নিজস্ব প্রতিনিধি, আগরতলা, ৭ নভেম্বর৷৷ ব্রু শরণার্থীদের পুনরায় রেশন সরবরাহের প্রতিশ্রুতি দিল রাজ্য সরকার৷ আগামী ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত তাদের রেশন সরবরাহ চালু থাকবে৷ রাজ্য সরকার ওই রেশন সরবরাহের সমস্ত খরচ বহন করবে৷ আজ ব্রু শরণার্থী নেতাদের সাথে বৈঠকের পর এই ঘোষণা দেন উপমুখ্যমন্ত্রী জিষ্ণু দেববর্মা৷ এই প্রতিশ্রুতির ভিত্তিতে টানা ৮ দিন বাদে দশদা-আনন্দবাজার রাস্তা অবরোধ তুলে নিলেন ব্রু শরণার্থীরা৷ রাজ্য সরকারের হস্তক্ষেপে ব্রু শরণার্থীরা সাময়িক স্বস্তি দিয়েছেন৷ তবে, সহসা ওই জট কাটবে বলে মনে হচ্ছে না৷ কারণ এমবিএডিপিএফ সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক ব্রোনো মিশার সাফ কথা, বিনামূল্যে রেশন সরবরাহ সমাধান হতে পারে না৷ এমনকি, মিজোরামে প্রত্যাবর্তনও শরণার্থী সমস্যার সমাধান নয়৷ তাঁর দাবি, ব্রু শরণার্থীদের বিষয়ে নতুনভাবে আলোচনা শুরু হোক৷
![](https://jagarantripura.com/wp-content/uploads/2019/11/IMG-20191107-WA0043-1024x576.jpg)
১৯৯৭ সালে জাতি দাঙ্গার শিকার ব্রু জনজাতি মিজোরাম থেকে পালিয়ে ত্রিপুরায় আশ্রয় নেন৷ ওই সময় থেকে উত্তর ত্রিপুরা জেলায় কাঞ্চনপুর এবং পানিসাগরে ৭টি শিবিরে তাঁদের আশ্রয় দেওয়া হয়েছিল৷ কালের বিবর্তনে নানা পরিবর্তন হলেও ব্রু শরণার্থীদের ভাগ্য আজও সেই তিমিরেই রয়ে গেছে৷ তাঁদের মিজোরামে প্রত্যাবর্তনে বিভিন্ন সময়ে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে৷ কিন্তু, প্রত্যেকবার ব্রু শরণার্থী প্রত্যাবর্তন প্রক্রিয়া ভেস্তে গেছে৷ ২০১৮ সালে ব্রু শরণার্থীদের মিজোরামে প্রত্যাবর্তনের প্রক্রিয়া শুরু করতে চেয়েছিল কেন্দ্রীয় সরকার৷ গতবছর ২৩ জুলাই ত্রিপুরায় আশ্রিত ব্রু শরণার্থী প্রত্যাবর্তনে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল৷ সে মোতাবেক গতবছর অক্টোবরে প্রত্যাবর্তন প্রক্রিয়া শুরু করার বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়েছিল৷ ফলে, ৩০ সেপ্ঢেম্বর পর্যন্ত শরণার্থী শিবিরে বিনামূল্যে রেশন সরবরাহ চালু রেখেছিল কেন্দ্রীয় সরকার৷ কিন্তু, ব্রু শরণার্থী তাতেও মিজোরামে ফিরে যাননি৷ তাই, ওই যাত্রায় ২১ দিন রেশন সরবরাহ বন্ধ থাকার পর পুনরায় চালু করা হয়েছিল৷
