নয়াদিল্লি, ২৫ জুলাই (হি.স.) : বিরোধী দলের সাংসদের ওয়াকআউট করা সত্ত্বেও লোকসভায় পাশ হয়ে গেল তাৎক্ষণিক তিন তালাক রোধে সংশোধিত তিন তালাক বিল। বৃহস্পতিবার প্রায় দিনভর বিতর্কে কংগ্রেস, তৃণমূল, বিজেডি-সহ অধিকাংশ বিরোধী দল ওই বিলের বিরোধিতা করলেও ধ্বনি ভোটে পাশ হয়ে গিয়েছে তিন তালাক বিল। এই বিলের সপক্ষে পড়ল ৩০২টি ভোট এবং বিপক্ষে ৮২টি ভোট। পাশাপাশি এদিন ধ্বনি ভোটে খারিজ হয়ে গিয়েছে আসাদউদ্দিন ওয়েসির আনা সংশোধনীও। এবার বিরোধী সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজ্যসভায় বিলটি পেশ করা হবে। যদিও রাজ্যসভায় এই বিল পাশ হবে কিনা, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। এদিকে আজ সংসদে তখন তিন তালাক বিল নিয়ে জোর বিতর্ক চলছিল। সেই সময় স্পিকারের চেয়ারে বসা বিজেপি সাংসদ রমা দেবীর উদ্দেশ্যে অশালীন মন্তব্য করলেন আজম খান | তাঁর মন্তব্যের জেরে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে লোকসভায়। এদিকে, তিন তালাক বিল পাশ হওয়ার পর স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন বাংলার সাহিত্যিক আবুল বাশার।তিনি বলেন এটা আমার জীবনের লড়াই |
বৃহস্পতিবার ‘মুসলিম উইমেন (প্রোটেকশন অব রাইটস অন ম্যারেজ) বিল, ২০১৯’ নামের সংশোধিত তিন তালাক বিল লোকসভায় পেশ করেন আইনমন্ত্রী রবিশঙ্কর প্রসাদ। তিন তালাক বিলের বিরোধিতায় অনড় কংগ্রেস-সহ অন্য বিরোধী দলগুলি। এই বিলের বিরোধিতা করেছে এনডিএ জোটের অন্যতম প্রধানমুখ নীতিশ কুমারের জেডি(ইউ)ও |তবে এদিন এই বিলের সমর্থন করেছে নবীন পট্টনায়কের বিজেডি | তবে এদিন দীর্ঘ আলোচনার পর এদিন পাশ হয়ে গেল বিলটি | বৃহস্পতিবার এই বিলের সপক্ষে পড়ল ৩০২টি ভোট এবং বিপক্ষে ৮২টি ভোট। এদিন ভোটাভুটির সময় কংগ্রেস, তৃণমূল কংগ্রেস-সহ বিরোধী দলের সাংসদরা ওয়াকআউট করে করা সত্ত্বেও লোকসভায় পাশ হয়ে গেল সংশোধিত তিন তালাক বিল। এদিনের ওয়াকআউটে শামিল হল বিজেপির জোটসঙ্গী জনতা দলের সাংসদরাও। এবার বিরোধী সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজ্যসভায় বিলটি পেশ করা হবে। এদিন বিল পাশ হওয়ার পরে কেন্দ্রীয় আইনমন্ত্রী রবি শংকর প্রসাদ জানিয়েছেন, নারীর মর্যাদা ও সম্মান রক্ষার্থে এই বিল জরুরি।
এদিন বিল পেশ করে রবিশঙ্কর প্রসাদ বলেন, এই বিলের সঙ্গে রাজনীতিকে জড়িয়ে ফেলা উচিত নয়। বিশ্বের ২০টি দেশে এর বিরুদ্ধে আইন রয়েছে। এটি মহিলাদের মর্যাদার প্রশ্ন। আইনের চোখে দেশের সব মহিলাই সমান। তাই মুসলিম মহিলারা এর বাইরে নন। পাশাপাশি বিজেপি নেত্রী মীনাক্ষী লেখি বলেন, এই প্রথার ফলে বহু মহিলার জীবন নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এদিন পেশ হওয়া তাৎক্ষণিক তিন তালাক রোধে সংশোধিত তিন তালাক বিলের খসড়ায় বলা হয়েছে যে, তিনবার তালাক উচ্চারণের মাধ্যমে স্ত্রীকে ডিভোর্স দিলে তা আইনি অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে এবং তালাক দেওয়া ব্যক্তির তিন বছর পর্যন্ত সশ্রম কারাদণ্ড হতে পারে। অর্থাত্ ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে।
