নয়াদিল্লি, ৫ জুলাই (হি.স.): নূন্যতম সরকার, সর্বোত্তম পরিষেবা, এটাই নরেন্দ্র মোদী সরকারের অন্যতম লক্ষ্য| ২০২২ সালের মধ্যে দেশের প্রত্যেক বাড়িতে পৌঁছে যাবে বিদ্যুৎ| পৌঁছে যাবে দূষণমুক্ত জ্বালানিও| প্রত্যাবর্তনের পর শুক্রবার দ্বিতীয় নরেন্দ্র মোদী সরকারের প্রথম পূর্ণাঙ্গ বাজেটে এ কথাই ঘোষণা করলেন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমণ| বাজেট পেশ করতে গিয়ে অর্থমন্ত্রী এদিন বলেন, ‘এ বছরই তিন লক্ষ কোটি (৩ ট্রিলিয়ন ডলার) মার্কিন ডলারের অর্থনীতির দেশ হয়ে উঠবে ভারত|’ অর্থমন্ত্রী ঘোষণা করেন, ‘২০২২ সালের মধ্যে দেশের প্রত্যেক বাড়িতে পৌঁছে যাবে বিদ্যুৎ| পৌঁছে যাবে দূষণমুক্ত জ্বালানিও|’ রেলের পরকাঠামো উন্নয়নে সরকারি-বেসরকারি যৌথ উদ্যোগে কাজ করা হবে বলেও জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রী| নির্মলার মতে, ২০১৮ থেকে ২০৩০ এর মধ্যে রেলের পরিকাঠামোর জন্য ৫০ লক্ষ কোটি টাকা প্রয়োজন|
দীর্ঘ ৭২ বছরের রীতি ভেঙে এবার নতুন চমক দিয়েছেন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমণ| ব্রিফকেস ছাড়াই এবার লাল রঙের ফাইলে বাজেট ২০১৯ নথি নিয়ে সংসদে আসেন অর্থমন্ত্রী| ঘড়ির কাঁটায় বেলা এগারোটা, ২০১৯-২০ অর্থবর্ষের বাজেট পেশ করেন দেশের প্রথম পূর্ণ সময়ের অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমণ| শুরুতেই সপ্তদশ লোকসভা নির্বাচন প্রসঙ্গে অর্থমন্ত্রী বলেছেন, ‘সম্প্রতি শেষ হওয়া লোকসভা ভোটে ব্যাপক হারে মানুষ ভোট দিয়েছেন| ভোটে স্পষ্ট মতামত দিয়েছেন দেশবাসী| নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে প্রথম সরকার ব্যাপক সাফল্যের সঙ্গে কাজ করেছে|’ এরপরই অর্থমন্ত্রী বলেছেন, ‘খাদ্য নিরাপত্তায় বাজেট বরাদ্দ তিন গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে| আমরা যখন ২০১৪ সালে সরকার গঠন করেছিলাম, তখন ১.৮৫ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারের অর্থনীতি ছিল| এখন এই অর্থনীতি ৩ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারের (তিন লক্ষ কোটি) অর্থনীতি, যা সারা বিশ্বে তৃতীয় ডিজিটাল ইন্ডিয়ার সুবিধা সব ক্ষেত্রে পৌঁছে যাচ্ছে| ১ লক্ষ কোটির (১ ট্রিলিয়ন ডলার) অর্থনীতিতে পৌঁছতেই ভারতের ৫০ বছরেরও বেশি সময় লেগেছে| কিন্তু, হৃদয় যখন আশা, বিশ্বাস ও উচ্চাকাঙ্খায় পরিপূণ, তখন বিগত পাঁচ বছরেই ১ ট্রিলিয়ন ডলার অর্থনীতি যুক্ত করা হয়েছে| মজবুত দেশের জন্য মজবুত নাগরিক লক্ষ্যেই এগোচ্ছি আমরা| নতুন ভারত গড়াই লক্ষ্য|’
