কাছাড়ের বুরুঙ্গা গ্রামে প্রাক্তন সেনাকর্মীর বাড়িতে দুর্ধর্ষ ডাকাতি, গুলিবিদ্ধ ১৬ জন

কাটিগড়া (অসম), ১০ ফেব্রুয়ারি (হি.স.) : গভীর রাতে কুড়িজনের বেশি সশস্ত্র ডাকাত দলের এলোপাতাড়ি গুলিবর্ষণে জনৈক প্রাক্তন সেনাকর্মী তথা বিশিষ্ট ব্যবসায়ী সহ ১৬ জন ঘায়েল হয়েছেন। বাড়ির গ্রিল ভেঙে ঘরের ভেতরে প্রবেশ করে ধারালো অস্ত্র ও বন্ধুক উঁচিয়ে স্বামী-স্ত্রীকে শাসানি দিয়ে নগদ অর্থ সহ স্বর্ণালঙ্কর হাতিয়ে নিয়ে যায় ডাকাতের দল। তাণ্ডবলীলা শেষে যাওয়ার আগে গৃহকর্তাকে গুলি করে গুরুতর জখম করে পালিয়ে যায় ডাকাতের দলটি।

কাছাড়ের কাটিগড়া থানার অধীন বিহাড়া পুলিশ ফাঁড়ির বুরুঙ্গা গ্রামের প্রাক্তন সেনাকর্মী অজিউদ্দিন আহমদের বাড়িতে দুর্ধর্ষ লোমহর্ষক ডাকাতির ঘটনা সংগঠিত  হয়েছে মঙ্গলবার গভীর রাত প্রায় দেড়টা নাগাদ। সংগটিত এই দুর্ধর্ষ ডাকাতির ঘটনায় গোটা এলাকাজুড়ে তীব্র চাঞ্চল্য বিরাজ করছে। এই ডাকাতির ঘটনায় গুলিবিদ্ধ হয়ে গুরুতর জখম হয়েছেন গৃহকর্তা অজি উদ্দিন আহমদ (৫৫) এবং শংকু নাথ (৪৫) । তাঁরা দুজনেই বর্তমানে শিলচর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। এছাড়া আরও ১৪ জন জখম ব্যক্তি কালাইন এফআরইউ হাসপাতাল সহ অন্যান্য হাসপাতালে চিকিৎসাধীন বলে জানা গেছে। 

ঘটনার বিবরণে জানা গেছে, মঙ্গলবার রাত প্রায় ১.৩০টা নাগাদ ২০/২২ জনের ডাকাত দল বুরুঙ্গার প্রাক্তন সেনাকর্মী অজি উদ্দিন আহমদের বাড়ির সামনে গেট এবং ঘরের বারান্দায় গ্রিল ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করে। গৃহকর্তা অজি উদ্দিনের নাম ধরে ডাকতে থাকে মুখে কালো কাপড় বাঁধা অস্ত্রধারীরা। ভয়াতুর স্ত্রী সাহানা আহমদ তাঁর স্বামী বাড়িতে নেই বলেন। কিন্তু নাছোড়বান্দা উন্মত্ত ডাকাতরা সাহানাকে মিথ্যা কথা বলার জন্য শাসানি দেয়। তারা বলে রাত নয়টার সঙ্গে সঙ্গে অজি উদ্দিন ঘরে প্রবেশ করছেন, তা তাদের জানা। তাই মিথ্যা বলে গৃহকর্তাকে লুকিয়ে রাখা যাবে না বলে তীব্র শাসানি দিতে থাকে ডাকাতরা। একটু পরে পাশের কক্ষে গিয়ে অজি উদ্দিনকে পেয়ে গেলে ডাকাতরা অজির স্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে অশ্লীল  ভাষা প্রয়োগ করতে শুরু করে। এমন-কি স্ত্রী সাহানার দিকে শাবল তাক করে মারমুখি হয়ে উঠে তারা। 

ইত্যবসরে ডাকাতের দল ঘরের আসবাবপত্র লণ্ডভণ্ড  করে ব্যাপক তাণ্ডব চালায়। স্টিল আলমিরার তালা ভেঙে নগদ অর্থ, সোনা ও হীরার অলংকার অবাধে লুটপাট করে। অজি উদ্দিনের ইট ভাট্টার শ্রমিকদের মজুরির টাকা দেওয়ার জন্য ঘরে মজুত ছিল আড়াই লক্ষ টাকা। এছাড়া স্ত্রী সাহানার ব্যক্তিগত আরও এক লক্ষ ৭০ হাজার টাকা মিলে মোট ৪ লক্ষ ২০ হাজার টাকা হাতিয়ে নেয় ডাকাতরা। এছাড়া হীরার চেন ও প্রায় ১৫ ভরি ওজনের স্বর্ণালঙ্কার নিয়ে গেছে ডাকাতের দল, জানান পারিবারের সদস্যরা। 

এদিন স্বামী ও স্ত্রী আগরতলার এক আত্মীয় সহ তিনজন ছিলেন বাড়িতে। তাঁদের ভয়ভীতি ও আতঙ্কগ্রস্ত  করে তুলতে বাড়ির অ্যালসেশিয়ান কুকুরকে দা দিয়ে উপর্যুপরি কুপাঘাত করতে থাকে আগন্তুকরা। এছাড়া ডাকাতরা ঘরে ঢুকে প্রথমে তিন-তিনটি দামি মোবাইল ফোনের হ্যান্ডসেট ছিনিয়ে নিয়ে গেলে গ্রামের মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেননি অজি উদ্দিন আহমদ। প্রায় ঘণ্টাখানেক তাণ্ডব চালানোর পর ডাকাতরা বেরিয়ে যাওয়ার আগে গৃহকর্তা অজি উদ্দিনকে লক্ষ্য করে এলোপাথাড়ি গুলি ছুঁড়তে থাকে। এতে অজি উদ্দিনের ডান পায়ে মোট পাঁচটি এবং নাভির নীচে তলপেটে একটি গুলি লাগে। সঙ্গে সঙ্গে অজি উদ্দিন আহমদ গুলিবিদ্ধ হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। ধারালো দায়ের কোপে কুকুরের শরীর এবং গুলিবিদ্ধ জখম অজি উদ্দিন আহমদের শরীর থেকে রক্তের স্রোত বইতে থাকে। 

গুলির শব্দ শুনে আশপাশের লোকজন জমায়েত হয়ে যান। মুহূর্তের মধ্যেই গভীর রাতে জনরোষের সম্মুখীন হতে হয়েছে ডাকাতদের। তবে গ্রামবাসীদের ছত্রভঙ্গ  করতে এলোপাতাড়ি গুলি ছুঁড়তে থাকে ডাকাতরা। এভাবে গোলাগুলি করে গ্রামের লোকজনদের দিশাহারা করে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয় দুষ্কৃতীরা। তাদের গুলিতে কম করে আরও ১৩ জন লোক জখম হয়েছেন। ঘটনার দিন অজি উদ্দিনের মেয়ে গুয়াহাটিতে মামার বাড়িতে ছিল। তাই ডাকাতদের আক্রমণ থেকে রক্ষা পেয়েছে মেয়েটি।

উল্লেখ্য, বদরপুরের প্রাক্তন বিধায়ক তথা গৌহাটি হাইকোর্টের আইনজীবী আনোয়ারউল হকের জামাতা হলেন আজি উদ্দিন আহমদ। এদিকে লোমহর্ষক এই ডাকাতির খবর পেয়ে রাতেই দলবল নিয়ে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জগদীশ দাস। বুধবার সকালে ভয়ঙ্কর এই ডাকাতির ঘটনার প্রতিবাদে শিলচর-কালাইন রোড অবরোধ করেন ক্ষুব্ধ জনতা।  তাঁদের দাবি, শীঘ্রই ডাকাতদের গ্রেফতার করতে হবে। এবং এই অঞ্চলে সংঘটিত ঘনঘন সড়ক ডাকাতি ও অপরাধজনক ঘটনা রোধে বুরুঙ্গায় পুলিশ চৌকি বসাতে হবে। 