আর এখানেই আপত্তি তুলেছেন সিংহভাগ বিরোধী দলগুলির সাংসদরা। কংগ্রেসের লোকসভার দলনেতা অধীর চৌধুরীর বক্তব্য, তিন তালাককে ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে গণ্য করার বিরোধী তাঁরা। কংগ্রেসেরই শশী তারুর প্রশ্ন তোলেন, সুপ্রিম কোর্টই যখন বলে দিয়েছে তিন তালাক অবৈধ, তখন নতুন করে আইন আনার প্রয়োজন কী? ফৌজদারি দণ্ডবিধির বিরুদ্ধে ছিলেন অল ইন্ডিয়া মজলিস-এ-ইত্তেহাদুল মুসলিমিন-এর (এআইএমআইএম) সাংসদ আসাদউদ্দিন ওয়েসি। একই সঙ্গে তাঁর প্রশ্ন, ”তিন তালাক দিলে স্বামীর তিন বছরের কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে বিলে। কিন্তু স্বামী জেলে থাকলে তাঁর খোরপোশ কোথা থেকে দেবেন স্বামী, আর ওই মহিলাই বা কী ভাবে খোরপোশ পাবেন।” তাই এই আইন কার্যত মহিলাদের শাস্তি দেওয়ার নামান্তর, মত ওয়েইসির।
ফৌজদারি বিধি দণ্ডবিধি নিয়ে আপত্তি জানিয়েছে তৃণমূলও।দলের লোকসভার দলনেতা সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে ওয়াকআউট করেন সাংসদরা। বিলের বিরোধিতা করে ওয়াকআউটে শামিল হন বিজেডি সাংসদরাও। তেলুগু দেশম পার্টির জয়দেব গাল্লার প্রশ্ন, ”হিন্দু আইনে বিবাহ-বিচ্ছেদ ফৌজদারি অপরাধ নয়, খ্রিস্ট ধর্মেও নয়, তাহলে শুধুমাত্র মুসলিম আইনেই কেন হবে।”বিলটিকে সিলেক্ট কমিটিতে পাঠানোর দাবিও ওঠে বিরোধী শিবির থেকে।
কেন্দ্র অবশ্য একাধিক যুক্তি দিয়েছে বিলের পক্ষে। সংসদে বিল পেশ করেন আইনমন্ত্রী রবিশঙ্কর প্রসাদ। তাঁর বক্তব্য, ”পাকিস্তান, মালয়েশিয়ার মতো অন্তত ২০টি মুসলিম দেশেও তিন তালাক নিষিদ্ধ। তাহলে আমরা ধর্মনিরপেক্ষ দেশ হয়ে কেন সেটা করতে পারব না। যে সব দেশে শরিয়ত আইন চালু, সেখানেও তিন তালাক ফৌজদারি অপরাধ।” ওয়েইসির প্রশ্নের উত্তরে বিজেপি সাংসদ পুনম মহাজন আবার পাল্টা ব্যক্তিগত আক্রমণ করে বলেন, ”আপনার বোনকে কেউ তিন তালাক দিলে আপনার ভাল লাগবে তো?”
কংগ্রেস সাংসদ গৌরব গগৈ বলেন, লোকসভায় এনডিএ-র যথেষ্ট গরিষ্ঠতা আছে ঠিকই, কিন্তু তার মানে এই নয় যে, সরকার সংসদীয় কমিটিকে এড়িয়ে যাবে। সেই কমিটিতেই এই ধরনের বিতর্কিত বিল নিয়ে আলোচনা হওয়া উচিত। তাঁর দাবি, ধর্ম ও সম্প্রদায় নির্বিশেষে মহিলাদের সুরক্ষার জন্য আইন করা হোক।
বিলের বিরোধিতা করে কংগ্রেস সাংসদ মহম্মদ জাভেদ বলেন, বিলটি আনার ফলে মুসলিম মহিলাদের জীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠবে। এই বিলের পাশাপাশি হিন্দু মহিলাদের জন্যও কোনও বিল আনা হোক। পাশাপাশি সপা সাংসদ এসটি হাসান বলেন, তিন তালাক দেওয়ার ফলে যদি কাউকে ৩ বছরের জেলে যেতে হয় তাহলে সে স্ত্রীকে ভরণপোষণ দেবে কীভাবে?