এদিকে, কেন্দ্রীয় সরকার আবারো ব্রু শরণার্থীদের মিজোরামে প্রত্যাবর্তনে প্রক্রিয়া শুরু করে৷ তাতে, চলতি বছরের সেপ্ঢেম্বরে তাঁদের প্রত্যাবর্তনের চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়৷ সেই মোতাবেক ৩ অক্টোবর থেকে ব্রু শরণার্থী প্রত্যাবর্তন প্রক্রিয়া শুরু করার সিদ্ধান্ত হয়৷ এক্ষেত্রেও গত ১ অক্টোবর থেকে শরণার্থী শিবিরে বিনামূল্যে রেশন এবং নগদ আর্থিক সহায়তা বন্ধ করে দেয় কেন্দ্রীয় সরকার৷ তাতেই দেখা দেয় বিপত্তি৷ ব্রু শরণার্থীরা এবার রেশন এবং নগদ আর্থিক সহায়তার দাবিতে রাস্তা অবরোধ শুরু করেন৷ গত ৩১ অক্টোবর থেকে কাঞ্চনপুর মহকুমার দশদা-আনন্দবাজার রাস্তা ভোর ৫টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত তাঁরা অবরোধ করেন৷ এই অবরোধ কর্মসূচি প্রত্যাহারের বহু চেষ্টা করেছে জেলা ও মহকুমা প্রশাসন৷ কিন্তু, বলপ্রয়োগের হুমকি দিয়েও অবরোধ ঠেকাতে পারেনি প্রশাসন৷ গতকাল ১৪৪ ধারা ধারার মধ্যেই ব্রু শরণার্থীরা রাস্তা অবরোধ করেছেন৷ শুধু তাই নয়, প্রাক্তন পিসিসি সভাপতি প্রদ্যুৎ কিশোর দেববর্মন গতকাল অবরোধস্থলে গিয়ে সভাও করেছেন৷
ব্রু শরণার্থীদের বিক্ষোভের জেরে উদ্ভূত ওই পরিস্থিতি মোকাবিলায় আজ কাঞ্চনপুর ছুটে যান উপমুখ্যমন্ত্রী জিষ্ণু দেববর্মা, আইন মন্ত্রী রতন লাল নাথ, উপজাতি কল্যাণ মন্ত্রী মেবার কুমার জমাতিয়া, সমাজ কল্যাণ ও সমাজ শিক্ষা মন্ত্রী শান্তনা চাকমা এবং সাংসদ প্রতিমা ভৌমিক ও সাংসদ রেবতী ত্রিপুরা৷ সেখানে গিয়ে তাঁরা প্রথমেই কাঞ্চনপুর ডাকবাংলোতে প্রশাসনিক বৈঠক করেন৷ উত্তর ত্রিপুরা জেলা শাসক রেভেল হেমেন্দ্র কুমার, কাঞ্চনপুর মহকুমা শাসক অভেদানন্দ বৈদ্য এবং উত্তর ত্রিপুরা জেলা পুলিশ সুপার ভানুপদ চক্রবর্তীর সাথে বৈঠকে পরিস্থিতির পর্যালোচনা করেন তাঁরা৷ বৈঠক শেষে তাঁরা সোজা চলে যান লক্ষীপুরে অবরোধস্থলে৷
এদিন উপমুখ্যমন্ত্রী জিষ্ণু দেববর্মা অবরোধকারী ব্রু শরণার্থীদের আশ্বস্ত করেন, আমরা আপনাদেরই লোক৷ তাই, এই সমস্যার সমাধান বের করতে চাই৷ তিনি শরণার্থীদের উদ্দেশ্যে বলেন, আপনাদের কষ্ট আমাদের কাঁদায়৷ তাই আপনাদের নেতাদের বলেছি, সমস্যা বাড়াবেন না, সমাধান খুঁজে বের করুন৷ উপমুখ্যমন্ত্রীর কথায়, ব্রু শরণার্থী প্রত্যাবর্তনে শীঘ্রই সমাধান চাইছে ত্রিপুরা সরকার৷ তিনি বলেন, রাজনৈতিকভাবে নয়, মানবিক দৃষ্টিভঙ্গিতে ব্রু শরণার্থী ইস্যুতে সমাধান চাইছি আমরা৷ তাঁর দাবি, এই বিষয়ে ত্রিপুরা সরকারের এক্তিয়ার খুবই সীমিত৷ কারণ, ব্রু শরণার্থী প্রত্যাবর্তনে মিজোরাম সরকার এবং কেন্দ্রীয় সরকারকেই মূল ভূমিকা পালন করতে হবে৷ তবে, আপনাদের কল্যাণ দেখার দায়িত্ব রয়েছে আমাদেরও, বলেন তিনি৷
