একটি যুগের নাম হল অমিতাভ বচ্চন। অমিতাভ বচ্চন এখন কালজয়ী হয়ে উঠেছেন। অভিনয়ের মাধ্যমেই শীর্ষস্থান অর্জন করেছেন তিনি। বিগত অর্ধ শতাব্দী ধরে দেশের শীর্ষে থাকা, অভিনেতা অমিতাভ বচ্চন কোভিড-১৯ আক্রান্ত হওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়তেই সমগ্র দেশে তাঁর ভক্ত ও শুভাকাঙ্ক্ষীরা আরোগ্য কামনা শুরু করে দিয়েছেন। ঠিক সেই সময়ের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে, যখন কুলী সিনেমার শুটিংয়ের সময় তিনি গুরুতর আহত হয়েছিলেন। সমগ্র দেশ এখন অমিতাভ ও তাঁর পরিবারের জন্য প্রার্থনা করছে। তাঁরা শীঘ্রই সুস্থ হয়ে উঠবেন। ভারতের বাইরে আমেরিকা, ব্রিটেন, মিশর, জর্ডান, সৌদি আরব, মালয়েশিয়া, আফ্রিকা প্রভৃতি দেশের মানুষ তাঁকে পছন্দ করে। ভারতীয় বংশোদ্ভূতরা যে সমস্ত দেশে বসবাস করেন সেখানেই তাঁকে পছন্দ করা হয়। তাঁরা হিন্দি সিনেমার প্রকৃত ভক্ত।
ব্যক্তিত্ব সর্বভারতীয়
অমিতাভ বচ্চনের ব্যক্তিত্ব সর্বভারতীয়। খুব কাছ থেকে অনেক সংস্কৃতি সম্পর্কে জানার সুযোগ পেয়েছেন তিনি। তাঁর বাবা ডা. হরিবংশরাই বচ্চন উত্তর প্রদেশের প্রয়াগের একটি অভিজাত কায়স্থ পরিবারের জন্মেছিলেন। মা তেজী বচ্চন পঞ্জাবি ছিলেন, স্ত্রী জয়া বচ্চন বাঙালি। তাঁর মেয়ের বিয়ে হয়েছে পঞ্জাবি পরিবারে। এর ফলে তাঁর ব্যক্তিত্ব সমৃদ্ধ হয়েছে। তিনি হিন্দি ভাষায় কথা বলা পছন্দ করেন, ইংরেজিতে কথা বলেন ঠিকই তবে চেষ্টা করেন হিন্দিতেই বেশি কথা বলার। নিশ্চয়ই তাঁকে বর্তমানে দেশের বৃহত্তম হিন্দি সেবী বিবেচনা করা যেতে পারে। কিন্তু, দুর্ভাগ্যের বিষয় হল, কয়েকবছর আগে ভোপালে আয়োজিত বিশ্ব হিন্দু সম্মেলনে যখন তাঁকে আমন্ত্রণ করা হয়েছিল, তখন কিছু তথাকথিত হিন্দু মঠাধ্যক্ষদের পেতে ব্যথা শুরু হয়ে গিয়েছিল। তাঁরা বলেছিল, ‘অমিতাভ বচ্চন ভাল হিন্দি বলা শেখাবেন?’ হিন্দি ভাষার কী এত খারাপ সময় শুরু হয়ে গিয়েছে? কিছু আত্মমুগ্ধ লেখক এটাও বলেছিল যে, হিন্দিকে এতটাই নিম্ন মনে করা হচ্ছে যে অমিতাভ বচ্চনের মতো তারকা, বিনা অর্থে যিনি শুধুই কথা বলেন, তিনিও হিন্দির জ্ঞান দেবেন! অমিতাভ বচ্চন সম্পর্কে যাঁরা মন্তব্য করেছেন, তাঁদের লেখা বইয়ের ১০০ কপিও বিক্রি হয় না।
আমাকেও বিদেশে, বিশেষ করে যে সমস্ত দেশে বিগত ২০০ বছর ধরে ভারতীয় বংশোদ্ভূতরা বসবাস করছেন, সেখানে হিন্দি বিষয়ে বলার জন্য আহ্বান জানানো হয়েছিল। গোয়ার রাজ্যপাল মৃদুলা সিনহা সভাপতিত্ব করছিলেন। আমি নিজের গবেষণামূলক বক্তৃতায়, বিদেশে হিন্দি জনপ্রিয়তার ক্ষেত্রে হিন্দি ছবি বিশেষ করে রাজ কাপুর এবং অমিতাভ বচ্চনের কতটা অবদান সে সম্পর্কে বলেছিলাম। আমার বক্তৃতার পর অনেকেই আমাকে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন। তবে এটাও বলেছিলাম, হিন্দি ছবির এতটা প্রসংশা করা উচিত নয়।
ভাষা সম্পর্কে অত্যন্ত সতর্ক
