কালো তামাটে সবাই শ্বেত সরস্বতী

ড. রাজলক্ষ্মী বসু

আমার লক্ষ্মী মেয়েটা যে কিনা ভালো করে পড়াশোনা করবে বা আর দশ জনের থেকে একটু অন্যরকম হবে সেই তো সরস্বতী। আমাদের একটা ধারণা দেবী মূর্তি থেকে ঠিক এরকমই তৈরি হয়েছে, যেখানে শান্ত চিন্তনশীল মেয়ে মানেই সে হবে ফর্সা। আছে আজকের দিনেও এমন ধারনা। এবং প্রতীকী মূর্তির কারণেই হয়তো সে ধারনা কোথাও একটা আঁকড়ে রয়েছে মনে। সরস্বতীই বোধহয় প্রথম কোনো নারীবাদী রূপ যেখানে স্বয়ং ব্রহ্মাও নত শির। যদিও কেবলমাত্র নারীবাদী শব্দবন্ধে র নিগরে না রেখে বলতে পারি সরস্বতী এক শিকল ভাঙার প্রতীক। কিন্তু তাকে বড্ড বেশি সুন্দরী দেখানো হয়েছে, যা তার জ্ঞান প্রজ্ঞা বুদ্ধি এবং বিচারের গুণে ছটাময় তা ফুটিয়ে তোলার স্বার্থেই দেবী সৌন্দর্যময়ী। বিভূতিভূষণের মেঘমল্লারে যেভাবে সরস্বতী র রূপ বর্ণনা হয়েছে তা যেন কিঞ্চিত কল্পনা, এবং অনেকটাই বাহ্যিক রূপস্ফিত বর্ণনার আবরণে আবিষ্ট। বিনয় মমত্ববোধ এবং যুক্তি এইতো বিদ্যার তিন উপহার যা প্রতীকী সরস্বতী এবং আদতে আমরা যারা তার আরাধনা করছি তাদের সবাইকে সেই গুণপ্রযুক্ত করবে।

মেঘমল্লারে যেভাবে সরস্বতী র ছটা বর্ণিত তা বোধহয় আধুনিক বাংলার এক অন্যতম সংঞ্জা গঠন করেছে। সেখানে সরস্বতী আগমনে বলছে– মাঠের মাঝখানে শত পূর্ণিমার জ্যোৎস্নার মত অপরূপ আলোক মন্ডলে কে এক জ্যোৎস্নাবরণী অনিন্দ্যসুন্দরী মহিমাময়ী তরুণী! তাঁর নিবিড় কৃষ্ণ কেশরাজি অযত্নবিন্যস্ত ভাবে তাঁর অপূর্ব গ্রীবাদেশের পাশ দিয়ে ছড়িয়ে পড়েছে, তাঁর আয়ত নয়নের দীর্ঘ কৃপক্ষ কোন স্বর্গীয় শিল্পীর তুলি দিয়ে আঁকা, তাঁর তুষারধবল বাহুবল্লী দিব্য পুষ্পাভরণে মন্ডিত, তাঁর ক্ষীণ কটি নীল বসনের মধ্যে অর্ধলুক্কায়িত মণিমেখলায় দীপ্তমান, তাঁর রক্তকমলের মতো পা দুটিতে বুক পেতে নেবার জন্যে মাটিতে বাসন্তী পুষ্পের দল ফুটে উঠেছে—-। এই শাশ্বত অক্ষয় রূপ বর্ণনায় না হয় খানিক সময় জিরিয়ে নিই। মেঘমল্লারে ভদ্রাবতীর কালো জলের মাঝে দেবী সরস্বতী যেন ইতিবাচক দৃঢ়তার প্রতীক। কিন্তু কখনও কি মনে হয়না মুক্ত নারীর কল্পনাতে এখনও অনেকটাই যেন আমরা মেঘমল্লারে র প্রদ্যুম্ন র মতো। যে জড়।