বিলের বিরোধিতা করে আরএসপি সাংসদ এন কে রামচন্দ্রন বলেন, হিন্দু ও খ্রিষ্টানদের বিবাহ বিচ্ছেদের ক্ষেত্রে স্বামীকে জেলে দিচ্ছেন না কেন? শুধুমাত্র মুসিলমদের জন্যই কেন এই আইন? এই আইন মুসলিম বিরোধী।
এদিন জেডি(ইউ )সাংসদ রাজীব রঞ্জন সিংহ লোকসভায় বলেন, এই বিলে একটি ‘এই বিল একটি নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ের মধ্যে অবিশ্বাস তৈরি করবে | আমাদের দল এই বিল সমর্থন করবে না | তবে এই বিলের সমর্থনে সরকারের পাশে দাঁড়িয়েছে এদিন এই বিলের সমর্থন করেছে নবীন পট্টনায়কের বিজেডি | এদিন সংসদে এই বিলের পক্ষে দলের সহমতের কথা জানান বিজেডি সাংসদ অনুভব মহান্তি |
এদিকে, সংসদে তখন তিন তালাক বিল নিয়ে জোর বিতর্ক চলছিল। সেই সময় স্পিকারের চেয়ারে বসা বিজেপি সাংসদ রমা দেবীর উদ্দেশ্যে আজম খান বলেন, ‘আপনাকে আমার এত ভালো লাগে যে, আপনার চোখে চোখ রেখে দেখতে ইচ্ছে করে।’ যাতে হতবাক রমা দেবী | তাঁর মন্তব্যের জেরে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে লোকসভায়।লোকসভার স্পিকার ওম বিড়লা সাংসদ আজম খানকে ক্ষমা চাইতে বলেন। আজম খান ক্ষমা চাওয়া তো দূরের ব্যাপার, উলটে জানান, ‘পদত্যাগ করতে পারি, যদি অসংসদীয় কথা বলে থাকি।’ গোটা ঘটনায় দলীয় সাংসদ আজম খানের পাশে দাঁড়িয়েছেন সমাজবাদী পার্টির নেতা অখিলেশ সিং যাদব।
এর আগের দফায় মোদী সরকার লোকসভায় তাৎক্ষণিক তিন তালাক বিল পাশ করাতে পারেনি। সেজন্য অধ্যাদেশ জারি করে ওই প্রথা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। চলতি অধিবেশনেও এর আগে পেশ হয়েছিল এই বিল | তবে লোকসভায় পাশ হলেও আটকে যার রাজ্যসভায় | এরপর আজ পুনরায় এই বিলটি লোকসভায় পেশ করে রবিশংকর প্রসাদ আরও বলেন, নতুন আইনের যাতে অপব্যবহার না হয়, সেজন্য কয়েকটি ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। বিলে বলা হয়েছে, তাৎক্ষণিক তিন তালাক দেওয়া জামিন অযোগ্য অপরাধ। কিন্তু বিচার শুরু হওয়ার আগে অভিযুক্ত ব্যক্তি বিচারকের কাছে জামিন চাইতে পারেন। বিচারক স্ত্রীর কথা শুনে জামিন দিতে পারবেন। কেন্দ্রীয় সরকার মনে করেছে লিঙ্গ সমতা রক্ষার্থে এই বিল পাশ করানো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শুধু তাই নয়, দেশের জনগণের সামনে বারবার মোদী সরকারের মন্ত্রীরা বলেছেন যে এই বিল পাশ করানোর সঙ্গে জুড়ে রয়েছে প্রধানমন্ত্রীর “সবকা সাথ, সবকা বিকাশ, সবকা বিশ্বাস”-অর্জনের লক্ষ্যও। তবে অধিকাংশ বিরোধী দলই এই বিলের কঠোর বিধানের বিরোধিতা করছে | এই বিল পাশ করাতে দলীয় সংসদের সংসদে উপস্থিত থাকতে হুইপ জারি করেছে বিজেপি |
দিনভর বিতর্কের শেষে স্পিকার ধ্বনি ভোটে পাশ হয়ে যায় তিন তালাক বিল। লোকসভায় পাশ হলেও একে আইনে পরিণত করতে হলে রাজ্যাসভায়ও পাশ করাতে হবে বিলটি | আগামীকাল শুক্রবারই রাজ্যসভায় পেশ হতে পারে এই বিল। তবে লোকসভার মতো রাজ্যসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা নেই বিজেপির। তাই বিরোধীদের সমর্থন ছাড়া কার্যত বিল পাশ কার্যত অসম্ভব।
এদিকে, তিন তালাক পাশ হওয়ার পর স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন পশ্চিমবঙ্গের বাংলা সাহিত্যিক আবুল বাশার। তিনি বলেন, ‘তালাক নিষিদ্ধ হলে আমি সবচেয়ে বেশি খুশি হব।’ বৃহস্পতিবার লোকসভায় তিন তালাক বিল পাশ হওয়ার পর সাহিত্যিক আবুল বাশার বলেন, ‘এটা আমার সারা জীবনের লড়াই। আমার সমগ্র সাহিত্য তো তিন তালাক নিয়মের বিরধীতা করেছে! মুসলিম নারীর বেদনার কথায় আমার লেখার মধ্যে দিয়ে তুলে ধরতে চেয়েছি।’ তাঁর সারা জীবনের লড়াই বেশির ভাগ সময়টাইয় তিনি ছিলেন একা। পরে পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন কেউ কেউ।
উল্লেখ্য, বহুদিন ধরেই তিনি তিন তালাকের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করছিলেন। তিনি মুসলিম ধর্মে তিনবার পরপর তালাক বলে ডিভোর্স দেওয়ার রীতির বিরোধীতা করেছেন তাঁর বিভিন্ন লেখায়। আবুল বাশারের প্রথম উপন্যাস ‘ফুল বউ’ প্রকাশিত হয় আনন্দ পাবলিশার্স থেকে। সেই উপন্যাসেই বাশার তিন তালাকের বিরুদ্ধে সরব হয়েছিলেন।