করিমগঞ্জ (অসম), ৮ এপ্রিল (হি.স.) : যতদিন ভ্যাকসিন না বেরোচ্ছে ততদিন সৰ্বাবস্থায় সামাজিক দূরত্ব মেনে চলার আবেদন জানালেন মুখ্যমন্ত্রী সর্বানন্দ সানোয়াল। বলেন, চৌদ্দ এপ্রিলের পর লকডাউন বাড়বে কিনা সেটা নির্ভর করছে প্রধানমন্ত্রীর আগামী ভাষণের ওপর। বুধবার করিমগঞ্জে এসে মুখ্যমন্ত্রী সবাইকে আশ্বাস দেন, ‘চিন্তার কিছু নেই। মানুষের দৈনন্দিন প্রয়োজন পূরণের ব্যাপারে সরকার সমানে লক্ষ্য রেখে চলেছে। এখন সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে এই ভাইরাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে হবে।’
মুখ্যমন্ত্রী বলেন, করোনা ভাইরাস কোনও জাতি ভাষা ধর্ম বোঝে না। এখন পর্যন্ত এর প্রতিষেধক ভ্যাকসিনও আবিষ্কার হয়নি। তাই বাঁচতে হলে সামাজিক দূরত্ব অবশ্যই বজায় রেখে চলতে হবে। করোনা নিয়ে কাউকে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ না ছড়ানোর আহ্বান জানিয়ে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, কেউ যদি সাম্প্রদায়িক রং ছড়ানোর চেষ্টা করে তা হলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির বিরুদ্ধে কড়া শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তিনি তাঁর বক্তব্যে করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রধান সৈনিক চিকিৎসক, নার্স, পুলিশ বাহিনী, প্রশাসনিক কর্মচারী সহ সংবাদ মাধ্যমকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, আপনাদের যৌথ প্রচেষ্টায় আমরা ভাইরাসের বিরুদ্ধে নিরন্তর যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছি। এই যৌথ লড়াইয়ে একদিন আমরা জয়ী হবই, দৃঢ়তার সঙ্গে বলেন মুখ্যমন্ত্রী। পাশাপাশী বন ও পরিবেশ মন্ত্রী পরিমল শুক্লবৈদ্যরও প্রশংসা করে বলেন, বরাকের তিন জেলার পরিস্থিতি তদারকির দায়িত্ব খুব ভালোভাবেই সামলাচ্ছেন পরিমলবাবু।
আজ (বুধবার) দুপুর সাড়ে বারোটায় সরকারি স্কুলের খেলার মাঠে মুখ্যমন্ত্রীর কপ্টার অবতরণ করে। তাঁকে স্বাগত জানাতে মাঠে ছিলেন জেলাশাসক আনবামুথান এমপি, জেলার পুলিশ সুপার কুমার সঞ্জীব কৃষ্ণা, জেলা বিজেপি সভাপতি সুব্রত ভট্টাচার্য, বিধায়ক কৃষ্ণেন্দু পাল, বিধায়ক বিজয় মালাকার, জেলা পরিষদ সভাপতি আশিস নাথ, বিজেপির প্রদেশ নেতা বিশ্বরূপ ভট্টাচার্য প্রমুখ। মাঠ থেকে বেরিয়ে মুখ্যমন্ত্রী সোজা চলে যান করিমগঞ্জ সিভিল হাসপাতালে। সিভিল হাসপাতাল এখন কোভিড ১৯-এর ট্রিটমেন্ট সেন্টার। মুখ্যমন্ত্রী এসেই প্রথমে নিজের হাতে সেনিটাইজার ব্যবহার করেন। তার পর হাতে গ্লাভস পরে ভেতরে ঢুকেন। আইসোলেশন ওয়ার্ডে কর্মরত প্রত্যেক চিকিৎসক ও এই পরিষেবার সঙ্গে জড়িত সকল স্বাস্থ্যকর্মীর সঙ্গে মত বিনিময় করে তাঁদেরকে সাবধানে চলার পরামর্শ দেন। স্বাস্থ্য পরিষেবার যাবতীয় বিষয়ও পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে খতিয়ে দেখেন মুখ্যমন্ত্রী।
