির্দেশ দিয়েছেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্তবিশ্ব শর্মা। দুই পরিষদীয় মন্ত্রী যথাক্রমে চন্দ্রমোহন পাটোয়ারি এবং জয়ন্তমল্ল বরুয়াকে প্ৰয়াত বিরুবালার শেষকৃত্য সুসম্পন্ন করতে তত্ত্বাবধান করতে নির্দশ দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী।

প্ৰসঙ্গত, অন্ধবিশ্বাস, কালাজাদু ও ডাইনি সন্দেহে হত্যার বিরুদ্ধে বিরুবালা রাভার নিরলস সংগ্ৰাম জাতীয় স্বীকৃতি অর্জন করেছে। ১৯৫৪ সালে অসমের গোয়ালপাড়া জেলার মেঘালয় সীমান্তবর্তী ঠাকুরভিলা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। জীবনের প্রথম দিকে ব্যক্তিগত চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়েছে বিরুবালাকে। পরিবারিক দৈন্যতার দরুন অল্প বয়সে স্কুল ছাড়তে হয়েছিল তাঁকে। এত বাধা সত্ত্বেও তিনি একজন শক্তিশালী সমাজকর্মী হিসেবে আবির্ভূত হয়ে প্রান্তিক সম্প্রদায়ের মানুষজনকে কুসংস্কারমুক্ত হতে নিরলস লড়াই করেছেন।

১৯৮৫ সালে গ্রামের এক হাতুড়ে বৈদ্য (তান্ত্ৰিক) কর্তৃক তাঁর ছেলের ভুল রোগ নির্ণয়ের সঙ্গে জড়িত বেদনাদায়ক অভিজ্ঞতা লাভ করেন বিরুবালা রাভা। এর পর তিনি সমাজ থেকে অন্ধবিশ্বাস দূর করতে সক্রিয় হয়ে ওঠেন। ছুটতে থাকেন গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে।

বছরের পর বছর অক্লান্ত পরিশ্রমের জন্য বিরুবালা রাভা অসংখ্য পুরস্কারে সম্মানিত হয়েছেন। এর মধ্যে ২০০৫ সালে নর্থইস্ট নেটওয়ার্ক তাঁকে নোবেল শান্তি পুরস্কার প্রদান করে। এছাড়া ২০১১ সালে সৰ্বেশ্বর দত্ত স্মারক, ২০০৮ সালে মুম্বাইয়ে ডেকে নিয়ে রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিডেট কর্তৃক সংবর্ধনা, ২০১৯ সালে নগাঁওয়ের আনন্দরম ঢেকিয়াল ফুকন মহাবিদ্যালয় কর্তৃক ‘আনন্দরাম ঢেকিয়াল ফুকন পুরস্কার, ২০১৫ সালে উপেন্দ্ৰনাথ ব্ৰহ্ম সোলজার অব হিউমিনিটি পুরস্কারে ভূষিত হয়েছিলেন বিরুবালা রাভা। তাছাড়া ২০১৫ সালে গুয়াহাটি বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে সম্মানসূচক ডক্টরেট উপাধি দেয়।

এদিকে ২০২১ সালে সামাজিক কাজে তাঁর উল্লেখযোগ্য অবদানকে স্বীকৃতি দেয় ভারত সরকার। ওই সালে তদানীন্তন রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দের হাত থেকে বিরুবালা রাভা মর্যাদাপূর্ণ পদ্মশ্রী সম্মাননা লাভ করেন।

অসম সরকার কর্তৃক প্রিভেনশন অব উইচ হান্টিং অ্যাক্ট, ২০১৫ প্রণয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন কুসংস্কার জাদুকরি শিকারের বিরুদ্ধে অক্লান্ত কর্মী বিরুবালা রাভা। এছাড়া গত ২৬ ফেব্ৰুয়ারি অসম বিধানসভায় যে ‘আসাম হিলিং (প্রিভেনশন অব ইভিল) প্র্যাকটিস বিল ২০২৪’ পাস হয়েছে, ওই বিল তৈরিতেও বিরুবালার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। এই বিল আইনে পরিণত হলে অসমে বন্ধ হবে প্রথাগত রোগ নিরাময় পদ্ধতি তথা জাদুকরি বিদ্যায় রোগব্যাধির চিকিৎসা, কুসংস্কার ও অন্ধবিশ্বাসজনিত কার্যকলাপ।

এদিকে ‘মিশন বিরুবালা’ নামে একটি সংগঠন গড়েছিলেন তিনি। ‘মিশন বিরুবালা’ সমাজে প্রচলিত ডাইনি শিকারের গুরুতর বিপদ সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করে চলেছে। তাঁর অনুপস্থিতিতেও ‘মিশন বিরুবালা’ সমাজ থেকে এই কুসংস্কার দূর করতে নিরলস কার্যক্রম চলিয়ে যাবে, জানান সংগঠনের জনৈক পদাধিকারী।