বুধবার প্রতিবাদী জনগণকে সান্ত্বনা দিতে কাছাড়ের পুলিশ সুপার বানোয়ারিলাল মিনা পুলিশ বাহিনী নিয়ে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে বিভিন্ন দিক পর্যবেক্ষণ করে অজি উদ্দিনের স্ত্রী ও আশপাশের লোকজনদের সাথে কথা বলেন। পুলিশ সুপার বানোয়ারিলাল মিনার সঙ্গে ছিলেন কাটিগড়া থানার ওসি ইন্সপেক্টর রঞ্জন দলে, বিহাড়া ফাঁড়ির ইনচার্জ রামদুলাল গোয়ালা সহ স্থানীয় পুলিশ কর্মীরা। পুলিশ সুপার বানোয়ারিলাল মিনা উত্তেজিত জনগণকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেন, খুব শীঘ্রই অপরাধীদের গ্রেফতার করা হবে এবং বুরুঙ্গা এলাকায় একটি পুলিশ চৌকি বসানোর ব্যবস্থা করা হবে। পুলিশ সুপার আরও জানান, ভয়ঙ্কর এই ডাকাতির সঙ্গে জড়িত সন্দেহে ইতিমধ্যে দুজনকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ চালিয়ে যাচ্ছে পুলিশ। আসল ডাকাতরা শীঘ্রই পুলিশের জালে পড়বে বলে আশাবাদী বানোয়ারিলাল মিনা। পুলিশ সুপারের আশ্বাসে ক্ষুব্ধ  জনতা দুপুর একটা নাগাদ সড়ক অবরোধ প্রত্যাহার করেন। 

এদিকে, বুরুঙ্গায় সংগঠিত লোমহর্ষক এই ডাকাতির খবর পেয়ে উদ্বেগ ব্যক্ত করেছেন কংগ্রেস নেতা সন্দীপ দাস, কালাইন জিপি সভাপতি মৃদুলকান্তি চক্রবর্তী, বুরুঙ্গা জিপি সভাপতি নজমুল হুসেন, আব্দুস সালাম, কবীর আহমদ সহ অন্যরা। তাঁরা অজি উদ্দিন আহমদের বাড়িতে তাঁর স্ত্রী ও পরিবারের লোকজনদের সান্ত্বনা দিয়ে পুলিশ প্রশাসনের উপর আস্থা রাখতে পরামর্শ দেন। এলাকার উত্তেজিত জনতা ক্ষোভ ব্যক্ত করে সংবাদ মাধ্যমকে জানান, শিলচর-কালাইন সড়কে কিছুদিন পর-পর ডাকাতি, চুরি, ছিনতাই ও লুটপাটের ঘটনা সংঘটিত হয়ে থাকে। তাঁরা আরও বলেন, হঠাৎ কিছুদিন পর-পর বুরুঙ্গা রেলগেটের পার্শ্ববর্তী স্থানে রাস্তায় বিহাড়া পুলিশ গাড়ি থামিয়ে অর্থ সংগ্রহ করতে দেখা যায়। কিন্তু তার পরও এই এলাকায় ঘনঘন ডাকাতির ঘটনা সংঘটিত হয় কীভাবে, এমন প্রশ্নও তুলেছেন ক্ষুব্ধ জনতা। এছাড়া গত তিন মাসের মধ্যে কাটিগড়া চেরাগি বাজার সংলগ্ন এলাকায় পর-পর দুটি বড় ধরনের ডাকাতির ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। সেই সব ঘটনারও এ পর্যন্ত কোনও কিনারা করতে পারেনি কাটিগড়া পুলিশ।