হাফলং (অসম), ১১ ফেব্রুয়ারি (হি.স.) : এনসি হিলস ইন্ডিজেনাস পিপলস ফোরাম আহূত মঙ্গলবার থেকে অনির্দিষ্টকালীন ডিমা হাসাও জেলা বনধে ব্যাপক হিংসা ছড়িয়েছে সদর শহর হাফলঙে। শহরের বিভিন্ন স্থানে পুলিশ ও বনধ সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছে। বাধ্য হয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশকে কোথাও মৃদু লাঠিচার্জ, কোথাও কাঁদানে গ্যাস এবং রবার বুলেট ছুঁড়তে হয়েছে। পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে কম করে সাত বনধ সমর্থক আহত হয়েছেন। আহতদের মধ্যে কয়েকজন মহিলাও রয়েছেন। এঁদের সবাইকে হাফলং সরকারি হাসপাতালে ভরতি করা হয়েছে। তবে আজকের বনধ-এ পাহাড় লাইনে ট্রেন পরিষেবায় কোনও ব্যাঘাত সৃষ্টি করতে পারেনি পিকেটাররা, সব ধরনের ট্রেন ছিল সচল।
ডিমা হাসাওকে দুভাগে বিভক্ত করে পৃথক দুই ডিস্ট্রিক্ট এবং পৃথক স্বশাসিত পরিষদ গঠনের দাবির ভিত্তিতে মঙ্গলবার ভোর ৫-টা থেকে অনির্দিষ্টকালের বনধ ডেকেছিল এনসি হিলস পিপলস ফোরাম। বনধকে কেন্দ্র করে গত কয়েকদিন ধরে এমনিতেই উত্তপ্ত হয়ে উঠেছিল ডিমা হাসাও জেলার পরিস্থিতি। ডিমাসা জনগোষ্ঠীর সাতটি সংগঠন এর বিরোধিতা করে চলমান মাধ্যমিক পরীক্ষার জন্য আহূত বনধ প্রত্যাহার করার আহ্বান জানিয়েছিল। কিন্তু ইন্ডিজেনাস পিপলস ফোরাম ডিমাসা জনগোষ্ঠীয় সাতটি সংগঠনের কোনও আর্জিই কানে তুলেনি। ডিমা হাসাও জেলার বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর বৃহৎ সংগঠনকে নিয়ে গঠিত জয়েন্ট কর্ডিনেশন কমিটি, ডিমা হাসাওয়ের জেলাশাসক অমিতাভ রাজখোয়া এবং পুলিশ সুপার বীরবিক্রম গগৈও বনধ প্রত্যাহারের আহ্বান জানিয়েছিলেন। কারোর আহ্বানে কর্ণপাত না করে ইন্ডিজেনাস পিপলস ফোরাম তাদের সিদ্ধান্তে অনড় থাকে।
আজ ভোর ৫-টা থেকে প্রথম কয়েক ঘণ্টা বনধ শান্তিপূর্ণ থাকার পর সকাল ১০টা নাগাদ অশান্ত হয়ে ওঠে পরিস্থিতি। প্রথমে হাফলং সিনোড পয়েন্টের কাছে পিকেটার্সদের পুলিশ আসতে বাধা দিলে শুরু হয় উভয় পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশকে কয়েক রাউন্ড রবার বুলেট এবং কাঁদানে গ্যাস ছুঁড়তে হয়েছে। তাছাড়া উত্তর কাছাড় পার্বত্য স্বশাসিত পরিষদের সামনে বনধ সমর্থকরা একটি বলেরো গাড়িতে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর করে। পরিষদের কর্মচারীদের সচিবালয়ে ঢুকতে বাধা প্রদান করলে শুরু হয় পুলিশের সঙ্গে খণ্ডযুদ্ধ। উত্তেজিত বনধ সমর্থকরা পুলিশকে লক্ষ্য করে ক্যাটিবল চালাতে থাকে। তখন এদের ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ কয়েক রাউন্ড কাঁদানে গ্যাসের শেল নিক্ষেপ করে। তার পর বেলা দেড়টা নাগাদ সিনোড রোটারির কাছে ডিএফও রমেন দাসের বলেরো গাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে বনধ সমর্থককারীরা। উত্তর কাছাড় পার্বত্য স্বশাসিত পরিষদ সচিবালয়ে একটি পর্যালোচনা সভা শেষ করে নিজের আবাসে ফেরার পথে বনধ সমর্থকরা গাড়ি আটকে ডিএফও রমেন দাসকে নামিয়ে নামিয়ে তাঁর বলেরোতে আগুন ধরিয়ে দেয়।
এছাড়া হাফলং ডিসগাঁওরাজিতে দুই গোষ্ঠীর মধ্যে পাথরবৃষ্টির ফলে কয়েকজন আহত হয়েছেন বলে খবর পাওয়া গেছে। এভাবেই মঙ্গলবার গোটা দিন হাফলং শহরের বিভিন্ন স্থানে চলে সংঘর্ষ। আর এতে বেশ কয়েকবার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশকে লাঠিচার্জ, কাঁদানে গ্যাসের শেল এবং রবার বুলেট ছুড়তে হয়েছে।
এদিকে শহরের বিভিন্ন স্থান থেকে ইন্ডিজেনাস পিপলস ফোরামের কার্যনির্বাহী সভাপতি সামসুদ্দেনবে জেমি এবং সভাপতি ডেভিড কেভম-সহ বেশ কয়েকজন পিকেটার্সকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।
ইন্ডিজেনাস পিপলস ফোরাম আহূত অনির্দিষ্টকালীন বনধ-এর পরিপ্রেক্ষিতে জেলা প্রশাসন এবং উত্তর কাছাড় পার্বত্য স্বশাসিত পরিষদের নর্মাল সেক্টরের প্রধানসচিব তাঁর এক নির্দেশে কর্মচারীদের আজ সংশ্লিষ্ট কার্যালয়ে উপস্থিত হওয়ার নির্দেশ দিলেও সরকারি কার্যালয়গুলিতে উপস্থিতির হার ছিল নগণ্য।
ফোরামের ডাকা ডিমা হাসাও জেলা বনধ ছিল আংশিক। জেলা সদর শহর হাফলং, মাহুর ও হারাঙ্গাজাওয়ে বনধ-এর প্রভাব কিছুটা পড়লেও জেলার মহকুমা সদর মাইবাং, লাংটিং, হাতিখালি, উমরাংসো, দিহাঙ্গি, দিয়ুংমুখ ছিল সম্পূর্ণ সচল। হাফলঙে বনধ-এর দরুন বাজারহাট, দোকানপাট, ব্যাংক, পোস্ট অফিস, সবই ছিল বন্ধ। এদিকে তথ্য ও জনসংযোগ বিভাগের দুই কর্মচারী সেইহিন সাংসন ও স্যামুয়েল নামপুই নিজের কার্যালয় থেকে বাড়ি ফেরার পথে পিকেটার্সরা তাঁদের আটকে মারপিট করেছে বলে জানা গেছে।
সোমবার থেকে রাজ্যে শুরু হয়েছে মাধ্যমিক পরীক্ষা। বুধবার থেকে শুরু হবে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা। তবে ইন্ডিজেনাস স্টুডেন্টস ফোরামের এই অনির্দিষ্টকালীন ডিমা হাসাও বনধ-এ বিপাকে পড়েছেন ছাত্রছাত্রীরা। চিন্তিত ছাত্রছাত্রীর অবিভাবকরাও।
এদিকে বনধকে কেন্দ্র করে অশান্ত পরিবেশ সৃষ্টি হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট অমিতাভ রাজখোয়া সমগ্র জেলায় ১৪৪ ধারা জারি করেছেন। এই প্রতিবেদন পাঠানো পর্যন্ত হাফলং শহরের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে থাকলেও তীব্র উত্তেজনা বিরাজ করছে।
প্রসঙ্গত, গত ৬ ফেব্রুয়ারি একই দাবিতে ইন্ডিজেনাস পিপলস ফোরামের ডাকা ১২ ঘণ্টার বনধে দুই গোষ্ঠীর মধ্যে সংঘর্ষে হিংসাত্মক ঘটনার সৃষ্টি হয়েছিল। তাই আজকের বনধকে কেন্দ্র করে যাতে এ ধরনের পরিস্থিতির সৃষ্টি না হয় সে নিয়ে সতর্ক ছিল জেলার সাধারণ ও পুলিশ প্রশাসন। ডিমা হাসাও জেলার পুলিশ সুপার বীরবিক্রম গগৈ জানান, বনধকে কেন্দ্র করে যাতে কোনও ধরনের হিংসাত্মক ঘটনা সংগঠিত না হয়, যে কোনও অবস্থায় জেলার শান্তি শৃঙ্খলা বজায় থাকে সেদিকে পুলিশ তীক্ষ্ণ নজর রেখেছিল। পুলিশ সুপার বলেন, কেউ যদি বনধকে কেন্দ্র করে শান্তি শৃঙ্খলা ভঙ্গ করার চেষ্টা করে তা হলে এর বিরুদ্ধে পুলিশ কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। পুলিশ সুপার জানান, বনধ-এর পরিপ্রেক্ষিতে অতিরিক্ত পুলিশ বাহিনী নিয়ে আসা হয়েছে। নিয়োজিত করা হয়েছে বিএসএফও, জানান পুলিশ সুপার বীরবিক্রম গগৈ।