কোহিমা, ৫ ডিসেম্বর (হি.স.)৷৷ নাগাল্যান্ডে নিরাপত্তা বাহিনীর গুলি বর্ষণের ঘটনায় আজ রবিবার বিকেল পর্যন্ত নিহতের সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ১৬৷ গতকালের ঘটনায় উত্তেজিত জনতার হামলায় এক সেনা জওয়ানের মৃত্যুর পাশাপাশি ছয় জওয়ান আহত হয়েছেন৷ পোড়ানো হয়েছে সেনাবাহিনীর তিনটি গাড়ি৷
ঘটনার তীব্র নিন্দা জানিয়ে উচ্চস্তরীয় এসআইটি গঠন করে নিরপেক্ষ তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী নেইফিউ রিও৷ শান্তি বজায় রাখতে জনসাধারণের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন তিনি৷ মুখ্যমন্ত্রী আজ তড়িঘড়ি দিল্লি থেকে রাজ্যে ফিরেছেন৷ আসাম রাইফেলস-এর গুলি বর্ষণ এবং নিরীহ গরিব নাগরিকদের মৃত্যুর পরিপ্রেক্ষিতে মুখ্যমন্ত্রী জরুরি ক্যাবিনেট বৈঠক ডাকতে পারেন বলে জানা গেছে৷
এদিকে, কোহিমায় অবস্থিত প্রতিরক্ষা দফতরের জনসংযোগ আধিকারিক সুমিত কে শর্মা গতকাল সংঘটিত ঘটনার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছেন৷ এক বিবৃতিতে জনসংযোগ আধিকারিক বলেছেন, ‘শনিবার সংঘটিত দুর্ভাগ্যজনক ঘটনায় প্রাণহানির কারণ উদঘাটন করতে সবর্োচ্চ স্তরে তদন্ত করা হচ্ছে৷ তদন্ত রিপোর্টের ভিত্তিতে যথাযথ আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে৷’
জনসংযোগ আধিকারিক শর্মা বিবৃতিতে আরও বলেছেন, উগ্রপন্থীদের সম্ভাব্য গতিবিধি সম্পর্কে একটি সতর্কবার্তা পেয়ে শনিবার বিকেলে তাঁরা ওটিং গ্রামের কাছে অতর্কিত হামলা করেছিলেন৷
ঘটনা গতকাল শনিবার বিকেলে নাগাল্যান্ডের মায়ানমার সীমান্ত-ঘেঁষা মন জেলার তিরু ও ওটিং গ্রামের মধ্যবর্তী রাস্তায় সংঘটিত হয়েছে৷ তিরু গ্রামের কয়লা খাদানে দৈনন্দিন কাজ সমাপ্ত করে ওটিং গ্রামের মানুষ একটি পিক-আপ মিনি ট্রাকে করে তাদের ঘরে ফিরছিলেন৷ সে সময় এরা জঙ্গি সদস্য ধারণা করে আসাম রাইফেলস-এর জওয়ানরা গুলি বর্ষণ করতে থাকেন৷ গুলি বর্ষণে ঘটনাস্থলে ছয় (৬) জনের মৃত্যু হয়৷ আহত বহুজনকে নিয়ে যাওয়া হয় নিকটবর্তী হাসপাতালে৷ সেখানে গত রাত থেকে আজ বিকেল পর্যন্ত আরও নয় (৯) জনের মৃত্যু হয়েছে৷ ফলে এখন পর্যন্ত গুলিবিদ্ধ হয়ে মোট ১৫ জন গ্রামবাসী মৃত্যুবরণ করেছেন, জানা গেছে বিশেষ সূত্রে৷
এদিকে, অবাঞ্ছিত এবং গ্রামের নিরীহ বাসিন্দাদের ওপর নির্বিচারে গুলি করে মেরে ফেলার খবরে বিকেল থেকে গোটা রাত এলাকা উত্তপ্ত হয়ে ওঠে৷ গ্রামের উত্তেজিত জনতা রাস্তায় বের হয়ে নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর হামলা চালান৷ তাঁরা নিরাপত্তা বাহিনীর টাটা সুমো, জিপসি সহ তিনটি গাড়িতে আগুন ধরিয়ে ভস্ম করে দেন৷ গ্রামবাসীর আক্রমণে আসাম রাইফেলস-এর এক জওয়ানের মৃত্যু হয়েছে৷ তাঁকে উত্তরাখণ্ডের বাসিন্দা গৌতম লাল বলে শনাক্ত করা হয়েছে৷ এছাড়া গণ-হামলায় আহত হয়েছেন আরও ছয় (৬) জওয়ান৷ তাঁদের চারজনকে দিনজান হাসপাতাল এবং দুজনকে ডিব্রুগড় মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে ভরতি করা হয়েছে৷
এদিকে নাম প্রকাশ গোপন রাখার শর্তে নিরাপত্তা বাহিনীর জনৈক আধিকারিক বলেছেন, ‘সম্ভবত ভুল বোঝাবুঝির দরুন অপ্রত্যাশিত ঘটনাটি সংঘটিত হয়েছে৷ তবে ওই এলাকায় এনএসসিএন (কে) জঙ্গি গোষ্ঠীর একটি বড় দল ঘাঁটি গেড়েছে বলে এক খবর ছিল৷ এই খবরের ওপর ভিত্তি করে সম্ভবত কয়লা শ্রমিকদের জঙ্গি ক্যাডার ভেবে তাদের ওপর গুলি বর্ষণ করা হয়েছে৷ অবশ্য গোটা ঘটনার তদন্ত হলে প্রকৃত রহস্য বের হবে৷’
কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহও সেনা-জনতার সংঘর্ষে নিহতদের প্রতি গভীর শোক প্রকাশ করে তাঁদের পরিবারবর্গকে সমবেদনা জানিয়েছেন৷ মুখ্যমন্ত্রী কর্তৃক নির্দেশিত গুলি বর্ষণের স্পেশাল এসআইটি তদন্তে আসল ঘটনা প্রকাশ পাবে বলে আশা ব্যক্ত করেছেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী৷ রাজ্য সরকার যে উচ্চস্তরীয় সিট গঠন করেছে, তার মাধ্যমে ঘটনার প্রকৃত ঘটনা প্রকাশ পাবে এবং নিশ্চিভাবে ভুক্তভোগীদের ন্যায় পাইয়ে দেওয়া হবে, ট্যুইটে লিখেছেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত৷
অন্যদিকে, গতকাল সংঘটিত ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী কঠোর নিন্দা জানিয়ে নিহতদের প্রতি গভীর শোক ব্যক্ত করেছেন৷ তিনি গোটা ঘটনার তদন্ত করতে উচ্চস্তরীয় স্পেশাল ইনভেস্টিগেটিভ টিম (এসআইটি) গঠন করার নির্দেশ দিয়েছেন৷ মুখ্যমন্ত্রী তাঁর অফিশিয়াল ট্যুইটে এ সম্পর্কে লিখেছেন, ‘মন-এর ওটিং গ্রামে সাধারণ নাগরিকদের হত্যাকাণ্ড দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা এবং অত্যন্ত নিন্দনীয়৷ শোকাহত পরিবারের প্রতি সমবেদনা এবং আহতদের দ্রুত আরোগ্য কামনা করছি৷ উচ্চস্তরের এসআইটি তদন্ত করে দেশের আইন অনুযায়ী ভুক্তভোগীদের ন্যায়বিচার প্রদান করবে৷’ মুখ্যমন্ত্রী রাজ্যের সর্বস্তরের জনগণের কাছে শান্তি বজায় রাখার আবেদন জানিয়েছেন টুইটবার্তায়৷
গতকাল শনিবার বিকেলে নাগাল্যান্ডের মায়ানমার সীমান্ত-ঘেঁষা মন জেলার তিরু ও ওটিং গ্রামে আধাসেনা গুলি করে নিরীহ গরিব ১৫ জন নাগরিককে মেরে ফেলায় জ্বলছে মন শহর৷ আজ বিকেলে উত্তেজিত হাজারো জনতা মন শহরে অবস্থিত আসাম রাইফেলস-এর আউটপোস্টে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর ও অগ্ণিসংযোগ করেছেন৷ অবস্থা নিয়ন্ত্রণে আনতে সেনাবাহিনী শূন্যে বেশ কয়েক রাউন্ড গুলি ছুঁড়েছে৷