করোনা মোকাবিলায় হাসপাতালের সার্বিক প্রস্তুতি খতিয়ে দেখে মুখ্যমন্ত্রী সোজা চলে যান জেলাশাসকের কার্যালয়ে। জেলাশাসকের কনফারেন্স হল-এ শিলচরের সাংসদ ডা. রাজদীপ রায়, বন ও পরিবেশ মন্ত্রী পরিমল শুক্লবৈদ্য প্রমুখ সহ জেলার প্রশাসনিক বিভিন্ন বিভাগের আধিকারিকগণ সহ বিধায়ক কৃষ্ণেন্দু পাল, বিধায়ক কমলাক্ষ দে পুরকায়স্থ, বিধায়ক বিজয় মালাকার, বিধায়ক আজিজ আহমদ খান, জেলা কংগ্রেস সভাপতি সতু রায়, বিজেপি জেলা সভাপতি সুব্রত ভট্টাচার্য, এআইইউডিএফের জেলা সভাপতি আজিজুর রহমান তালুকদারদের নিয়ে শুরু হয় পর্যালোচনা বৈঠক। প্রথমেই জেলার করোনা নিয়ে সার্বিক পরিস্থিতি মুখ্যমন্ত্রীর সামনে তূলে ধরেন জেলাশাসক আনবামুথান এমপি। এক এক করে স্বাস্থ্য, পূর্ত, জনস্বাস্থ্য ও কারিগরি, বিদ্যুৎ সহ প্রত্যেক বিভাগের পদস্থ আধিকারিকরা তাঁদের বিভাগীয় প্রস্তুতির কথা মুখ্যমন্ত্রীর সামনে তুলে ধরেন। তবে জনস্বাস্থ্য ও কারিগরি বিভাগের এগজিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ারের প্রদত্ত বয়ানের তীব্র আপত্তি তুলেন পাথারকান্দির বিধায়ক কৃষ্ণেন্দু পাল। তিনি বলেন, জেলার কোথাও ব্লিচিং ডিস্ট্রিবিউশন চোখে পড়েনি। রাতাবাড়ির বিধায়ক বিজয় মালাকারও একই অভিযোগ তুলেন। জেলার জনস্বাস্থ্য ও কারিগরি বিভাগ বিভিন্ন এলাকায় পর্যাপ্ত ব্লিচিং পাউডার দিচ্ছে না। ফলে গ্রামাঞ্চলে ঠিকমতো সেনিটেশন হচ্ছে না। জেলার সিংহভাগ পানীয় জল প্রকল্প মুখ থুবড়ে পড়ে রয়েছে বলে মুখ্যমন্ত্রীর সামনে জেলা জনস্বাস্থ্য ও কারিগরি বিভাগের ব্যর্থতা তুলে ধরেন শাসক দলের দুই বিধায়ক কৃষ্ণেন্দু ও বিজয়।
জেলা পরিষদ সভাপতি আশিস নাথও দুই বিধায়কের সুরে সুর মিলিয়ে করিমগঞ্জ জেলায় পিএইচই পুরোপুরি ব্যর্থ বলে মুখ্যমন্ত্রীকে অবগত করান। অন্যদিকে জেলার বিদ্যুৎ সমস্যার কথা তুলে ধরেন উত্তর করিমগঞ্জের বিধায়ক কমলাক্ষ দে পুরকায়স্থ। মুখ্যমন্ত্রীকে তিনি অভিযোগ করে বলেন, এই জেলায় হালকা বাতাস ও সামান্য ঝিরঝির বৃষ্টি হলেই সমগ্র জেলা কমপক্ষে দুই থেকে তিন দিনের জন্য অন্ধকারে ডুবে যায়। বর্তমান যুগে মানব জীবনে বিদ্যুৎ একটি অপরিহার্য অঙ্গ। বিদ্যুৎ ছাড়া করিমগঞ্জের মানব জীবন স্তব্ধ হয়ে পড়ে। তাই করিমগঞ্জ জেলার অন্যতম প্রধান সমস্যা বিদ্যুৎ পরিষেবা স্বাভাবিক করে তুলতে মুখ্যমন্ত্রীকে বিশেষ নজর দেওয়ার দাবি জানান বিধায়ক কমলাক্ষ।
জেলা কংগ্রেস সভাপতি সতু রায় মুখ্যমন্ত্রীর করিমগঞ্জ সফরকে সাধুবাদ জানিয়ে বলেন, বর্তমান সময়ে কিছু লোকের উস্কানিমূলক বয়ানবাজি সমাজে সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্প ছড়াচ্ছে। এ সব ক্ষেত্রে শক্ত হাতে রাশ টানতে সতু রায় মুখ্যমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেন। এআইইউডিএফের জেলা সভাপতি আজিজুর রহমান তালুকদার বিভিন্ন বিষয় নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, জেলা প্রশাসন বলছে খাদ্য ভাণ্ডারে পর্যাপ্ত সামগ্ৰী মজুত রয়েছে। কিন্তু বাস্তবে বিভিন্ন এলাকায় ঠিকমতো সরকারি ত্রাণ পৌঁছতে পারছে না। গণবণ্টন ব্যবস্থা জেলায় ঠিকমতো পরিচালিত না হলে খাদ্যের আকাল দেখা দেওয়াটাই স্বাভাবিক। লকডাউনের ফলে রুজি-রোজগার হারিয়ে জেলার সিংহভাগ মানুষ খাদ্যের অভাবে ধুঁকছেন। অসহায় এই সব মানুষের দুঃখের কথা মানবিক দৃষ্টিকোণ দিয়ে বিচার বিবেচনা করার জন্য মুখ্যমন্ত্রীর বিশেষ দৃষ্টি আকর্ষণ করেন আজিজুর রহমান তালুকদার। পাশাপাশি তিনি ন্যায্যমূল্যের দোকানগুলোতে সঠিক গণবণ্টনের ব্যবস্থা করা এবং বাজারে মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি রাখেন।
প্রায় পঁয়তাল্লিশ মিনিটের রিভিউ মিটিং সেরে মুখ্যমন্ত্রী হাইলাকান্দির উদ্দেশে রওয়ানা হয়ে যান। জানা গেছে, হাইলাকান্দি গিয়ে সেখানকার সন্তোষ কুমার রায় অসামরিক হাসপাতাল পরিদর্শন করে জেলাশাসকের কার্যালয়ে পর্যালোচনা বৈঠক করেছেন।