বিশ্বে পরিবেশ দূষণের তালিকায় এক নম্বর ঢাকা : বাতাসে কার্বন ও সিসার মাত্রা বাড়ছে

ঢাকা, ২ মার্চ (হি. স.) : পরিবেশ অধিদফতরের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, রাজধানী ঢাকার বাতাসে স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর কার্বন ও সিসার পরিমাণ দিন দিন বাড়ছে। ঢাকার বায়ুমান সূচক ২৬৯, যা বিপদসীমার মধ্যে রয়েছে। বায়ুদূষণের সবচেয়ে বড় কারণ রাজধানীর আশপাশের ইটভাটা। বাংলাদেশে বছরে বায়ুদূষণের কারণে লক্ষাধিক মানুষ মারা যায়। পাশাপাশি শ্বাসকষ্টজনিত নানা সমস্যায় ভোগেন অনেকেই। পরিবেশ অধিদফতর আরও জানিয়েছে, সম্মিলিত উদ্যোগ আর আইন প্রয়োগ কঠোর না হলে বায়ুদূষণ রোধ করা যাবে না।


উল্লেখ্য, আন্তর্জাতিক এয়ার ভিজুয়ালের জরিপে বিশ্বে সবচেয়ে বেশি বায়ুদূষণের মাত্রাযুক্ত শহরের তালিকায় ঢাকা এক নম্বরে। এ তালিকায় রয়েছে প্রতিবেশী দেশ ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লি এবং পাকিস্তানের লাহোর। ঢাকার বাতাস এখন লাল ক্যাটাগরিভুক্ত। ঢাকার তিনটি স্থানে পরিমাপক যন্ত্র বসিয়ে ঢাকার বায়ুমানের সূচক মিলেছে ২৬৯। বেজিং ও দিল্লির বায়ুমানের চেয়েও শোচনীয় এই অবস্থান। নভেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত দূষণ বেড়ে যায় আরও ৪ গুণ। নরওয়ে ইনস্টিটিউট অব এয়ার রিসার্সের মাধ্যমে করা জরিপে দেখা গেছে, ঢাকার চারপাশে প্রায় ১ হাজার ইটভাটা নভেম্বর থেকে চালু হয়। সেগুলো এই বায়ুদূষণের জন্য ৫৮ শতাংশ দায়ী। এছাড়া সড়কের ধুলোর জন্য ১৮ শতাংশ, যানবাহনের কারণে ১০ শতাংশ, বায়োগ্যাস পোড়ানোর জন্যে ৮ শতাংশ ও অন্যান্য কারণে ৬ শতাংশ দূষণ হচ্ছে। বায়ুদূষণের কারণে ৭ লাখেরও অধিক মানুষ ভুগছে শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যায়। সর্বশেষ বৈশ্বিক বায়ু পরিস্থিতি ২০১৮ প্রতিবেদনে তথ্য অনুযায়ী বায়ুদূষণের কারণে বাংলাদেশে বছরে মারা যাচ্ছে ১ লাখ ২২ হাজার ৪শ’ মানুষ।আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান সাময়িকী \”সায়েন্স অব দ্য টোটাল এনভায়রনমেন্ট এবং এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স অ্যান্ড পলিউশন রিসার্চ\”-এ গবেষণা দুটির ফল সম্প্রতি প্রকাশ হয়েছে। ওই গবেষণায় উঠে এসেছে, ঢাকার পথের ধুলোয় সর্বোচ্চ মাত্রায় সিসা, ক্যাডমিয়াম, দস্তা, ক্রোমিয়াম, নিকেল, আর্সেনিক, ম্যাঙ্গানিজ ও কপারের অস্তিত্ব পাওয়া গিয়েছে। মাটিতে যতটা ক্যাডমিয়াম থাকা স্বাভাবিক, ঢাকায় পদার্থটি পাওয়া গেছে এর চেয়ে ২০০ গুণ বেশি।

ক্যাডমিয়ামকে ক্যান্সার সৃষ্টিকারী বলে শনাক্ত করেছে ইন্টারন্যাশনাল এজেন্সি ফর রিসার্চ অন ক্যান্সার। বিশেষ করে প্রোটেস্ট ও লাং ক্যান্সারের সঙ্গে এর সংযোগ রয়েছে। অস্টিওপরোসিস ও ব্রেস্ট ক্যান্সারের ঝুঁকিও বাড়িয়ে দেয় এটি। ইউরোপীয় ইউনিয়ন আরো পাঁচটি বায়ুদূষণকারী উপাদানের সঙ্গে এটিকে নিষিদ্ধ করেছে। বাতাসে নির্ধারিত মাত্রায় বিভিন্ন ক্ষতিকারক পদার্থ ক্ষতিকর নয়। কিন্তু এসব ধাতু নির্ধারিত মাত্রার চেয়ে অনেক বেশি পরিমাণে পাওয়া যাচ্ছে ঢাকার বাতাসে, যা স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। এসব তথ্য উঠে এসেছে একাধিক জরিপ ও গবেষণা প্রতিবেদনে। বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে এসব তথ্য তুলে ধরা হলেও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ চোখে পড়ছে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগ, পরমাণু শক্তি কমিশন ও যুক্তরাষ্ট্রের আইওয়া বিশ্ববিদ্যালয় যৌথভাবে ঢাকার বায়ুদূষণ নিয়ে দুটি গবেষণা করেছে।

এতে জানা যাচ্ছে, ঢাকার বায়ু নিশ্বাসের মাধ্যমে কতটা দূষিত পদার্থ আমাদের রক্তে ছড়িয়ে দিচ্ছে। গবেষণায় দেখা গেছে, ঢাকার রাস্তার ধুলোয় সিসা ও নিকেলের মাত্রা দ্বিগুণের বেশি। হৃদরোগ, ক্যান্সার সৃষ্টি করতে পারে ভারি ধাতু সিসা। এটি মানবদেহের শ্বাস-প্রশ্বাস প্রক্রিয়া অকার্যকর করতে পারে। প্রসূতির জন্যও হতে পারে বিপদের কারণ। আর্সেনিকের বিষক্রিয়ার সঙ্গে আমরা আগে থেকেই পরিচিত। বিশেষ করে ভূগর্ভস্থ জলে এর মিশ্রণ ঘটে। বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের নলকূপের পানিতে মাত্রাতিরিক্ত আর্সেনিক পাওয়া গেছে। যেসব এলাকায় জলে আর্সেনিকের মিশ্রণ বেশি, সেখানে রোগবালাইও বেশি। ঢাকার রাস্তায় ধুলোর মধ্যেও নির্ধারিত মাত্রার চেয়ে বেশি আর্সেনিক শনাক্ত করেছে গবেষক দল। এসব ভারি ধাতু এতটাই সূক্ষ্ম যে, তা মানুষের চুলের ২৫-১০০ ভাগের বেশি ছোট। এসব সূক্ষ্ম ধাতুকণা ত্বকের সংস্পর্শে আসে এবং শ্বাস-প্রশ্বাস, খাদ্যগ্রহণ ও পানীয়ের মাধ্যমে সহজে মানুষের শরীরে প্রবেশ করে। ধুলোয় ভারী ধাতুতে স্বাস্থ্য ঝুঁকি বিষয়ক গবেষণায় বলা হয়, রাজধানীর ২২টি সড়কের ৮৮টি এলাকার রাস্তা, ফুটপাথ, নর্দমার পাশের মাটি ও গর্ত থেকে ৩০০ গ্রাম করে ধুলোর নমুনা সংগ্রহ করা হয়।

সংগৃহীত নমুনা পরে পরমাণু শক্তি কমিশনের গবেষণাগারে বিশ্লেষণ করা হয়েছে। ৮৮টি এলাকার সবখানে ভারি ধাতু পাওয়া যায়। যেসব এলাকায় যানজট বেশি বা যানচলাচল বেশি সেখানে ভারি ধাতুর পরিমাণও বেশি। এর মাত্রা বেশি পাওয়া গেছে, যেখানে ধাতু গলানো হয় সেখানেও। জিপিও, বঙ্গভবন ও রামপুরা টিভি স্টেশন এলাকায় ক্যাডমিয়ামের পরিমাণ স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে ২০০ গুণ বেশি পাওয়া গেছে। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ব্যাটারিচালিত যানবাহন ঢাকায় চলাচল করে। এসব যানবাহনে নিকেল ও ক্যাডমিয়াম ব্যাটারি ব্যবহৃত হয়। ঢাকা মহানগরী অপরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠেছে। শহরের বিভিন্ন এলাকায় রয়েছে কলকারখানা। আবাসিক এলাকা আর কলকারখানা একই জায়গায় গড়ে উঠেছে। এসব কলকারখানার অনেকগুলোতে ক্যাডমিয়াম ব্যবহৃত হয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *