আগরতলা, ২৪ সেপ্টেম্বর : “প্রজাপতি, প্রজাপতি, কোথায় পেলে ভাই এমন রঙিন পাখা”- প্রকৃতির আপন খেয়ালে আঁকা এই শিল্পে সন্মোহিত হয়ে গোটাকয় চোখের পলক ভুলে আর ফেলা হয়নি, এই অভিজ্ঞতা আট থেকে আশি সবারই রয়েছে হয়তো। বাড়ির শখের বাগিচা থেকে ধানক্ষেত হয়ে নদীতীরের কাশফুল ছুঁয়ে বনের গভীরে কালচে সবুজ ঘেরা শেওলা পিচ্ছিল হ্যাংলা ঝর্ণার ঝিরঝিরি- রঙীন পাখার অধিকারীদের উন্মুক্ত আনাগোনা রয়েছে সর্বত্র। পরাগসংযোগে অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য ভূমিকার পাশাপাশি পরিবেশের জৈব-সূচক হিসেবে স্বীকৃতি রয়েছে এদের। অর্থাৎ পরিবেশের বিভিন্ন খুঁটিনাটি উপাদানের সাধারণ তারতম্যও বড়সড় সমস্যা সৃষ্টি করে প্রজাপতিদের জীবনচক্রের বিভিন্ন পর্যায়ে। যার ফলে তারতম্য ঘটতে পারে নির্দিষ্ট কোনো বাস্তুতন্ত্রে প্রজাপতিদের সামগ্রিক সংখ্যার। যা পর্যবেক্ষণ করে গবেষকরা সহজেই আঁচ পেয়ে যান পরিবেশ দূষণের মতো গুরুত্ত্বপূর্ন ঘটনার। তা সত্বেও সংরক্ষণের দৃষ্টিকোণ থেকে বরাবরই এরা তুলনামূলকভাবে উপেক্ষিত। হয়তো তাই অতীতে পর্যায়ক্রমে আমাদের জাতীয় পশু, পাখী, ফুল বা ফল গৃহীত হলেও দেশের প্রায় ১৪০০ এরও বেশি প্রজাতির সম্ভার থেকে বেছে নেওয়া হয়নি ভারতের জাতীয় প্রজাপতি।
তাই এই গুরুত্ত্বপূর্ন কার্যে একজোট হয়ে এগিয়ে এসেছে সারা ভারতবর্ষের বিশেষজ্ঞ প্রজাপতিবিদ, গবেষক এবং প্রকৃতিপ্রেমীরা। গঠিত হয় “জাতীয় প্রজাপতি প্রচারনা সংস্থা” । প্রাথমিকভাবে বিভিন্ন সুনির্দিষ্ট কিছু নির্ণায়ক মেনে সারা দেশের ১৪০০ এরও বেশি প্রজাতি থেকে ৫০ টি এবং অবশেষে ৭টি প্রজাপতি নির্বাচিত করা হয় সংস্থা কতৃক আয়োজিত বিভিন্ন পর্যায়ক্রমিক সভায়। পরবর্তী ধাপে এই ৭টি প্রজাপতি থেকে সারা দেশের জনগণের কাছ থেকে অনলাইন ভোট সংগ্রহ করে জনগণের ভোটে নির্বাচিত প্রজাপতির প্রজাতির নাম কেন্দ্রীয় পরিবেশ মন্ত্রকে পাঠানো হবে অনুমোদনের জন্য। উল্লেখ্য, ভারতের জাতীয় প্রতীক গ্রহণের ক্ষেত্রে দেশব্যাপী ভোট সংগ্রহ করার এই গণতান্ত্রিক আয়োজন আমাদের দেশের ইতিহাসে এই প্রথম।
সারা দেশের ন্যায় ত্রিপুরা রাজ্যেও ইতিমধ্যেই শুরু হয়েছে এই অভূতপূর্ব নির্বাচনী প্রচার । “জাতীয় প্রজাপতি প্রচারনা সংস্থা” (ন্যাশনাল বাটারফ্লাই ক্যাম্পেন কনসর্টিয়াম) এর ত্রিপুরার একমাত্র সদস্য শ্রী সুমন ভৌমিক জানান, ২৩ সে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ইতিমধ্যে দেশব্যাপী ৩৫ হাজারেরও বেশি ভোট পড়লেও ত্রিপুরায় সার্বিক ভাবে এখনো সেরকম প্রচার না হওয়ায় আশানুরূপ ভোট পড়েনি রাজ্য থেকে। তবে তিনি জানান ইতিমধ্যেই রাজ্যের বন্যপ্রাণ সংরক্ষণ এবং অনুসন্ধান ক্ষেত্রে অগ্রগামী সংস্থা ওয়াইল্ড ত্রিপুরা ফাউন্ডেশন এর উদ্যোগে রাজ্যের সকল স্তরের পরিবেশ প্রেমীদের কাছে এই ভোটবার্তা পৌঁছে দেবার প্রয়াস চলছে। পাশাপাশি এই প্রচেষ্টায় রাজ্যের সকল প্রকার সংবাদ মাধ্যমের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের অনুরোধ রেখেছেন ওয়াইল্ড ত্রিপুরা ফাউন্ডেশন এর প্রজাপতি ও মথ সংরক্ষণ এবং গবেষণা বিভাগের প্রধান শ্রী ভৌমিক।
কিভাবে অংশ নেবেন জাতীয় স্তরের এই প্রচেষ্টায় ?
ওয়াইল্ড ত্রিপুরা ফাউন্ডেশনের ওয়েবসাইটে অথবা এই লিংক এ আপনার ভোট প্রদান করুন এবং ছোট বড়, বিশেষত স্কুলপড়ুয়া, প্রকৃতিপ্রেমী এবং পরিচিত সবাইকে ভোট দানে উদ্বুদ্ধ করুন।
tinyurl.com/NBUTC
ভোট দেওয়ার শেষ তারিখ ৮/১০/২০২০
কিভাবে জাতীয় স্তরে চূড়ান্তভাবে সাতটি প্রজাপতি নির্বাচিত করা হয় ?
সারা ভারতবর্ষের বিশেষজ্ঞ প্রজাপতিবিদ, গবেষক এবং প্রকৃতিপ্রেমীরা জাতীয় প্রজাপতি প্রচারনা সংস্থা-র মঞ্চে একত্রিত হয়ে জাতীয় প্রজাপতি বাছাই করার জন্য নিম্নলিখিত মানদণ্ডগুলি গঠন করে এর ভিত্তিতে চূড়ান্ত ৭ টি প্রজাপতি জাতীয় স্তরে নির্বাচনের জন্য মনোনীত করা হয়।
নির্বাচিত প্রজাপতির –
১. সাংস্কৃতিক, পরিবেশগত এবং সংরক্ষণের দৃষ্টিকোণ থেকে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক স্তরে
তাৎপর্য্যপূর্ন হওয়া বাঞ্ছণীয়।
২. দর্শনীয় হওয়া প্রয়োজন।
৩. কোনো অন্তর্নিহিত আকর্ষণীয় জৈবিক দিক থাকা প্রয়োজন।
৪. যাতে সহজেই শনাক্ত এবং প্রত্যক্ষ করা যায় ও সহজেই মনে রাখা যায়।
৫. বহুরূপতা বা একাধিক ধরণ বা ফর্ম না থাকা বাঞ্ছণীয়।
অনেক প্রজাপতির রূপ ঋতু অনুযায়ী পরিবর্তিত হয় যা বিভ্রম সৃষ্টি করতে পারে।
৬. শুঁয়োপোকা যেন মানুষের পক্ষে অনিষ্টকর না হয়।
৭. খুব সচরাচর দেখা যায় এরূপ হওয়া উচিত নয়।
৮. কোন রাজ্যের সরকার ‘রাজ্য প্রজাপতি’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে (যেমন মহারাষ্ট্র, কর্নাটক), এরূপ প্রজাপতিকে জাতীয় প্রজাপতি নির্বাচিত করা যাবে না।
চূড়ান্ত নির্বাচিত সাতটি প্রজাপতি :
১. ফাইভ-বার সোর্ডটেল (Graphium antiphates): তরবারি আকৃতির লেজ আর অতুলনীয় বর্ণবৈচিত্র্য প্রজাপতিটিকে করেছে রাজকীয় এবং স্বতন্ত্র। পূর্ব হিমালয়, ত্রিপুরা সহ উত্তর-পূর্ব ভারতের রাজ্যগুলি এবং পশ্চিমঘাট পর্তমালার চিরহরিৎ অরণ্য নিয়ে দেশের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ জীববৈচিত্র্য হটস্পটেই রয়েছে এর আনাগোনা। ফলে সংবেদনশীল এবং অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই অঞ্চলগুলির সংরক্ষণের সাথে স্বাভাবিকভাবেই সংযুক্ত থাকছে এই প্রজাতিটির অস্তিত্ব।
২. কমন জেজেবেল (Delias eucharis): হলুদ-লালের সমন্বয়ে এই প্রজাপতির উজ্জ্বলদর্শন এই প্রজাপতির দেখা মেলে দেশজুড়ে মূলত বাগানে বা তুলনামূলক কম ঘন জঙ্গলে। ত্রিপুরার প্রায় সর্বত্র এর অবাধ আনাগোনা।
৩. কমন নবাব (Charaxes bharata): ভারতের আর্দ্র অরণ্যাঞ্চলের বাসিন্দা এই প্রজাপতি। এর সুঠাম গঠন, শক্তিশালী ক্ষিপ্রগতি, পাখার বর্ণ এবং নকশা-বিন্যাস রাজকীয় শৌর্য্যের আভাস দেয়। ত্রিপুরার বনাঞ্চলের অপেক্ষাকৃত আদ্র অঞ্চল গুলিতে এর দেখা মেলে প্রায়শই।
৪. কৃষ্ণা পিকক (Papilio krishna): তালিকায় অন্যতম প্রতিযোগী কৃষ্ণা পিকককে অনায়াসে swallowtail প্রজাপতিদের মধ্যে সবচেয়ে আকর্ষণীয় বলা যেতে পারে । এর পাখার সৌন্দর্য্যের ছটা শ্রীকৃষ্ণের ময়ূর পাখির পালকের অপরূপ নকশা এবং বর্ণবিন্যাসের স্মৃতি জাগায়। সৌন্দর্য্যের পাশাপাশি হিমালয় পর্বতমালা এবং সংলগ্ন ভারতবর্ষের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জীববৈচিত্র্য হটস্পটের বাসিন্দা কৃষ্ণা পিকক সংরক্ষণের পরিভাষায় ‘ফ্ল্যাগশিপ স্পিসিস’। তাই এর সংরক্ষণের সঙ্গে এই গুরুত্বপূর্ণ জীববৈচিত্র্য হটস্পটের সামগ্রিক সংরক্ষণ প্রসঙ্গ ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ত্রিপুরায় এখন পর্যন্ত এর দেখা না মিললেও ভৌগোলিক বৈচিত্র্যমন্ডিত এই রাজ্যে এর উপস্থিতি দৃঢ়ভাবে অস্বীকার করাও যুক্তিযুক্ত নয়।
৫. অরেঞ্জ ওকলিফ (Kallima inachus): উত্তর এবং উত্তরপূর্ব সহ ভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চলের পাশাপাশি ত্রিপুরার মূলত অপেক্ষাকৃত আদ্র বনাঞ্চলে এর দেখা মেলে। পাখার নিচের অংশের আকার এবং বর্ণবিন্যাসের সঙ্গে সুনিপুন সাদৃশ্য শুকনো পাতার। শিকারির চোখে ধুলো দেওয়ার প্রকৃতিপ্রদত্ত এক আশ্চর্য্য কারসাজি । এহেন সাদামাটা প্রজাপতির রূপের ডালির আকস্মিক প্রকাশ ঘটে উন্মুক্ত পাখার উপর পিঠের ঝলমলে বর্ণচ্ছটায়। কমলা আর নীলের এই অপরূপ সহাবস্থান প্রকৃতই অবিস্মরণীয় ।
৬. নর্দার্ন জাঙ্গলকুইন (Stichophthalma camadeva): পাখার উপরের আকাশী নীলচে আভা আর নিচের অংশের নজরকাড়া লালচে বিন্দুর সমাহার উত্তর পূর্ব ভারতের এই বৃহদাকার প্রজাপতিকে করে তুলেছে ভারতবর্ষের অন্যতম আকর্ষণীয় প্রজাপতি। এর অনবদ্য রূপের সম্ভার সমাদৃত হয়েছে অরুণাচলের মিসমি জনজাতিদের ঐতিহ্যবাহী হস্ততাঁত শিল্পের নকশায়।
৭. ইয়েলো গরগন (Meandrusa payeni ) : উজ্জ্বল হলদে পাখার স্বতন্ত্র গড়নের এই রাজকীয় প্রজাপতি মূলত পূর্ব হিমালয় এবং উত্তর পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলির বাসিন্দা। শক্তিশালী বৃহদাকার পাখায় ভর করে নিজ বাস্তুতন্ত্র্যে পাহাড়- ঝর্ণার উপর এর উড়ান প্রত্যক্ষ করা প্রকৃতিপ্রেমীদের জন্য এক অনবদ্য অভিজ্ঞতা।