এদিন ব্রু শরণার্থীদের সাথে প্রাথমিক আলোচনার পর অবরোধস্থলের কাছেই অবস্থিত এসপিও ক্যাম্পে এমবিডিপিএফ সংগঠনের নেতাদের সাথে ত্রিপুরা সরকারের মন্ত্রিরা এবং দুই সাংসদ দীর্ঘ বৈঠক করেন৷ বৈঠক শেষে উপমুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা দেন, আগামী ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত শরণার্থী শিবিরে রেশন সরবরাহ করা হবে৷ বিনিময়ে আপনারা অবরোধ প্রত্যাহার করে নিন, আবেদন রাখেন তিনি৷ উপমুখ্যমন্ত্রী বলেন, ব্রু শরণার্থী নেতাদের সাথে তাঁদের দাবিদাওয়া নিয়ে ইতিবাচক আলোচনা হয়েছে৷ তাঁর দাবি, ত্রিপুরায় এখন সমস্যার নয়, সমাধানের সরকার ক্ষমতায় রয়েছে৷ তাই, ব্রু শরণার্থী সমস্যা নিয়ে ত্রিপুরা সরকার মিজোরাম ও কেন্দ্রীয় সরকারের সাথে আলোচনা করবে বলে স্থির করেছে৷ তিনি ব্রু শরণার্থীদের উদ্দেশ্যে আবেদন রাখেন, আপনারা অবরোধ তুলে নিন৷ কারণ, এই অবরোধে কারোর কোন ফায়দা হবে না৷ তিনি বলেন, ত্রিপুরা সরকার আপনাদের রেশন সরবরাহ করবে বলে স্থির করেছে৷ তার পুরো খরচ ত্রিপুরা সরকারই বহন করবে৷ উপমুখ্যমন্ত্রী বলেন, উত্তর ত্রিপুরা জেলা শাসককে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে আগামীকাল থেকে শরণার্থী শিবিরে পূর্বের ন্যায় রেশন সরবরাহ করা হোক৷
উপমুখ্যমন্ত্রী ফের আবেদন রাখেন, আপনারা ঘরে ফিরে যান৷ কারণ অবরোধে কোন সমস্যার সমাধান হবে না৷ বরং, সমন্বয়ের মাধ্যমেই সমাধান সম্ভব বলে মনে করেন তিনি৷ তিনি বলেন, আপনাদের নেতাদের ডেকেছি৷ আপনাদের সমস্যা নিয়ে ত্রিপুরা সরকার আলোচনায় প্রস্তুত রয়েছে৷ তাঁর কথায়, শরণার্থী সমস্যা নিয়ে নেতাদের সাথে আলোচনার নির্যাস কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে পাঠিয়ে দেবে ত্রিপুরা সরকার৷
এদিকে, রেশন চালু করার ত্রিপুরা সরকারের সিদ্ধান্তে খুশি হলেও, তাতে সমস্যার সমাধান হবে না বলে দাবি করেন এমবিডিপিএফ সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক ব্রুনো মিশা৷ তাঁর সাফ কথা, বিনামূল্যে রেশন শরণার্থী সমস্যার সমাধান হতে পারে না৷ এমনকি, মিজোরামে প্রত্যাবর্তনও ওই সমস্যার সমাধান নয়৷ তাই, ব্রু শরণার্থী সমস্যা সমাধানে পুনরায় আলোচনা শুরু হোক চাইছেন তিনি৷ ব্রুনো বলেন, ত্রিপুরা সরকার আলোচনার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছে৷ তাই, আজ আমরা রাস্তা অবরোধ প্রত্যাহার করে নিয়েছি৷ তিনি আরও জানান, এমবিডিপিএফ সংগঠনের চারজনের এক প্রতিনিধি দল আজ দিল্লি গেছেন৷ আগামীকাল তাঁরা কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী অমিত শাহের সাথে বৈঠক করবেন৷ তিনি বলেন, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর কাছে ব্রু শরণার্থী প্রত্যাবর্তনে নতুন করে আলোচনার আবেদন জানানো হবে৷ কারণ, কিছু ছোটখাটো সমস্যার সমাধান খুবই জরুরি হয়ে পড়েছে৷