আমদেরও ভালো মেয়ে মানেই যেন এমন এক রূপ ভাবনার জড়তা আছে। কিন্তু বাস্তবের শিকল ভাঙার কাজে যে যে মেয়ে এদেশে বা পশ্চিমেও এসেছে তারা আসলে এই বর্ণনার ধারকাছ দিয়েও যাননা। তাদের শুভ্রতা মনে ভাবনায় ভাবিয়ে তোলার দায়িত্বে ধরা দিয়েছে , চামড়া সেখানে কোনো মাত্রাই যে রাখেনা। সাবিত্রী বাই ফুলে থেকে কাদম্বিনী গাঙ্গুলী ( বসু) , বা ডক্টর আনন্দী দেবী যোশী কে বলুনতো ফর্সা? তবু কেন আমাদের পড়াশোনা করা ভালোমেয়ে মানেই তার সাথে লেজুড় যোগ হয় গায়ের রঙ। প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ বীণা মজুমদার বা যদি আরো পিছিয়ে যাই ডক্টর পূর্ণিমা সাহা ( যিনি প্রথম বাঙালি মহিলা হিসেবে ডক্টরেট লাভ করেন) , ডক্টর অসীমা চট্টোপাধ্যায়, স্বর্ণকুমারী দেবী কেউই যে তথাকথিত মেঘমল্লারে র মতো বাহ্যিক রূপে স্ফীত নন। আরো কার নাম ছেড়ে কার নাম বলি! রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন যিনি সুলতানার স্বপ্ন লিখে প্রথম নারীবাদী ইউটোপিয়ান সাহিত্য রচনা করেন। বা হাজার চুরাশির মা– সবাই যে গুণভারে ন্যুব্জ ব্যক্তিত্বে তাঁরা প্রতিষ্ঠিত। তাঁদের সামনে ব্রহ্মার মতো অনেক অহঙ্কারী পুরুষ নিঃশব্দে অহঙ্কার পাশের ঘরে রেখে তাদের সামনে নারী পুরুষের বিভাজন ভুলে মানুষ হিসেবে সামনে আসে। স্বাধীনতার পর মরিচঝাঁপির প্রতিবাদে বিনা দাসকেই সরব হতে হয়েছিল। তিনিও ঐশ্বর্যময়ী কিন্তু বর্ণনাময়ী সুন্দরী আদৌ নন। তাহলে কেন আমরা এখনও অবচেতনে এমনটাই ভাবি এবং পার্শ্বিক সচেতন ভাবে এটাই ভাবিয়ে তুলি যে, যে মেয়ে পড়াশোনা করবে সে চুপচাপ সে সুন্দর, সে সাত চড়ে রা কাটবে না কিন্তু বাস্তবের সব সরস্বতীই প্রতিবাদী এবং বাহ্যিকদিক থেকে তাদের রূপ চামড়ার রঙ বা ঠোঁটের আকৃতি আদালা করে বর্ণনা যোগ্য না হলেও তারাই পূজ্য। ওরাই আসল কালো বা তামাটে বা একটু কম সুন্দরী কিন্তু বেশী উন্মুক্তা সরস্বতী।

যদি আমরা রবীন্দ্র সাহিত্য দেখি, ঘরে বাইরে , যেখানে বিমলা এক দীপ্ত চরিত্র। মিস গিলবির কাছে লেখাপড়া শিখেও কবি যখন তাঁর বর্ণনা দিচ্ছেন তখন সে কালো ” কাঠখোট্টা”। আসলে এই বিমলাই বাস্তবে র সাথে মিল রাখে। ব্যক্তিত্বের সৌন্দর্য নিয়ে যেখানে একবার চর্চা শুরুহবে সেখানে ললিত সৌন্দর্য ঠাঁই পেলেও তা পিছিয়ে যায়। আসহায় আত্মসমর্পণ থেকে যখনই মেয়েরা বাহির হয়েছে তখনই তারা মনি মালিকা ছেড়ে বার হয়েছে। যদি বিশ্বের দর্পনে দেখি সেখানেও নারীর শৃঙ্খলা মুক্তিতে সেই কালো মেয়ে গুলোই এগিয়ে। সাদা চামড়া মানেই তা racism এবং তা যদি মেয়েদের হয়, তা sexism এমন কখনও বলছি না। কিন্তু যেভাবে আমাদের প্রতীকী দেবীর বাইরের রূপেই আমাদের সমাজের দৃষ্টিকে মোহান্বিত করা হয় যার ফলে অজান্তেই চামড়ার রঙের প্রতি অবশেসন তৈরি হয়। ওই রূপ যে আসলে কর্মগুণ তা বোঝাতে অনেক সময় আমরা ভুলে যাই। অ্যানা জুলি কুপার ( ১৮৫৮-১৯৬৪) সে চামড়ায় বড্ড কালো, কিন্তু বিশিষ্ট নারীমুক্তি র কলম। বা কেন বলব না প্যাট্রিসিয়া হিল বা গ্লোরিয়া জেন ওয়াটকিনস এর কথা? মারিয়া স্টুয়ার্ট ( ১৮০৩-৭৯) না থাকলে যে কালো মেয়েদের কেউ ভালো মেয়ে করতেই দিত না। সরস্বতী বন্দনা যেন আমাদের সেকেন্ড ওয়েভ ফেমিনিজমকে আরো সযত্নে লালন পালন করতে শেখায়। এ ব্যাপারে আমরা ভীষণ bold and snappy tongue — খুব মনে পরছে, সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের এক বক্তব্য। যেখানে তিনি সীতাকেও অন্যরূপে প্রতিভাত করছেন। আবার সেই শান্ত মেয়ে? কেন? জনমদুখিনী কে লেখক প্রথমবার বলছেন পরমেশ্বরী। এবং তিনিও শান্ত সৌম্য রূপ ছেড়ে প্রতিবাদী। ওই যে শান্তরূপ সেটাও আসলে পুরুষের ইচ্ছেতে বানানো। তা যেই প্রতিবাদী হয় তখন তাকে কালি রূপ দেওয়া হয়। সেকেন্ড ওয়েভ ফেমিনিজম আসলে ওটাই।