‘ভারতমালা’, ‘সাগরমালা’ প্রকল্পের মাধ্যমে শহর-গ্রামের ব্যবধান কমানোর পরিকল্পনা করেছে নরেন্দ্র মোদী সরকার| অর্থমন্ত্রীর কথায়, ”ভারত মালা’, ‘সাগরমালা’ ও ‘উড়ান’-এর মতো প্রকল্প গ্রামীণ ও শহুরে ব্যবধানকে কমাচ্ছে, ফলে আমাদের পরিবহণ পরিকাঠামোর উন্নতি হচ্ছে|’ বাজেট পেশ করার সময় অর্থমন্ত্রী বলেছেন, মহিলাদের সম্ভ্রম ও সম্মান বেড়েছে বাড়ি বাড়ি শৌচালয় তৈরির মাধ্যমে| প্রধানমন্ত্রী গ্রাম সড়ক যোজনা, জল মার্গ বিকাশ, ফ্রেট করিডর তৈরি হয়েছে| শিল্পক্ষেত্রে বিনিয়োগের জন্য এই পরিকাঠামো নির্মাণ ব্যাপক সহায়ক হয়েছে| দেশকে মজবুত অর্থনৈতিক ভিতের উপর দাঁড় করানোই লক্ষ্য| ইলেকট্রিক যানবাহন তৈরিতে উত্সাহ দেওয়া হবে বলেও জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রী| নির্মলা সীতারমণ আরও বলেছেন, ব্যক্তিগত এবং গণ পরিবহণে এই ব্যাটারি চালিত বা ইলেকট্রিক যান ব্যবহারে জোর দেওয়া হবে| ২০১৮-১৯-এ নতুন মেট্রো প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে| চলতি বছর ২১০ কিলোমিটার রেললাইন পাতা হবে| নতুন ৩০০ কিলোমিটার মেট্রো লাইন তৈরির লক্ষ্যে এগনো হবে| ফরাক্কা ও হলদিয়ায় নেভিগেশন গেট তৈর করা হবে| আধুনিক বাড়িভাড়া আইন আনা হবে| সাধ্যের মধ্যে বাড়ি তৈরিতে জোর দেওয়া হবে| ক্ষুদ্র ও মাঝার শিল্পের জন্য ১ কোটি টাকা পর্যন্ত ঋণের বন্দোবস্ত করা হয়েছে| এই ঋণের জন্য মাত্র ২ শতাংশ সুদ দিতে হবে এই সব সংস্থাকে, এতে ৩ কোটি ক্ষুদ্র ও মাঝার ব্যবসায়ীরা উপকৃত হবেন|
দেশের প্রথম পূর্ণ অর্থমন্ত্রী বাজেট পেশ করার সময় আরও বলেছেন, সরকারী যানবাহনে যাতায়াতের জন্য একটি নির্দিষ্ট কার্ড তৈরি হবে| অসামরিক বিমান পরিবহণে ভারতে বিপুল বাণিজ্যের সুযোগ রয়েছে| বিমান পরিবহণ ক্ষেত্রে বিনিয়োগে উত্সাহ দেওয়া হবে| ২০১৮ থেকে ২০৩০ এর মধ্যে রেলের জন্য ৫০ লক্ষ কোটি টাকা প্রয়োজন| আমরা সরকার-বেসরকারি উদ্যোগের পরিকল্পনা করেছি| অর্থমন্ত্রীর কথায়, ‘রেলের পরিকাঠামোর আরও উন্নতি করা হবে| রেলের পরকাঠামো উন্নয়নে সরকারি-বেসরকারি যৌথ উদ্যোগে কাজ করা হবে| ২০১৮ থেকে ২০৩০ এর মধ্যে রেলের পরিকাঠামোর জন্য ৫০ লক্ষ কোটি টাকা প্রয়োজন| দ্রুত উন্নয়ন এবং যাত্রীদের মালবাহী সেবা প্রদানের জন্য পিপিপি ব্যবহার করা হবে|’