অমিতাভকে আপনি যেখানেই শুনুন, বুঝতে পারবেন নিজ ভাষা সম্পর্কে তিনি কতটা সজাগ ও সতর্ক। তিনি কখনই হালকা অথবা গৌণ ভাষায় কথা বলেন না। যদিও তাঁর সমসাময়িক এবং বর্তমান তারকাদের মধ্যে অনেকেই হিন্দিতে ঠিকমতো দু’টো কথা বলতে পারেন না। মাঝেমধ্যেই হিন্দিতে কথা বলে ফেলেন তাঁরা। হিন্দিতে কথা বললে অমিতাভ শুধুমাত্র হিন্দিতেই কথা বলেন, অন্য ভাষায় কথা বলা এড়িয়ে চলেন। এটাই তো হওয়া দরকার। ছোট পর্দার সবচেয়ে বড় জনপ্রিয় অনুষ্ঠান ‘কউন বানেগা ক্রোরপতি’-তেও হিন্দিতেই কথা বলেন তিনি। প্রতিটি শব্দ নিপুণভাবে উচ্চারণ করেন তিনি। ভাষায় এমন দখল আনার জন্য নিরন্তর অভ্যাস করতে হয়। এখন তাঁর আশেপাশে আশুতোষ রাণাও আসেন। আশুতোষ খুব ভালো হিন্দিতে কথা বলেন। এটা সঠিক যে সাহিত্যিক পটভূমির পরিবারের সঙ্গে অমিতাভের সম্পর্ক। এটাই সত্য যে তিনি নিজের ভাষা স্তর সংস্কৃত রেখেছিলেন। হিন্দি চলচ্চিত্রের মাধ্যমে হিন্দিকে অ-হিন্দিভাষী অঞ্চলেও নিয়ে যেতে সফল হয়েছেন তিনি। সত্যিকারের এমন একজন হিন্দি সেবক যিনি অদ্ভুত স্তম্ভ, যাঁর সুস্থতার কামনা করছে সমগ্র দেশ। অমিতাভ বচ্চন শেরউডের মতো ইংরেজি স্কুল থেকে শিক্ষালাভ করেছিলেন এবং দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্ভুক্ত কিরোড়িমাল কলেজ থেকে বিজ্ঞানে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেছিলেন তিনি। তবে হিন্দি নিয়ে তিনি কখনওই আপস করেননি। হিন্দির সঙ্গে অমিতাভের নিবিড় সম্পর্ক ছিল সর্বদাই।
উত্থান-পতনের সাক্ষী থেকেছেন
অমিতাভ বচ্চনের সিনেমা প্রতিটি পুরস্কার ও সম্মান পেয়েছে। অমিতাভ বচ্চনের ভক্তরা দীর্ঘদিন ধরেই বলে আসছিলেন, অমিতাভকে ভারতীয় চলচ্চিত্রের সর্বোচ্চ সম্মান দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার দিতে অনেক বিলম্ব হয়েছে। অমিতাভ সেই সময় সর্বোচ্চ সম্মান পেয়েছিলেন, যখন চলচ্চিত্র জগতে অর্ধশতক পূর্ণ করেছেন। অমিতাভ আজ যে শীর্ষস্থানে পৌঁছেছেন, সেই স্থানে পৌঁছতে গিয়ে অনেক উত্থান-পতনের সাক্ষী থেকেছেন তিনি। শুরুতে তাঁর ছবিগুলি সফল হয়নি। ১৯৭৩ সালে ‘জঞ্জির’ ছবির সফলতা তাঁর জীবন বদলে দিয়েছিল। এরপর তিনি ‘দিবার’, ‘শোলে’, ‘অভিমান’, ‘কাভি কাভি’, ‘ত্রিশূল’, ‘কালা পাত্থর’, ‘অমর আকবর অ্যান্থনি’, ‘ডন’, ‘লাবারিস’, ‘মুকদ্দর কা সিকন্দর’, ‘কুলি’, ‘শরাবী’, ‘শানেনশাহ’, ‘অগ্নিপথ’ প্রভৃতি সিনেমায় কাজ করেছেন। অমিতাভের চলচ্চিত্র জগতে পথচলা শুরু হয় ১৯৬৯ সালের ‘সাত হিন্দুস্তানী’-র সঙ্গে। তখন কী তিনি ভেবেছিলেন আগামী দিনগুলিতে ভারতীয় চলচ্চিত্রের প্রথম পুরুষ হয়ে উঠবেন। ‘জাদুকর’, ‘লাল ‘বাদশাহ’, ‘মে আজাদ হু’-সহ বেশ কিছু সিনেমা ফ্লপ হয়েছিল। তাঁর কোম্পানি অমিতাভ বচ্চন কর্পোরেশন লিটিটেড ১৯৯৬ সালে মিস ওয়ার্ল্ড প্রতিযোগিতার আয়োজন করেছিল। সেই আয়োজনে ক্ষতি হয়েছিল তাঁর। অমিতাভ বচ্চন কর্পোরেশন লিটিটেড চলচ্চিত্র তৈরিও করেছিল, যা সফলতা পায়নি। তিনি প্রায় দেউলিয়া হওয়ার দোরগোড়ায় পৌঁছে গিয়েছিলেন। তাঁর কাছে কোনও কাজও ছিল না। প্রখ্যাত নির্মাতা-নির্দেশক জশ চোপড়ার কাছে কাজ চেয়েছিলেন তিনি। জশ চোপড়া নির্দেশনায় ‘মোহাব্বতে’ এবং ‘কউন বানেগা ক্রোরপতি’ তিনি ফের শিখরে পৌঁছে যান। দ্বিতীয় ইনিংসে ‘ব্ল্যাক’, ‘খাকি’, ‘পা’, ‘পিঙ্ক’, ‘পিকু’, ‘বদলা’ প্রভৃতি হিট ছবি তিনি উপহার দিয়েছেন। অমিতাভ বচ্চন শুধুমাত্র ভারতেই সীমাবদ্ধ নন, বিশ্বের সেরা অভিনেতাদের মধ্যে তিনি গণ্য হন। ভক্তদের আরও অনেক কিছু দেওয়া বাকি রয়েছে অমিতাভের, তিনি শীঘ্রই সুস্থ হয়ে উঠবেন। দেশ ও বিশ্বের কোটি কোটি শুভাকাঙ্ক্ষীরা তাঁর জন্য প্রার্থনা করছেন।
(লেখক প্রবীণ সম্পাদক, কলামিস্ট এবং প্রাক্তন সাংসদ)