সরস্বতী ফার্স্ট ওয়েভ ফেমিনিজম । বেল হুকস এর এ নিয়ে তাৎপর্যপূর্ণ গবেষণাপত্র আছে Ain’t I a woman: Black woman and feminism যা ১৯৮১ তে প্রকাশিত যেখানে প্রতিষ্ঠিত করেন সাদা চামড়ার মোহ এবং মোহান্বিত করে তোলা কলোনিয়ালিজমের বাই প্রোডাক্ট এবং কালো মেয়েরা জোরালো কিছু করতে একটু বেশি পরিশ্রম করবে এটাও আসলে সাদা মেয়েদের সৌন্দর্য এক্সপ্লয়টেশনের পরোক্ষ পথ। সরস্বতী পূজোর লগ্নে আমাদের এর প্রকৃত অর্থ পুর্ণবিবেচনা করতে হবে। তিনি কেবলমাত্র দুলে দুলে পড়লাম আর নাচ গান আঁকার দেবী নন। তিনি দরকারে কঠিন। প্রণাম মন্ত্রে বলা আছে — ওঁ ভদ্রকাল্যৈ নমো নিত্যং সরস্বত্যৈ নমো নমঃ– এতো যেন তান্ত্রিক পরিচয়। বিভিন্ন মূর্তিতে তাঁর হাতে তরবারি। বৌদ্ধতন্ত্রে তিনি যেমন জ্ঞানী তেমনই তেজী। নলিনীকান্ত ভট্টশালী বলেছিলেন বাংলা র কোথাও কোথাও সরস্বতী পূজোর দিন ভেড়া বলি হয়। মার্কন্ডেয় পুরানে আবার শুম্ভ- নিশুম্ভ অসুর বধের সময় যে মূর্তি কল্পনা করা হয়েছিল তা মহাসরস্বতী। অর্থাত আমরা যেন এই ধারণা থেকে মুক্ত হই একটা সুন্দর মেয়ে মানেই সে ফুটফুটে আর মুখস্তবিদ্যা আর শান্ত। দেবীর মূর্তি যা স্কুলে পূজিত তা একটা দিন যাপনের নিমিত্ত। একটা পূজো পূজো ছুটির দিন। কিন্তু তার নিবিড় অর্থ বুঝতে গেলে সবার আগে দেখিয়ে তোলার চোখ তৈরি করতে হবে যেখানে ভিতরের সৌন্দর্য সন্ধান করার পিপাসা তৈরি হবে। যেখানে শুভ্র মানে জ্ঞান- মুক্ত ভাবনা – দর্শন- উন্নত জীবন দৃষ্টি। ড. আম্বেদকর একবার Hinduism এর ভুল আচরণ নিয়ে বলতে গিয়ে বলেছেন inimical to equality, antagonistic to liberty, and opposed to fraternity– মূর্তি নির্ভর ভাবনা যাদের তারা নির্ঘাত এই ফাঁদে পরেন। আর তা এক ক্রুয়েল ভুল। সরস্বতী বন্দনা আসলে ক্যাপাসিটি বিল্ডিং এর প্রোগ্রাম। আর সেখানে রঙ বর্ণ ধর্ম সবকিছু পেছনের বেঞ্চে। দেবীর রূপ আসলে বইয়ের মলাট। এবার পৃষ্ঠা উল্টানোর পালা।

( এই প্রবন্ধে লেখা বক্তব্য সম্পূর্ণ লেখকের ব্যক্তিগত অভিমত। সম্পাদক এর জন্য দায়ী নন। )

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *