বিধানসভার ভুলে তদন্তাধীন মামলায় বিবৃতি দিলেন ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী, শাসক-বিরোধী তীব্র বাদানুবাদে উত্তপ্ত বিধানসভা, সভা ত্যাগ বিরোধীদের

আগরতলা, ২০ জানুয়ারি (হি. স.) : বিধানসভার ভুলে তদন্তাধীন মামলায় বিবৃতি দিলেন ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী বিপ্লব কুমার দেব।এ-নিয়ে শাসক-বিরোধী তীব্র বাদানুবাদে আজ উত্তপ্ত হয়ে উঠেছিল বিধানসভা। কণ্ঠরোধ করার অভিযোগ এনে সভা ত্যাগ করেন বিরোধীরা।

থানার লকআপে সন্দেহভাজন অপরাধীর অস্বাভাবিক মৃত্যুর ঘটনায় আজ বিধানসভায় দৃষ্টি আকর্ষণী নোটিশের জবাব দিয়েছেন ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী বিপ্লব কুমার দেব। তাতেই দেখা দেয় বিপত্তি। ম্যাজিস্ট্রেট তদন্ত চলাকালীন বিধানসভায় ওই মামলা নিয়ে আলোচনা উচিত হবে না। তাতে তদন্ত প্রভাবিত হতে পারে বলে উপাধ্যক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন ট্রেজারি বেঞ্চের সদস্য সুদীপ রায় বর্মন। উপাধ্যক্ষ বিশ্ববন্ধু সেন ওই কথায় যৌক্তিকতা রয়েছে স্বীকার করে মুখ্যমন্ত্রীর বিবৃতি নিয়ে আলোচনা বাতিল করে দেন। তাতে চটে লাল হয়ে যান বিরোধীরা। বিধানসভা সচিবালয়ের ভুলে তদন্তাধীন মামলা বিধানসভায় আলোচনার জন্য সম্মত হয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। তাই, তাঁর কাছেই স্পষ্টীকরণ চেয়েছিলেন বিরোধীরা। এ-নিয়ে তীব্র বাদানুবাদের মধ্যে উপাধ্যক্ষ বিধানসভার পরবর্তী কার্যসূচি শুরু করে দেওয়ায় বিরোধীদের কন্ঠ রোধ করা হচ্ছে অভিযোগ এনে বিরোধীরা সভাকক্ষ ছেড়ে বেরিয়ে যান। পরে বিধানসভার বাইরে বিরোধী দলনেতা মানিক সরকার বলেন, সংখ্যার জোরে বিরোধীদের কন্ঠ রোধ করা হচ্ছে। প্রতিবাদ না করলে ভুল বার্তা যাবে।

এদিন মুখ্যমন্ত্রী বিধানসভায় বিধায়ক রতন কুমার ভৌমিক এবং বিধায়ক নির্মল বিশ্বাসের উত্থাপিত দৃষ্টি আকর্ষণী নোটিসের জবাবে বলেন, গত ১০ জানুয়ারি লংকামুরার বাসিন্দা সুশান্ত ঘোষ(৩৯)-কে ত্রিপুরা পুলিশের ক্রাইম ব্রাঞ্চ গ্রেফতার করেছিল। গ্রেফতারের পর তাকে প্রয়োজনীয় সকল নিয়মনীতি মেনে ১১ জানুয়ারি সিজেএম আদালতে সোপর্দ করে ক্রাইম ব্রাঞ্চ। আদালত তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য দুই দিনের পুলিশ রিমান্ড মঞ্জুর করে। তিনি বলেন, ওইদিন তদন্তকারী অফিসার অভিযুক্ত ব্যক্তিকে থানার লকআপে রাখার শর্তে পশ্চিম থানায় নিয়ে আসেন।

মুখ্যমন্ত্রীর কথায়, ওইদিনই তদন্তকারী অফিসার অভিযুক্তকে সন্ধ্যা ৬টা ২৩ মিনিট নাগাদ থানার লকআপ থেকে জিজ্ঞাসাবাদের উদ্দেশ্যে বাইরে নিয়ে যান এবং ১২ জানুয়ারি রাট ১২টা ২৪ মিনিটে তাকে ফিরিয়ে নিয়ে আসেন। মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্য, ১২ জানুয়ারি ভোর ৫টা ১ মিনিটে সেন্ট্রি যখন অভিযুক্তকে থানার লক আপে দেখতে যান তাকে শৌচালয়ে ফাঁসিতে ঝুলন্ত অবস্থায় পান।

মুখ্যমন্ত্রী বলেন, থানার লক আপে অভিযুক্ত ব্যক্তির মৃত্যুর খবর পরিবারের সদস্যদের জানায় এবং পশ্চিম আগরতলা থানায় একটি আত্মহত্যার মামলা রুজু করে পুলিশ।তিনি আরো বলেন, ওই মামলার তদন্তের সময় মৃতের পরিবারের তরফে খুনের অভিযোগ এনে মামলা করেন তার বাবা পরিমল ঘোষ।

মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্য, ঘটনার গুরুত্ব বিবেচনা করে ওই মামলাটি ত্রিপুরা পুলিশের ক্রাইম ব্রাঞ্চের সিরিয়াস ক্রাইম শাখাকে হস্তান্তর করা হয়। সাথে আইন সম্মতভাবে এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট মৃত সুশান্ত ঘোষের অনুসন্ধান রিপোর্ট তৈরি করেন। তাঁর দাবি, ওই রিপোর্টে মৃতের শরীরে একমাত্র প্রতিবন্ধনী চিহ্ন ছাড়া কোন প্রকার বাহ্যিক আঘতের নেই। তাঁর আরও দাবি, জি ভি হাসপাতালের চিকিৎসকদের একটি দল এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতিতে মৃতের ময়না তদন্ত করেন। শুধু তাই নয়, ওই পুরো প্রক্রিয়ার ভিডিওগ্রাফিও করা হয়েছে।

