পূর্ববঙ্গের জমিদার বাড়ির ইতিহাস আর ঐতিহ্য নিয়ে টাকির ঘোষবাড়ির পুজো

উত্তর ২৪ পরগনা, ৪ অক্টোবর (হি. স.) : ইছামতী নদীর পশ্চিম পাড়ে উত্তর ২৪ পরগনা জেলার টাকি শহর। পূর্বপাড়ে বাংলাদেশ। এই শহরের ঘোষবাড়ির পুজো প্রায় ৩০০ বছরের বেশি সময় ধার হয়ে আসছে।আগে ইছামতী নদীতে দেবী দুর্গার বিসর্জনের এক আলাদা আকর্ষণ ছিল। আজ তা অতীত।

এবাড়ির পুরোনো দুর্গাদালানের সব খিলানে অবহেলা ও অযত্নের ছোঁয়া স্পষ্ট। তবে পলেস্তারা খসা ছাদের দেওয়ালে আজও জমিদারি মেজাজের আভাস পাওয়া যায়। প্রায় সাড়ে ৩০০ বছর আগে জমিদার হরিনারায়ণ ঘোষ এই পুজোর সুচনা করেন। অবিভক্ত বাংলার খুলনায় ঘোষদের জমিদারি ছিল। বহুকাল হল তাঁদের সেই জমিদারি নেই।

সেই জমিদার বংশের প্রথা অনুযায়ী এখনো সেই পালেস্তারা খসা দুর্গা দালানেই আজকের প্রজন্ম পুজো করে আসছে। ঘোষবাড়ির শচীন্দ্রনাথ ঘোষ, হিরণচন্দ্র ঘোষ, প্রতীকচন্দ্র ঘোষ, প্রসূন ঘোষরা একসময় এক বছর অন্তর শাক্ত মতে পাঁঠা বলি দিয়ে পুজো করতেন। পরে এই বংশের মতিলাল ঘোষ বৈষ্ণব ধর্ম নিলে বৈষ্ণব মত অনুযায়ী আখ ও চালকুমড়ো বলি শুরু হয়। সেই প্রথা আজও চালু রয়েছে। সাহসী মতিলাল লাঠি খেলায় সিদ্ধহস্ত ছিলেন।

কথিত আছে, একবার ডাকাতদের লড়াইয়ে হারিয়ে ৬-৭ জন ডাকাতকে বেঁধে টাকিতে নিয়ে আসেন তিনি। তখন থেকেই প্রবাদ চালু হয় টাকির লাঠি সাতক্ষীরার মাটি ও গোবরডাঙ্গার হাতি। সেসময়ে ঘোষদের বাড়িতে পুরসভার এক অস্থায়ী কার্যালয় ছিল। এখানে ঘোষদের আমন্ত্রণে নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু আসেন। শোনা যায় একসময় এই বাড়ির দুর্গাপুজোয় বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, শরৎ বোস এসেছিলেন।

এই বাড়ির পুজোর আরেকটা বৈশিষ্ট্য হল অষ্টমী তিথির কুমারী পুজো। এই পুজোর আরেকটা বিশেষত্ব, এইপুজোয় কোনো ভোগ রান্না হয় না। ভোগ হিসাবে মায়ের কাছে যা দেওয়া হয় রান্না না করা কাঁচা খাদ্যদ্রব্য। বিজয়া দশমীর দিন বাড়ির মেয়েরা সিঁদুর খেলায় মেতে ওঠেন।

টাকিতে পুর্ব পশ্চিম, উত্তর ও দক্ষিণ জমিদার বাড়ি থাকলেও একমাত্র পূর্বের বাড়ির পুজো ওপার বাংলায় শুরু হয়। একসময় মহিষ বলি দেখতে এখানে দূর দূরান্ত থেকে লোক আসতেন। সেই জাঁকজমকের প্রথা এখন লুপ্ত। এর বদলে এখন এখানে চালকুমড়া বলি দেওয়া হয়।

বলির প্রথা বদলালেও পুরোনো রীতি অনুযায়ী নির্দিষ্ট মাপের একচালার ডাকের সাজে বিরাট দুর্গামূর্তির দু’পাশে বিশালাকায় হাতপাখার বাতাস দেওয়ার রীতি এখনো চালু আছে। পুবের বাড়ির প্রতিমার চক্ষুদান করা হয় মহালয়ায়।

পুজোয় সন্ধিপুজোর আগে এক প্রসাদী ডালা দিয়ে পুজো দেওয়া হয়। কুলেশ্বরী কালী বাড়িতে। বিজয়া দশমীর দিন মা পান্তা ভাত, কচু শাকের ঘন্ট ও চালাতার চাটনি খেয়ে কৈলাসে রওনা দেন। টাকির সব দুর্গা প্রতিমার বিসর্জন ইছামতী নদীতেই হয়।

কাঁধে করে পায়ে হেঁটে পুবের বাড়ির প্রতিমা নৌকায় উঠলে তবে অন্যান্য প্রতিমা ইছামতীর নৌকায় ওঠে। একসময় দশমীর দিন ভারত বাংলাদেশ দু’দেশের সীমান্ত খোলা থাকত। বিসর্জনের সময় দুই দেশের সংস্কৃতি মিলেমিশে একাকার হয়ে যেত। কিন্তু নিরাপত্তার কারণে আজ সেই প্রথা বন্ধ হয়ে গেছে।