গতকালের ঘটনার পর আজ সকাল থেকে কাতারে কাতারে সাধারণ নাগরিক মন শহরে এসে জমায়েত হয়ে উত্তাল বিক্ষোভ প্রদর্শন করতে থাকেন৷ তবে গণ-হামলায় কোনও জওয়ান আহত হয়েছেন কি না জানা যায়নি৷ আসাম রাইফেলস-এর আউটপোস্ট চত্বরের বেশ কয়েকটি এলাকায় আকাশে কালো ধোঁয়া দেখা যাচ্ছে৷ কোহিমার কিসামায় চলমান রাজ্যের প্রধান উৎসব হর্নবিল-এর সময় এ ধরনের নৃশংস ঘটনায় গোটা রাজ্য উত্তাল হয়ে উঠেছে৷ ইতিমধ্যে নাগাদের জাতীয় সংগঠন ‘হর্নবিল উৎসব’-এ অংশগ্রহণ করবে না ‘কন্যাক ইউনিয়ন’ এবং ছয়টি নাগা জনগোষ্ঠীকে নিয়ে গঠিত ‘দ্য ইস্টার্ন নাগাল্যান্ড পিউপিলসর্গানাইজেশ্’ (ইএনপিও) হর্নবিন উৎসবে অংশগ্রহণ না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে৷
এদিকে, গুজব ছড়িয়ে যাতে উত্তেজনার সৃষ্টি না হয়, সে জন্য মন জেলায় ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ করে দিয়েছে রাজ্যের গৃহ দফতর৷ এ প্রসঙ্গে নাগাল্যান্ডের গৃহ দফতরের কমিশনার অভিজিৎ সিনহা বলেছেন, ভারতীয় টেলিগ্রাফ আইন ১৯৮৫-এর ধারা ৫-এর অধীনে অপপ্রচারে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে৷ যে এই নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘন করে অপপ্রচার চালাবে, তাকে সিআরপিসি-র ১৮৮-র অধীনে এবং ভারতীয় টেলিগ্রাফ আইনের সংশ্লিষ্ট ধারায় শাস্তি দেওয়া হবে৷ তিনি জানান, ইতিমধ্যে অস্থিরতা মোকাবিলায় মন জেলায় মোবাইল ডেটা এবং বাল্ক ম্যাসেজিং পরিষেবা আপাতত স্থগিত রাখা হয়েছে৷ মোবাইল ইন্টারনেট / ডেটা সার্ভিস / সমস্ত পরিষেবা প্রদানকারীর বাল্ক এসএমএস সমগ্র মন জেলায় অবিলম্বে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত কার্যকর হয়েছে, জানান গৃহ দফতরের কমিশনার অভিজিৎ সিনহা৷
আসাম রাইফেলস-এর এক আধিকারিক সূত্রে জানা গেছে, মায়ানমার সীমান্তবর্তী মন জেলায় উগ্রপন্থী বিরোধী অভিযানের জন্য তাঁরা সর্বদা প্রস্তুত৷ কেননা, এনএসসিএন-এর বিভিন্ন গোষ্ঠী এবং উত্তর-পূর্বাঞ্চলের অন্যান্য উগ্রপন্থী সংগঠনগুলি ভারত ভূখণ্ডে এসে জঙ্গি কার্যকলাপ সংগঠিত করে মায়ানমারে পালিয়ে যায়৷ তাই এই জেলা অত্যন্ত স্পর্শকাতর বলে চিহ্ণিত৷ এরই প্রতিফলন গতকাল হয়েছে৷ ওটিং গ্রামে এনএসসিএন (কে) জঙ্গি গোষ্ঠীর একটি বড় দল ঘাঁটি গেড়েছে বলে এক খবর ছিল৷ ওই খবরের ওপর ভিত্তি করে কয়লা শ্রমিকদের জঙ্গি ক্যাডার ভেবে তাদের ওপর গুলি বর্ষণ করা হয়েছিল৷ তবে গোটা ঘটনার তদন্ত হবে৷ তদন্তে গতকালের গুলি বর্ষণের প্রকৃত কারণ বের হবে, বলেছেন আধিকারিকটি৷