মুখ্যমন্ত্রীর কথায়, ময়না তদন্তের রিপোর্ট মোতাবেক মৃত্যুর কারণ ঝুলন্ত অবস্থায় শ্বাসরোধ হয়ে মৃত্যু। তিনি জানান, মৃতদেহের অন্তরজন্ত্র সংরক্ষণ করে কোন বিষক্রিয়া অথবা মাদকাসক্তি জনিত কারণ অনুসন্ধানের উদ্দেশ্যে আরও পরীক্ষা নিরীক্ষার জন্য স্টেট ফরেনসিক সায়েন্স ল্যাবরেটরিতে পাঠানো হয়েছে। তিনি আরো জানান, পশ্চিম আগরতলা থানার লক আপের প্রাকৃত ভিডিও ফুটেজ কোন প্রকার বৃকিটি হয়েছে কিনা তা নিশ্চিত হওয়ার জন্য বহিঃরাজ্যের ফরেনসিক ল্যাবে পাঠানো হয়েছে। সাথে তিনি যোগ করেন, জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের গাইডলাইন অনুসরণ করে থানার লক আপে মৃত্যুর বিষয়টি গত ১২ জানুয়ারি জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সচিবকে অবগত করা হয়েছে। তাছাড়া, গত ১৩ জানুয়ারি ওই মৃত্যুর ঘটনায় ম্যাজিস্ট্রেটে পর্যায়ের তদন্তের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

এদিন তিনি জানান, কর্তব্যে গাফিলতির জন্য ওইদিন কর্তব্যরত সাব ইন্সপেক্টর সঞ্জিত দেববর্মা এবং সেন্ট্রি বরখাস্ত করা হয়েছে। সাথে তিনি আরও জানান, ইতিমধ্যে মৃতের পরিবারকে মুখ্যমন্ত্রী ত্রাণ তহবিল থেকে ৩ লক্ষ টাকা প্রদান করা হয়েছে।

মুখ্যমন্ত্রীর বিবৃতির ভিত্তিতে বিরোধীদলের সদস্য রতন ভৌমিক অতিরিক্ত প্রশ্ন তুলতে চেয়েছিলেন। কিন্তু, তখন ট্রেজারি বেঞ্চের সদস্য সুদীপ রায় বর্মন তদন্তাধীন মামলায় বিধানসভায় আলোচনায় বৈধতা নিয়ে সওয়াল করেন। তাঁর বক্তব্য, ওই মামলা নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী বিবৃতি দিয়েছেন কিন্তু এর বাইরে অতিরিক্ত আলোচনা তদন্তকে প্রভাবিত করতে পারে। তাই, বিধানসভায় আলোচনা না হাওয়াই উচিত হবে। উপাধ্যক্ষ ওই কথায় যৌক্তিকতা রয়েছে স্বীকার করে আলোচনা বাতিল করে দেন। তাতেই চটে লাল হয়ে যান বিরোধীরা।

বিরোধী দলনেতা মানিক সরকার বলেন, বিধানসভা সচিবালয় ওই নোটিশটির আইনি দিক খতিয়ে না দেখে অধ্যক্ষের কাছে পাঠানো উচিত হয় নি। বিধানসভা সচিবালয়ের ভুলে নোটিসের জবাব দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। তাই, এখন অতিরিক্ত প্রশ্নের জবাব দিতে আপত্তি থাকা উচিত হবে না। কিন্তু, উপাধ্যক্ষ বিরোধীদের কোন কথা শুনতে রাজি হননি। তাতে, বিধানসভায় তীব্র বাদানুবাদ শুরু হয়। মাঝে আইনমন্ত্রী রতনলাল নাথ মুখ্যমন্ত্রীর পক্ষে সওয়াল করার চেষ্টা করেন। তাতে বিরোধীরা আরও রেগে যান এবং মুখ্যমন্ত্রী জবাব দেওয়ার অনুরোধ জানান। এরই মাঝে উপাধ্যক্ষ পরবর্তী কার্যসূচি শুরু করে দেন। তাতে বিরোধীরা কন্ঠ রোধ করা হচ্ছে অভিযোগ এনে বিধানসভা ত্যাগ করে বেরিয়ে যান।

পরে বিধানসভার বাইরে বিরোধী দলনেতা মানিক সরকার বলেন, থানার লক আপে ওই মৃত্যু কোনভাবেই সন্দেহের উর্দ্ধে নয়। কারণ, মৃতের বোনের বক্তব্যের সাথে মুখ্যমন্ত্রীর বিবৃতির ফারাক রয়েছে। তাই, বিচারবিভাগীয় তদন্ত হলেই প্রকৃত রহস্যের উদ্ঘাটন হতো তিনি মনে করেন। এদিন তিনি ক্ষোভের সুরে বলেন, বিধানসভায় সংখ্যার জোরে বিরোধীদের কন্ঠ রোধ করা হচ্ছে। উপাধ্যক্ষ পদের গরিমা ভুলে গেছেন। তাই, বিধানসভা অধিবেশন ছেড়ে বেরিয়ে এসেছি আমরা। তাঁর বক্তব্য, বিরোধীদের প্রতি বিধানসভায় আচরণ মেনে নেওয়া যায় না। তাই, প্রতিবাদ না হলে ভুল বার্তা যাবে। বিরোধী দলনেতার দাবি, বিধানসভায় আজ মুখ্যমন্ত্রীর বিবৃতি তদন্তে প্রভাবিত করতে পারে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *