পাথরপ্রতিমায় প্রতিদ্বন্দ্বী তিন শিক্ষকের কে শেষ হাসি হাসবেন, তা জানতে অপেক্ষায় সবাই

অশোক সেনগুপ্ত

কলকাতা, ৩০ মার্চ (হি.স.): নদী-সমুদ্রে ঘিরে রাখা সুন্দরবনের জনপদ পাথরপ্রতিমা। বাম আমলে ছিল বামেদের শক্ত ঠাঁই। তৃণমূলের জমানায় ঘাসফুলের প্রায় নিশ্চিন্ত আসন। প্রায় বলছি এ কারণে, বিগত ভোটগুলোর অঙ্কের হিসাবে প্রতিপক্ষদের চেয়ে অনেকটাই এগিয়ে তৃণমূল। ওই দলের গত দু’বারের বিধায়ক সমীর কুমার জানা এবারেও তৃণমূলের প্রার্থী হয়েছেন। হ্যাটট্রিকের আশায় দিন গুনছেন। যদিও এলাকাবাসী জানতে চায় কংক্রিটের বাঁধ, জেটিঘাট হবে কবে?
তাঁর বয়স ৭০-এর ওপর। জন্ম এই পাথরপ্রaতিমাতেই, দীগম্বরপুর গ্রাম পঞ্চায়েতে। এ কথার সঙ্গে সমীরবাবু হিন্দুস্থান সমাচার-কে জানাতে ভুললেন না, ভারতসেরা গ্রাম পঞ্চায়েতের শিরোপা পেয়েছে এটি। বললেন, “১৯৭২ থেকে কংগ্রেস করতেন। ১৯৭৮-এ পঞ্চায়েত সমিতি তৈরি হলে প্রথম দুটি মেয়াদে সমিতির সদস্য, তার পরের মেয়াদে (’৮৮-’৯৩) উপপ্রধান। ১৯৯৮-এ তৃণমূলের জন্মলগ্ন থেকে আমি দলের ব্লক সভাপতি।” জানালেন, ১৯৯৯-এর উপনির্বাচন, ২০০১ ও ’০৬-এর ভোট— উপর্যুপরি তিনটি বিধানসভা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেও তিনি জিততে পারেননি। সিপিএম-এর অত্যাচারে ২০১১ পর্যন্ত আমরা ১০ জন কর্মীকে হারিয়েছি। দেড়শ বাড়িতে আগুন ধরেছে। এলাকায় উন্নয়নের লেশমাত্র ছিল না। লাগাতার জনমত তৈরি করে এলাকার নিয়ন্ত্রণ নিই।
কী ছিল, আর কী হয়েছে, তা বর্ণনা করতে গিয়ে জানান, উন্নয়নের মূল কাজটাই হয়েছে গত এক দশকে। কীভাবে ধাপে ধাপে সংগঠন তৈরি করে বামেদের হঠালেন, তার বিস্তারিত ব্যাখ্যা দিয়ে সমীরবাবু ‘হিন্দুস্থান সমাচার’-কে জানালেন, “তা সত্বেও নির্বাচনে ভাল ফলের চেষ্টায় বিন্দুমাত্র ফাঁক থাকছে না। এই তো সাতসকালে বেড়িয়ে সীতারামপুরে একপ্রস্থ জনসংযোগ সেরে এসেছি। অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় আসবেন। বাড়িতে দুপুরের স্নানখাওয়ার পর প্রস্তুতি দেখভালে বেড়িয়ে পড়তে হচ্ছে। বিশ্রামের জো নেই।” এক দিকে জীবন-জীবিকার রসদের সংস্থান, আবার একই সঙ্গে বিপর্যয়ের ইঙ্গিত— পাথরপ্রতিমার মানুষের কাছে এ দুয়ের সমন্বয়সাধন একটা গুরুদায়িত্ব। বিপর্যয় ঘটেও বার বার। বুলবুল, আমপানের জোড়া ধাক্কা এখনও পুরোপুরি সামলে উঠতে পারেননি পাথরপ্রতিমার মানুষ। সুরক্ষার জন্য তাঁরা চান পাকা বাঁধ। কিন্তু বছরের পর বছর কাটে, এক ভোট মিটে এসে পড়ে অন্য ভোট। নানা প্রতিশ্রুতির বান ডাকে। কিন্তু কাজের কাজ যে কী হয়, তার হিসেব আর চোখে দেখতে পান না দ্বীপভূমির মানুষ। অনেক সময়ে বিপদ ঘাড়ে নিয়েই ফেরিতে ওঠানামা করেন যাত্রীরা।
পাথরপ্রতিমা বিধানসভা কেন্দ্রে নদী-সমুদ্র ঘেরা ১৫টি দ্বীপ রয়েছে। আমপানে জলোচ্ছাসে প্রায় ৩৫ কিলোমিটার নদী ও সমুদ্র বাঁধ তছনছ হয়েছে। সব ভাঙন এখনও সারিয়ে তোলা যায়নি। আমপানের পরে তালিতাপ্পি দিয়ে কোনও মতে নোনা জল আটকানো গেলেও কংক্রিটের বাঁধ তৈরি না হওয়ায় পূর্ণিমা বা অমাবস্যার কটাল হলেই বাসিন্দাদের দুশ্চিন্তায় পড়েন। পাকা বাঁধ কেন এখনও সর্বত্র হল না, তা নিয়ে প্রশ্নের মুখে পড়তে হয় শাসক দলের নেতাদের। আমপানে ক্ষতিপূরণ দুর্নীতি নিয়েও অভিযোগ ভুরি ভুরি। ২০০৯ সালে আয়লায় সব থেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল পাথরপ্রতিমা। সে সময়ে বাঁধ মেরামতির জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের বরাদ্দ টাকায় কাজ করতে না পেরে প্রায় সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকা ফেরত চলে যায়। সে সব নিয়েও শাসক দলকে গঞ্জনা শুনতে হয়।
সমীরবাবু অবশ্য কোনও গাফিলতির অভিযোগ মানে রাজি নন। বললেন, “এলাকার মানুষ জানেন আমরা কী কী করেছি।” কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতি হল নদীনালা ঘেরা দ্বীপে রয়েছে ৬০-৬৫টি জেটিঘাট। দীর্ঘ দিন সংস্কার হয়নি। আমপানের জেরে বেশ কিছু ঘাট ভেঙেও পড়েছে। কিছু ঘাটের সামনে চর পড়ে যাওয়ায় নদীতে ভাটা পড়লে হাঁটুসমান কাদা মাড়িয়ে নামাওঠা করতে হয়। অধিকাংশ ঘাটে পানীয় জল, শৌচালয় বা যাত্রী ছাউনির ব্যবস্থা নেই। যাত্রীদের খোলা আকাশের নীচে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। অচিন্ত্যনগর, ব্রজবল্লভপুর, জি প্লট-সহ বিভিন্ন পঞ্চায়েতে বহু গ্রামীণ রাস্তাঘাট মাটির থেকে গিয়েছে। বর্ষার সময়ে কাদা মাড়িয়ে যাতায়াত করতে হয়। আনাজ, পান ও মাছ উৎপাদন হয় এখানে। কিসান মান্ডি তৈরি হলেও হিমঘর না থাকায় চাষিরা সমস্যায় পড়েন। ২০১১-তে তৃণমূল প্রার্থী সমীর জানা প্রদত্ত ভোটের ৫২.৩৯ শতাংশ পেয়ে বিজয়ী হন। জানালেন, সেবার কংগ্রেস-তৃণমূল সমঝোতা হয়েছিল। সিপিএম ছিল দ্বিতীয় স্থানে ৪৪.২৮ শতাংশ পেয়ে। আর মাত্র ১.৯৫ শতাংশ পায় বিজেপি। ২০১৬-তে কংগ্রেস-সিপিএম সমঝোতা সত্বেও তৃণমূল প্রার্থী হিসাবে আমি পাই ১ লক্ষ ৭ হাজার ৫৯৫ ভোট। ৯৩ হাজার ৮০২ ভোট পায় কংগ্রেস আর বিজেপি পায় ৬ হাজার ৯৪২ ভোট। শতাংশের হিসাবে যথাক্রমে ৫১.২, ৪৪.৬ এবং ৩.৩। গত লোকসভা ভোটে পাথরপ্রতিমা বিধানসভা কেন্দ্রে তৃণমূল প্রার্থী চন্দ্রমোহন জাটুয়া বিজেপি-র প্রার্থীর চেয়ে প্রায় ৩৫ হাজার ভোটে এগিয়ে ছিলেন। এটাই আমাদের যথেষ্ঠ স্বস্তির কারণ। দ্বিতীয় নিশ্চিন্তি বিজেপি অথবা বাম-কংগ্রেসের কোনও সংগঠন নেই এখানে। কাজের নিরিখে মানুষ তৃণমূলকেই ভোট দেবে।
৩৮ বছর ছিলেন শিক্ষকতায় সমীরবাবু। এবারের ভোটে তাঁর দুই প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বীও জেতার ব্যাপারে আশাবাদী। ওঁদের একজন বিজেপি প্রার্থী অসিত হালদার। তাঁর সাকিন দক্ষিণ গঙ্গাধরপুরে। তিনিও শিক্ষক। তৃতীয়জন, মানে কংগ্রেস প্রার্থী শুকদেব বেরাও শিক্ষক। শেষ হাসি কোন শিক্ষকের মুখে ফোটে, তা জানতে অপেক্ষা । দক্ষিণ ২৪ পরগণার পাথরপ্রতিমা কেন্দ্রে ভোট রাজ্যে দ্বিতীয় দফার নির্বাচনে, ১ এপ্রিল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *