নয়াদিল্লি, ৭ আগস্ট (হি.স.): আইনজীবী থেকে দুঁদে রাজনীতিক, বিপদে পড়লে সাহায্যের জন্য সর্বদাই হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন জননেত্রী সুষমা স্বরাজ| অনেকেই তাঁকে ‘সুপারমম’ হিসেবেও আখ্যা দেন| আত্মীয়-পরিজন, রাজনৈতিক মহল, বন্ধুবান্ধব, শুভাকাঙ্খী প্রত্যেককে শোকস্তব্ধ করে পরলোকগমণ করলেন প্রাক্তন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী তথা প্রবীণ বিজেপি নেত্রী সুষমা স্বরাজ| ১৯৫২ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি, হরিয়ানার আম্বালা ক্যান্টনমেন্টে জন্মগ্রহণ করেছিলেন বাকপটু সুষমা স্বরাজ| শিক্ষার্থী-জীবনে রাজ্যস্তরের প্রতিযোগিতায় পরপর তিন বছর হিন্দিভাষার সেরা বক্তার শিরোপা পেয়েছিলেন তিনি| সুষমা স্বরাজের বাবা হরদেব শর্মা ছিলেন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ (আরএসএস)-র একজন গুরুত্বপূর্ণ ও সক্রিয় সদস্য| মা লক্ষ্মীদেবী গৃহবধূ| আম্বালা ক্যান্টনমেন্টের সনাতন ধর্ম কলেজ থেকে সংস্কৃত ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতক ছিলেন সুষমা| এরপর আইন নিয়ে পড়াশোনা পঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ে|
![](https://jagarantripura.com/wp-content/uploads/2017/09/SushmaSwaraj.jpg)
সাতের দশকে অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদে হাতেখড়ি রাজনৈতিক জীবনে| জয়প্রকাশ নারায়ণের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সক্রিয় কর্মী ছিলেন সুষমা| জরুরি অবস্থার পর যোগ দিয়েছিলেন ভারতীয় জনতা পার্টিতে| রাজনীতির পাশাপাশিই চলছিল আইনবিদ্যা-চর্চা| ১৯৭৩ সালে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী হিসেবে পথচলা শুরু| সেখানেই পেয়ে যান ভবিষ্যতের জীবনসঙ্গীকে| সুপ্রিম কোর্টের দুই আইনজীবী স্বরাজ কৌশল ও সুষমা শর্মার একসঙ্গে পথ চলা শুরু হয় দেশজুড়ে জরুরি অবস্থার মধ্যে| ১৯৭৫ সালের ১৩ জুলাই সুষমা বিয়ে করেন স্বরাজকে| তারপর থেকে শর্মার বদলে সুষমার নতুন পদবী স্বরাজ| সুষমার স্বামী স্বরাজ কৌশল সুপ্রিম কোর্টের প্রবীণ আইনজীবী এবং একজন ক্রিমিনাল আইনজীবী| তিনি ১৯৯০ থেকে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত মিজোরামের রাজ্যপাল ছিলেন| আইনজ্ঞ দম্পতির একমাত্র মেয়ে বাঁশুরীও একজন আইনবিদ| তিনি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তনী| সুষমার বোন বন্দনা শর্মা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক| তাঁর ভাই গুলশন শর্মা আর্য়ুবেদ চিকিত্সক|
ভারতীয় রাজনীতিতে সুষমা অনেক ক্ষেত্রেই শীর্ষে| মাত্র ২৫ বছর বয়সে বিধায়ক নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি| আম্বালা বিধানসভা কেন্দ্রে ১৯৭৭ থেকে ১৯৮২ এবং ফের ১৯৮৭ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত তিনি বিধায়ক ছিলেন| মুখ্যমন্ত্রী দেবী লালের জনতা পার্টির সরকারে তিনি মন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন| বিজেপি-লোক দলের জোট সরকারে ১৯৮৭-১৯৯০ সুষমা ছিলেন হরিয়ানার শিক্ষামন্ত্রী| সুষমাই হলেন দিল্লির প্রথম মহিলা মুখ্যমন্ত্রী| ১৯৯৮-এর অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত তিনি এই দায়িত্বে ছিলেন| ১৯৯০ সালে রাজ্যসভার সদস্য মনোনীত হন| ১৯৯৬ সালে দক্ষিণ দিল্লি থেকে জয়ী সাংসদ সুষমা ছিলেন অটলবিহারী বাজপেয়ীর ১৩ দিনের সরকারের তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী| ১৯৯৮ সালে আবারও দক্ষিণ দিল্লি থেকে সাংসদ নির্বাচিত হন| আরও একবার তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রকের দায়িত্বে| এই সময় চলচ্চিত্র নির্মাণকে ইন্ডাস্ট্রি হিসেবে ঘোষণা করেন তিনি|
১৯৯৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে কর্ণাটকের বেল্লারি থেকে সোনিয়া গান্ধীর বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন সুষমা| কিন্তু, সেবার নির্বাচনে তিনি জয়ী হননি| সংসদে ফের প্রত্যাবর্তন হয় ২০০০ সালে, উত্তর প্রদেশ থেকে রাজ্যসভার সদস্য হয়ে| ওই বছরেই ফের তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রকের কার্যভার দেওয়া হয় সুষমাকে| ২০০০ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০০৩ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত এই দায়িত্বে ছিলেন তিনি| ২০০৩ সালের জানুয়ারি থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত স্বাস্থ্য, পরিবার কল্যাণ এবং সংসদীয় বিষয়ক মন্ত্রী ছিলেন| তাঁর সময়েই দেশজুড়ে ছ’টি এইমস প্রতিষ্ঠিত হয়| রাজ্যসভায় তৃতীয়বার আগমণ ২০০৬ সালে, মধ্যপ্রদেশ থেকে| ২০০৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে মধ্যপ্রদেশের বিদিশ কেন্দ্র থেকে ৪ লক্ষ ভোটের ব্যবধানে জয়ী হন সুষমা| পঞ্চদশ লোকসভায় তিনিই ছিলেন সংসদের বিরোধী দলনেতা| এরপর ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদীর প্রধানমন্ত্রিত্বে সরকার গঠন হয়| ২০১৯ সাল পর্যন্ত টানা পাঁচ বছর বিদেশমন্ত্রী পদে ছিলেন সুষমা| অসুস্থতার জন্য ২০১৯ লোকসভা নির্বাচনে তিনি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেননি|
বিদেশমন্ত্রী থাকাকালীন সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে খুব সহজে আমজনতার কাছে পৌঁছে গিয়েছিলেন সুষমা| সুষমার দৌলতেই টুইটার পরিণত হয়েছিল হেল্পলাইনে| সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন বিশ্বের যে কোনও প্রান্তের সমস্যাগ্রস্ত ভারতীয়দের দিকে| সুষমা স্বরাজের সৌজন্যেই সৌদি আরব থেকে উদ্ধার করা হয়েছিল হায়দরাবাদের জৈনাব বাইকে| ইন্দোরের (মধ্যপ্রদেশ) গীতাকেও ২০১৫ সালে পাকিস্তান থেকে ফিরিয়ে আনতে হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন সুষমা| কিন্তু, জীবনের লড়াইটা থামিয়ে দিলেন সুষমা|