অর্থমন্ত্রী আরও ঘোষণা করেছেন, কেওয়াইসি পদ্ধতিকে আরও সহজ করা হবে| আন্তর্জাতিক বাজারে অস্থিরতা সত্ত্বেও ভারতে বিদেশি বিনিয়োগ বেড়েছে| ভারতকে বিদেশি বিনিয়োগের স্বর্গরাজ্য করে তুলতে বদ্ধপরিকর সরকার| বিদেশি শিল্পপতি, বিনিয়োগকারীদের নিয়ে প্রতি বছর একটি বাণিজ্য সম্মেলণ করা হবে| দেশের গ্রামীন অংশের উন্নয়নে জোর দিয়েছে সরকার| জাতীর জনক মহাত্মা গান্ধীর উদ্ধৃত দিয়ে অর্থমন্ত্রী বলেছেন, গান্ধীজী বলেছিলেন, গ্রামেই ভারতের আত্মা বাস করে| গ্রাম-গরিব-কৃষক, আমাদের সরকারের প্রতিটি প্রকল্পে এই লক্ষ্যই থাকে| ৭ কোটি নতুন গ্যাস কানেকশন দেওয়া হয়েছে উজ্জ্বলা যোজনায়| প্রতিটি গ্রামে ২০২২ সালের মধ্যে বিদ্যুৎ ও দূষণহীন জ্বালানি পৌঁছে দেওয়া হবে| কেউ না নিতে চাইলে সেটা আলাদা বিষয়| দেড় কোটি গ্রামীণ বাড়ি তৈরি করা হয়েছে গত পাঁচ বছরে| আরও ১.৯৫ কোট বাড়ি তৈরির লক্ষ্যমাত্রা নেওয়া হবে| প্রথমে ৩১৪ দিনে এই বাড়ি গুলি তৈরি সম্পূর্ণ করা হত, এখন সেটা কমে দাঁড়িয়েছে ১১৪ দিনে| কৃষক পরিকাঠামোয় আমরা ব্যাপক হারে বিনিয়োগ করব|
বাজেট পেশ করার সময় অর্থমন্ত্রী আরও বলেছেন, সরকার-বেসরকারি উদ্যোগে এই বনিয়োগ বাড়ানো হবে| এছাড়াও দুগ্ধ উত্পাদন ও প্রক্রিয়াকরণে উত্সাহ দেওয়া হবে| ডাল উত্পাদনে কৃষকরা বিপ্লব নিয়ে এসেছেন, তৈলবীজ ক্ষেত্রেও তাঁরা এই সাফল্য পাবেন বলে আমরা আশাবাদী| ব্যবসা সরলীকরণের সুবিধা কৃষকদেরও পাওয়া উচিত| অর্থমন্ত্রী বলেছেন, ‘সব ভারতবাসীর জন্য বিশুদ্ধ জল সরবরাহ করতে বদ্ধপরিকর সরকার| এই লক্ষ্যে বৃহত্ পদক্ষেপ হল জলশক্তি মন্ত্রক তৈরি করা| এই নতুন মন্ত্রক আমাদের জলসম্পদ ও জল সরবরাহের ম্যানেজমেন্টকে সমন্বিত ও সামগ্রিকভাবে দেখবে, ‘ঘর ঘর জল’ পৌঁছে দেওয়ার কাজ নিশ্চিত করবে| ‘জল জীবন মিশন’-এর মাধ্যমে ২০২৪ সালের মধ্যে প্রতিটি গ্রামীণ বাড়িতে বিশুদ্ধ জল পৌঁছে দেওয়া হবে|’ অর্থমন্ত্রীর কথায়, ৯.৬ কোটি টয়লেট তৈরি করা হয়েছে স্বচ্ছ ভারত মিশন প্রকল্পে| আগামী পাঁচ বছরে ১২৫০০ কিলোমটার রাস্তা তৈরিতে ৮০ হাজার ২৫০ কোটি টাকা ব্যয় করা হবে| প্রতিটি গ্রামে সলড ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট প্রকল্প তৈরির লক্ষ্য নেওয়া হয়েছে| এই সরকার মনে করে দ্রুত শহরায়ন একটা বড় চ্যালেঞ্জ| গ্রাম থেকে শহরের দকে চলে আসার প্রবণতার জন্য পরিষেবা দেওয়াই বড় চ্যালেঞ্জ| শহরাঞ্চলে ২৪ লক্ষ বাসস্থান তৈরি করে হস্তান্তর করা হয়েছে| ৯৫ শতাংশ শহর খোলা শৌচালয় মুক্ত হয়েছে দেশে| ২০১৯ সালের ২ অক্টোবরের মধ্যে খোলা শৌচালয় মুক্ত দেশ গড়ার লক্ষ্য|
অর্থমন্ত্রী আরও বলেছেন, মহাত্মা গান্ধীর জীবনী, আদর্শ ও কর্মকাণ্ড নিয়ে তৈরি হয়েছে ‘গান্ধীপিডিয়া’| গান্ধীজীর ইতিবাচক মূল্যবোধ সম্পর্কে যুব সমাজকে তরান্বিত করার জন্য ‘গান্ধীপিডিয়া’ তৈরি করা হয়েছে| ন্যাশনাল রিসার্চ ফাউন্ডেশন তৈরির প্রস্তাব করেছেন নির্মলা সীতারমণ| বিভিন্ন গবেষণায় অনুদান ও অন্যান্য ক্ষেত্রে সমন্বয় আনতে এই এনআরএফ তৈরির প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে| উচ্চ শিক্ষা ক্ষেত্রে ভারতের বিরাট সুযোগ রয়েছে, বিদেশি ছাত্রদের দেশে টানতে উত্সাহ বাড়ানো হবে| ন্যাশনাল স্পোর্টস এডুকেশন বোর্ড তৈরি করা হবে, সমস্ত রকম খেলাধুলোয় উত্সাহ দিতে ও আর্থিক সাহায্য দিতে বোর্ড কাজ করবে| অর্থমন্ত্রী আরও বলেছেন, ‘শুধুমাত্র স্টার্ট-আপ ব্যবসার জন্য আমরা দূরদর্শনে টেলিভশন প্রোগ্রাম শুরু করতে চাই| এতে নতুন ব্যবসায়ীদের উত্সাহ বাড়বে, নানা ক্ষেত্রে বিনিয়োগে উত্সাহ বাড়বে, নিজেদের ব্যবসা বাড়াতেও সহায়ক হবে|’ ব্যবসায় উত্সাহ দিতে ব্যাঙ্কগুলিকেও যথাসাধ্য আর্থিক সাহায্য করবে সরকার| তফশিলি জাতি ও উপজাতিদের জন্য স্টার্ট-আপে বিশেষ সুবিধা দেওয়া হবে| এই সরকার ‘মিনিমাম গভর্নমেন্ট, ম্যাক্সিমাম গভর্ন্যান্স’-এ বিশ্বাসী| ৬০ বছর বয়সের পর অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকদের জন্য মাসে ৩০০০ টাকা পেনশনের ব্যবস্থা করেছে সরকার| ৩৫ কোটি এলইডি বাল্ব বিতরণ করা হয়েছে উজ্জ্বলা যোজনায়, এতে খরচ কমেছে| এর ফলে প্রতি বছর ১৮৩৪১ কোটি টাকা সাশ্রয় হচ্ছে দেশের| সৌরবাত ও সৌরবিদ্যুৎ তৈরিতে উত্সাহ দেবে সরকার| ভারতীয় পাসপোর্টধারীদের অনাবাসী ভারতীয়দের জন্য আধারকার্ড দেওয়া হবে| অর্থমন্ত্রী প্রস্তাব করেছেন, ‘প্রথা অনুযাযী ১৮০ দিন অপেক্ষা না করে ভারতীয় পাসপোর্টধারী যে সমস্ত অনাবাসী দেশে পৌঁছবেন, তাঁদের সঙ্গে সঙ্গে আধার কার্ড ইস্যু করার প্রস্তাব জানাচ্ছি|’ অর্থমন্ত্রীর কথায়, ‘মহিলাদের উন্নতি ছাড়া বিশ্বের উন্নয়ন সম্ভব নয়, বলেছিলেন স্বামী বিবেকানন্দ| এই মন্ত্রেই বিশ্বাসী ভারত সরকার| গ্রামীণ অর্থব্যবস্থায় মহিলাদের ভূমিকা অপরিসীম| মহিলাদের ভূমিকা ও সুবিধা দিতে বদ্ধপরিকর এই সরকার| আমি একটি কমট গঠনের প্রস্তাব দিচ্ছি, যা মহিলাদের এই কাজের মূল্যায়ন, সাহায্য উন্নয়নে সাহায্য করবে| সাম্প্রতিক ভোটে মহিলাদের ভোটদানের হার উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে| সৃজনশীল শিল্পী ও কারিগরদের জন্য বিশেষ প্রকল্প আনবে সরকার| তাঁদের জন্য পেটেন্ট এবং জিওগ্রাফিক ইন্ডিকেশন দেওয়া হবে| অর্থমন্ত্রী আরও জানিয়েছেন, নন পারফর্মিং অ্যাসেট কমেছে ১ লক্ষ কোটি| সরকারি ব্যাঙ্কগুলিকে ৭০ হাজার কোটি টাকা দেওয়া হবে| এছাড়াও অনলাইন হোম লোন, ডোর টু ডোর পরিষেবাতেও জোর দেওয়া হবে বলে জানান নির্মলা| আবার আগামী ৫ বছরে পরিকাঠামো ক্ষেত্রে ১০০ লক্ষ কোটি টাকা বিনিয়োগ করবে সরকার| এর জন্য একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি তৈরি হবে|