নিজস্ব প্রতিনিধি, আগরতলা, ১৯ আগস্ট৷৷ মহারাজা বীরবিক্রমকে নিয়ে উপেক্ষার রাজনীতি হয়েছে বাম জমানায়, অভিযোগ করলেন তিপ্রা মথা চেয়ারম্যান তথা এমডিসি প্রদ্যুৎ কিশোর দেববর্মন৷ অন্যদিকে, মুখ্যমন্ত্রী বিপ্লব কুমার দেব জানিয়েছেন মহারাজ বীর বিক্রমকে যোগ্য সম্মান দেয়া হবে, নিরাশ না হতে আহ্বান জানিয়েছেন তিনি৷ মুখ্যমন্ত্রী বিপ্লব দেব আগরতলায় বীরবিক্রম কিশোর মানিক্যের জন্মবার্ষিকীতে শ্রদ্ধা জানিয়ে বক্তব্য রাখতে দিয়ে একথা বলেছেন৷ অন্যদিকে, খুূমুলুঙে মহারাজ বীর বিক্রম কিশোর মানিক্যের মর্মর মূর্তির আবরণ উন্মোচন করেছেন প্রদ্যুৎ৷
নিরাশ না হয়ে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার উপর গুরত্ব দিলেন মুখ্যমন্ত্রী বিপ্লব কুমার দেব৷ যারা মানুষকে বিভ্রান্ত করছে সে সব বিভিষনদের চিহ্ণিত করার পরামর্শ দেন তিনি৷ মহারাজা বীরবিক্রম কিশোর মানিক্য বাহাদুরের ১১৩ তম জন্মবার্ষিকীতে তার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে একথা বলেন তিনি৷ সারা রাজ্যে বৃহস্পতিবার নানা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে মহারাজাকে স্মরণ করা হয়৷ জনজাতি এলাকার উন্নয়ন থেকে শুরু করে রাজ্য সরকারের নানাবিধ ঐতিহাসিক সিদ্ধান্তগুলো ছিল তার বক্তব্যে৷ তিনি নাম না করে বামেদের সমালোচনা করেন৷ মুখ্যমন্ত্রী বলেন, নিজের রাজ্যের মনিষীদের স্মরন না করে বিদেশি মানসিকতা সম্পন্ন নেতারা গত ৪০ বছর ধরে রাজ্যের মানুষকে বিভ্রান্ত করে রেখেছিল৷ ইতিহাসকে বিকৃত করেছিল তারা৷এখন রাজ্যের মানুষ এ রাজ্যের রাজাদের সম্মান দিচ্ছে৷
আগামী বিধানসভা সভা নির্বাচনের বাকি দেড় বছর হলেও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে শুরু হয়েছে তৎপরতা৷ তিপ্রা মথার চেয়ারম্যান প্রদুত কিশোর দেববর্মনকে নিয়ে দড়িটানাটানির রাজনীতি চলছে৷ বৃহস্পতিবার এডিসির সদর দপ্তর খুমলুঙে মহারাজা বীরবিক্রম কিশোর মানিক্য বাহাদুরের ১১৩ তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে ভাষন দিতে গিয়ে বিষয়টি স্পষ্ট করে দেন তিপ্রামথার চেয়ারম্যান প্রদুত বিক্রম কিশোর মানিক্য৷
তিনি বলেন কোন রাজনৈতিক দলের সাথে জোট নয়৷ রাজ্যের ১৯ টি জনজাতি সম্প্রদায়কে একজোট হওয়ার আহ্বান জানান তিনি৷ আগামী ২০২৩ সালের বিধানসভা ভোটে রাজ্যের জনজাতিদের মধ্যে জোট হওয়া উচিত৷ আগামী বিধানসভা ভোট যে তার লক্ষ্য তিনি বুঝিয়ে দিয়েছেন৷ তিনি এডিসি প্রশাসনকে মহারাজা বীরবিক্রম কিশোর মানিক্য বাহাদুরের নামে স্কলারশিপ চালু করার জন্য তহবিল তৈরি করতে বলেছেন৷ বৃহস্পতিবার এডিসি প্রশাসনের উদ্যোগে মহারাজা বীরবিক্রম কিশোর মানিক্য বাহাদুরের ১১৩ তম জন্মবার্ষিকী পালন কর্মসূচিতে অংশ নিয়ে তিপ্রা মথার চেয়ারম্যান প্রদুত কিশোর দেববর্মন রাজন্য শাসিত ত্রিপুরার উন্নয়নের চিত্র তুলে ধরেন৷ শুধু বিমানবন্দরের নাম মহারাজার নামে নামাঙ্কিত করলে হবে না৷ রাজ্যের এক একজন জনজাতি অংশের ছেলে মেয়েকে পাইলট তৈরি করতে হবে৷ তিনি জনজাতি অংশের মানুষকে একে অপরের বিরুদ্ধে হিংসা না করতে পরামর্শ দেন৷ এতে আখেরে নিজেদের ক্ষতি হয়৷
বৃহস্পতিবার খুমলুঙে মহারাজার পুর্নাবয়ব মুর্তির আবরন উন্মোচন করেন তিনি৷ রাজ পরিবারের অর্থে এই মুর্তি তৈরি করা হয়েছে বলে তিনি জানান৷ তিনি বামেদের সমালোচনা করে বলেন রাজ্যে বাম আমলে বিদেশি নেতা কাল মার্কস, স্টেলিনের স্ট্যাচু বসানে হয়েছিল৷ তিনি বলেন ইংরেজ সরকারও তাজমহল, বা কোন মসজিদের নাম পরিবর্তন করে নি৷ কিন্তু বাম সরকার উজ্জ্বয়ন্ত প্রাসাদের নাম পরিবর্তন করতে চেয়েছিল৷ বর্তমান সরকার মহারাজার জন্মদিন পালনের যে উদ্যোগ নিয়েছে তাকে সাধুবাদ জানান তিনি৷ তিনি বলেন, নেতিবাচক মনোভাব ঠিক নয়৷ বাম নেতা প্রাক্তন সাংসদ জিতেন্দ্র চৌধুরী দিল্লি থেকে ইতিবাচক ম্যাসেজ দিয়েছেন বলে তিনি উল্লেখ করেন৷ মহারাজ রাজ্যে যে ভিত্তি তৈরী করেছেন তার জন্য তাকে শ্রদ্ধা জানানো উচিত বলে তিনি উল্লেখ করেন৷ প্রদুত কিশোর মানিক্য জনগণকে আত্মবিশ্বাস বাড়াতে পরামর্শ দেন৷ তিনি বলেন, কম রাজনীতি প্রয়োজন৷ বেশি রাজনীতি হলে উন্নয়নের গতি থেমে যায়৷ রাজ্য পিছিয়ে পরে৷ রাজনীতিকে পেছনে রেখে উন্নয়নকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার উপর তিনি জোর দেন৷ নেতৃত্বের অহংকার ঠিক নয়৷ বিজয় মিছিলের নামে ভাঙচুর, ভায়োলেন্স একটি রাজ্যকে পিছিয়ে দেয়৷ অনুষ্ঠানে এডিসির মুখ্য কার্ষনির্বাহী সদস্য সহ কার্যনির্বাহী সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন৷
মুখ্যমন্ত্রীর কথায়, মহারাজা বীরবিক্রম কিশোর মাণিক্য বাহাদুর দেববর্মণ ছিলেন দূরদৃষ্টি সম্পন্ন এক বিচক্ষণ ব্যক্তিত্ব৷ আধুনিক ত্রিপুরা গড়ার ভাবনায় তাঁর নেতৃত্ব অল্প সময়ের মধ্যে ত্রিপুরাকে শিক্ষা সহ অন্যান্য ক্ষেত্রেও প্রভূত উন্নতির শিকড়ে পৌঁছে দিয়েছিল৷ তাঁর নির্দেশিত পথে হাঁটলে আরও আগেই শ্রেষ্ঠ ত্রিপুরা নির্মাণ করা সম্ভব হত৷ বর্তমান সরকার তাঁর ভাবনায় আধুনিক ও সমৃদ্ধশালী ত্রিপুরা নির্মাণের লক্ষ্যে কাজ করছে, দৃঢ়তার সাথে বলেন মুখ্যমন্ত্রী৷ সাথে তাঁর দাবি, ভারতীয় বা রাজ্যের সংসৃকতির সঙ্গে সম্পর্কিত নয় এমন একটি ভিন্ন মানসিকতাকে বিগত দিনে রাজ্যে অধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে৷ ত্রিপুরার প্রকৃত ইতিহাস বা রাজাদের অবদান সম্পর্কে জানার সুযোগ থেকে রাজ্যবাসীকে সুকৌশলে মুখ ঘুরিয়ে দেওয়ার একটা অপচেষ্টা লক্ষ্য করা গিয়েছিল৷ কিন্তু বর্তমান সরকার ত্রিপুরার উন্নয়নে মহারাজাদের যে অবদান ছিল তার প্রতি শ্রদ্ধাশীল৷ কারণ আমরা বিশ্বাস করি, ত্রিপুরার রাজন্য স্মৃতি বিজড়িত ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংসৃকতিই হল রাজ্যের মূল শক্তি, প্রত্যয়ের সুরে বলেন তিনি৷
তিনি জানান, মহারাজার প্রতি সম্মান জানানোর লক্ষ্যে একাধিক পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে৷ এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল, মহারাজার জন্মজয়ন্তী দিনটিকে সরকারি ছুটি ঘোষণা, সরকারিভাবে মহারাজার জন্মজয়ন্তী পালনের উদ্যোগ সহ আগরতলা বিমানবন্দরের নাম মহারাজা বীরবিক্রম কিশোরের নামে নামাঙ্কিত করা হয়েছে৷ তিনি বলেন, বর্তমান সরকার মহারাজা বীরবিক্রম কিশোর মাণিক্য বাহাদুর দেববর্মণের দৃষ্টিভঙ্গিতে অনুপ্রাণিত হয়ে রাজ্যের সর্বাঙ্গীন বিকাশের লক্ষ্যে বিভিন্ন পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করছে৷ সাথে তিনি যোগ করেন, ত্রিপুরার ভারতভুক্তিতে মহারানি কাঞ্চনপ্রভা দেবী বলিষ্ঠ পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন৷ কিন্তু রাজাদের ইতিহাস সবর্োপরি ত্রিপুরার ইতিহাসের প্রতি বিগত দিনে প্রকৃত শ্রদ্ধা প্রদর্শন করা হয়নি৷
বিপ্লব দেব বলেন, মহারাজা বীরবিক্রম কিশোর মাণিক্য শিক্ষা থেকে শুরু করে বিভিন্ন ক্ষেত্রে শুধুমাত্র পরিকাঠামো উন্নয়নেই সীমাবদ্ধ থাকেননি৷ সঠিক মূল্যায়ন ও পর্যালোচনার মাধ্যমে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন৷ রাজ্য সরকারও শিক্ষার ভিতকে আরও সুদৃঢ় করতে এনসিইআরটি পাঠক্রম চালু, ১০০টি বিদ্যালয়কে সিবিএসই-র আওতায় আনা, ১৮টি একলব্য বিদ্যালয় স্থাপনের মতো একাধিক পরিকল্পনা নিয়েছে৷ বঞ্চনার স্লোগানের বদলে সঠিক কর্মপরিকল্পনার মাধ্যমে রাজ্যের সর্বাঙ্গীন বিকাশে সরকার বিশ্বাসী৷
এদিন তিনি দাবি করেন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, প্রাথমিক ক্ষেত্র, পানীয়জল সহ সমস্ত ক্ষেত্রে উন্নয়নের মাপকাঠিতে রাজ্য বহুলাংশেই অগ্রগতি হয়েছে৷ ত্রিপুরায় জনজাতিদের কল্যাণে বর্তমান সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে৷ সঠিক ব্যবস্থাপনার ফলে কোভিড পরিস্থিতির মধ্যেও ত্রিপুরার অর্থনীতি পিছিয়ে যায়নি৷ তিনি বলেন, ত্রিপুরায় জনজাতিদের সম্মানে গড়িয়া পূজায় সরকারি ছুটি দু’দিন করা, বড়মুড়া পাহাড়ের নাম হাতাইকতর করা, সমাজপতিদের সামাজিকভাতার ব্যবস্থা, টিটিএএডিসির আসন সংখ্যা বাড়িয়ে ৫০টি করা সহ টিটিএএডিসির নামকরণ তিপ্রা টেরিটোরিয়াল কাউন্সিল করার প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে৷
সাথে তিনি যোগ করেন, দীর্ঘ প্রতীক্ষিত রিয়াংদের পুনর্বাসন সমস্যার স্থায়ী সমাধান করা হয়েছে৷ সুষ্ঠু কর্মসংসৃকতি ও শ্রমিকদের অর্জিত অধিকার রক্ষায় সরকার গুরুত্ব দিয়েছে৷ রাজ্যে স্বরোজগারের মানসিকতা গড়ে উঠেছে৷ কাঁঠাল ও আনারস সহ বিভিন্ন প্রকল্প রাজ্যে রোজগারের নতুন দিশা দেখাচ্ছে৷ কিন্তু একটা অংশ বিভ্রান্তি ছড়ানোর কাজে লিপ্ত৷ এ-সব প্রচেষ্টাকে ব্যর্থ করে রাজ্যের শুভবুদ্ধি সম্পন্ন নাগরিকদের সার্বিক প্রচেষ্টায় ত্রিপুরা কোভিড টিকাকরণে সমগ্র দেশে উল্লেখযোগ্য স্থান দখল করে আছে, প্রত্যয়ের সুর মুখ্যমন্ত্রীর৷
মুখ্যমন্ত্রী আরও বলেন, দিল্লির সাথে সরাসরি বিমান যোগাযোগ, একাধিক এক্সপ্রেস ট্রেন, উন্নত হাইওয়ের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর হীরা মডেলের বাস্তবায়নের ফলে রাজ্যের উন্নয়নে আরও গতি আসছে৷ রাজ্যের গর্ব রোসেম বাদক থাঙ্গা ডার্লং, সত্যরাম রিয়াং ও বেণীচন্দ্র জমাতিয়ারা নিজেদের শিল্পকর্ম ও সৃজনশীল কর্মকাণ্ড বহুকাল ধরে চালিয়ে আসলেও বর্তমানে তাঁদের খুঁজে বের করে সম্মানিত করেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী৷ এখানেই দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য, দাবি মুখ্যমন্ত্রীর৷

